কৃষি ও প্রকৃতি

বাংলায় নেমেছে হেমন্তের দিন

শীত-শরতের সেতু বাঁধতে বঙ্গের ভূমিতে নেমেছে হেমন্তের দিন। মাঠে মাঠে হালকা বাতাসে দুলছে সোনার ধান। কার্তিকের সবুজ মধ্যাহ্নে ফসলের মাঠে চোখজুড়ে স্বপ্ন বুনছে কৃষান-কৃষানিরা। স্কুল বালিকারা ধানক্ষেতের আল ডিঙিয়ে হেঁটে যাচ্ছে শিশিরভেজা পায়ে, নদীতে হাঁসের বাথান মেতেছে জলকেলিতে, সারি সারি ডিঙি নৌকা দেহ এলিয়ে চিৎ হয়ে শুয়ে আছে আকাশের তলে। দূরের অরণ্যঘেরা পাহাড়টা ক্রমে ঢেকে দিচ্ছে মৃদু কুয়াশা। জলাঙ্গীর ঢেউয়ে ভেজা এ বাংলায় এমনই বিচিত্র দৃশ্যের আবাহন নিয়ে হাজির হয়েছে চতুর্থ ঋতু হেমন্ত। এরই মধ্য দিয়ে প্রকৃতিও শোনাচ্ছে শীতের পূর্বাভাস।

Advertisement

আজ পহেলা কার্তিক ১৪২৮ বঙ্গাব্দ, হেমন্তের প্রথম দিন। জীবন ও প্রকৃতিতে এক আশ্চর্য বিভোরতা-রোমান্টিকতা নিয়ে আসে হেমন্ত। বাংলা সাহিত্যে কবি-শিল্পীদের সৃজনে নানা মাত্রিকতা ও আঙ্গিকে ধরা দিয়েছে নবান্নের এ ঋতু। বাংলা কবিতায় হেমন্ত বন্দনা সবিশেষ স্থানজুড়ে বিরাজ করছে। তিমির হননের কবি জীবনানন্দ দাশ তো পরাবাস্তবতাকেই জীবন ও কবিতার সারবস্তু হিসেবে প্রত্যক্ষ করেছেন। শঙ্খচিল, শালিক কিংবা ভোরের কাক হয়ে বাংলার এ সবুজ করুণ ডাঙায় বারবার ফেরার আকুতি প্রকাশ করেছেন।

এ বিভোরতা নিয়ে কবিতায় লিখেছেন- ‘প্রথম ফসল গেছে ঘরে,-/ হেমন্তের মাঠে – মাঠে ঝরে/ শুধু শিশিরের জল; অঘ্রানের নদীটির শ্বাসে/ হিম হয়ে আসে/ বাঁশ – পাতা – মরা ঘাস- আকাশের তারা!/ বরফের মতো চাঁদ ঢালিছে ফোয়ারা !/ ধানক্ষেতে – মাঠে/ জমিছে ধোঁয়াটে/ ধারালো কুয়াশা!/ ঘরে গেছে চাষা ;/ ঝিমায়াছে এ- পৃথিবী ,- তবু পাই টের/ কার যেন দুটো চোখে নাই এ ঘুমের কোনো সাধ!’ [কবিতা- পেঁচা (মাঠের গল্প)]

ধান মাঠের দৃশ্য শিকারি কবি নবান্নের অবিচ্ছিন্ন অনুভবে লিখেছেন- ধান কাটা হয়ে গেছে কবে যেন — ক্ষেত মাঠে পড়ে আছে খড়/ পাতা কুটো ভাঙা ডিম — সাপের খোলস নীড় শীত। এই সব উৎরায়ে ওইখানে মাঠের ভিতর/ ঘুমাতেছে কয়েকটি পরিচিত লোক আজ — কেমন নিবিড়। [কবিতা- ধান কাটা হয়ে গেছে]

Advertisement

কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতায়ও হেমন্তগীত দুর্দান্তভাবে উদ্ভাসিত হয়েছে। তার লেখায়- ‘অন্ন জোটে না, কথা জোটে মেলা,/ নিশিদিন ধরে এ কি ছেলেখেলা!/ ভারতীরে ছাড়ি ধরো এইবেলা/ লক্ষ্মীর উপাসনা।’ [কবিতা- পুরস্কার]

ষড়ঋতুর এ দেশে কার্তিক-অগ্রহায়ণ দুই মাস হেমন্তকাল। এখন ধীরে কমছে সূর্যের প্রখরতা, ছোট হয়ে আসছে দিনের আয়ু। কদিন বাদেই এ ভূ-ভাগে জেঁকে বসবে শীত। শীতের পূর্বভাগে মূলত এ ঋতু ঘিরে বাঙালির চিরায়ত যে নবান্নের ছোঁয়া তা দিন দিনই মলিন হয়ে যাচ্ছে। নবান্ন উৎসবের ঐতিহ্যগত যে কদর, সেটিও যেন বিবর্ণ অনেকটাই। তবুও সব মলিনতা তুচ্ছ করে অপরূপ রূপে সেজেছে হেমন্ত।

বিদ্রোহী কবি নজরুল ইসলাম কবিতায় হেমন্তের বন্দনায় লিখেছেন- ‘ঋতুর খাঞ্চা ভরিয়া এল কি ধরণির সওগাত?/ নবীন ধানের আঘ্রাণে আজি অঘ্রাণ হল মাত।/ ‘গিন্নি-পাগল’ চালের ফিরনি/ তশতরি ভরে নবীনা গিন্নি/ হাসিতে হাসিতে দিতেছে স্বামীরে, খুশিতে কাঁপিছে হাত।/ শিরনি বাঁধেন বড়ো বিবি, বাড়ি গন্ধে তেলেসমাত!’ [কবিতা- অঘ্রাণের সওগাত]

হেমন্তের প্রথম মাস কার্তিক ও দ্বিতীয় মাস অগ্রহায়ণেরও রয়েছে ভিন্ন রূপ। হেমন্ত একদিকে যেমন শরতের বিদায় টঙ্কা বাজায়, অন্যদিকে শীতের আগমনী বার্তা শোনায়। এখন কৃষকের গোলার ধান প্রায় শেষ দিকে। এ কারণে অনেকে এ মাসকে ‘মরা কার্তিক’ বলেও অভিহিত করে। তবে অগ্রহায়ণে ধান কাটা শেষে কার্তিকের শূন্য গোলা ভরে উঠে সোনার ধানে। গ্রামীণ জীবনে তখন কেবলই ছড়ায় পাকা ধানের মিষ্টি ঘ্রাণ। রাতে প্রতিবেশী বধূদের ঢেঁকিতে ধান ভানার শব্দ ভেসে আসে দূর থেকে।

Advertisement

দেশের কিছু অঞ্চলে এরই মধ্যে ধান কাটা শুরু হয়েছে। এটা আগাম আমন ধান কাটার মৌসুম। বিশেষ করে উত্তরাঞ্চলে মহাধুমধামে চলছে ফসল কাটা ও মাড়াইয়ের কাজ। কার্তিকের মাঝামাঝি সারাদেশেই ফসলের মাঠে ব্যস্ততা বাড়বে। ধুম পড়বে সোনার ধান ঘরে তোলার। এরপরই নতুন চালে শুরু হবে নবান্ন। পিঠা-পুলির উৎসব।

এমকেআর/জিকেএস