বিশেষ প্রতিবেদন

কম টাকায় বিদেশে নিয়ে ‘মুক্তিপণের ফাঁদ’

জোসনা বেগমের ছেলে জসীম মৃধা জুয়েল। রাজধানীর যাত্রাবাড়ী এলাকায় ভ্যানে ফল বিক্রি করতেন। এসময় পরিচয় হয় সেলিম নামে একজনের সঙ্গে। পরিচয়সূত্রে জুয়েলকে বিদেশে যাওয়ার জন্য ‘উৎসাহিত করেন’ সেলিম। এজন্য তিনি লিবিয়াপ্রবাসী মনির নামে একজনের সঙ্গে ফোনে কথাও বলিয়ে দেন জুয়েলকে।

Advertisement

বিদেশ পাঠাতে চার লাখ ২০ হাজার টাকা খরচের কথা জানান সেলিম। তবে দেশে সেই টাকার মধ্যে মাত্র ৫০ হাজার টাকা দিতে হবে বাকি টাকা লিবিয়ায় পৌঁছে! এভাবে জুয়েলকে ‘সহজে বিদেশ যাওয়ার’ প্রলোভন দেখিয়ে ফাঁদে পাতেন সেলিম। জুয়েল লিবিয়া যান ঠিকই, তবে সেখানে যাওয়ার পর তাকে কাজ না দিয়ে মুক্তিপণ আদায়ের জন্য শুরু হয় মানবপাচারকারীদের নির্যাতন।

একইভাবে মনিরের সঙ্গে মোবাইলে কথা বলে বিদেশ যান মিরপুরের রাকিব। মনির তাকে দেশে থাকতে মাত্র পাঁচ হাজার টাকা দিতে বলেন। এজন্য রাকিবকে প্রথমে ভ্রমণভিসায় দুবাই পাঠানো হয়। এরপর দুবাই থেকে একই রকম ভিসায় পাঠানো হয় লিবিয়ায়। সেখানে মানবপাচার চক্রের সদস্যরা তাকে ক্যাম্পে আটকে রাখে। সেখানে চলে মুক্তিপণের জন্য নির্যাতন। মোবাইলে তার কান্নার আওয়াজ শুনিয়ে পরিবারের কাছ থেকে চক্রটি হাতিয়ে নেয় সাত লাখ টাকা।

এদিকে সুমন ব্যাপারীর আলজেরিয়াপ্রবাসী বন্ধু আবুল কালাম আজাদ তাকে ১৫ লাখ টাকায় বৈধভাবে স্পেনে যাওয়ার প্রস্তাব দেন। এরপর ২০১৮ সালের ৯ জুলাই সুমন ব্যাপারী স্পেনে যেতে রাজি হন এবং সাজিদ ও রায়হানকে নগদ দুই লাখ টাকা দেন। তখন তারা সুমনের পাসপোর্ট নিয়ে দু-এক মাসের মধ্যে স্পেনের ভিসা হয়ে যাবে বলে জানান। এরপর সুমন পাঁচ হাজার ইউরো নিয়ে ভারতে যান সেপ্টেম্বরে। ভারতে যাওয়ার পর থেকে সুমনের পরিবার তার কোনো সন্ধান পায় না। এরপর ২০১৯ সালের ২৫ এপ্রিল সুমন বাড়িতে ফোন দিয়ে জানান, মরক্কোয় মানবপাচারকারীরা তাকে আটকে রেখেছে।

Advertisement

শুধু জুয়েল, রাকিব ও সুমন ব্যাপারী নন। এমন অনেক তরুণকে নামমাত্র অর্থের বিনিময়ে বিদেশ পাঠানো হয়। তবে কারও ভাগ্যে সেখানে গিয়ে কাজ জোটেনি। এর বদলে সেখানে পৌঁছানো মাত্রই মুক্তিপণের জন্য চলে অমানবিক নির্যাতন। কান্নাকাটির আওয়াজ শুনিয়ে পরিবারের কাছ থেকে হাতিয়ে নেওয়া হয় লাখ লাখ টাকা। টাকা না দিলে নির্যাতনের মাত্রা বাড়ে।

এসব ঘটনায় মামলা করেন জুয়েল, রাকিবসহ অনেক ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারের সদস্যরা। এছাড়া মামলা করে পুলিশও। মামলার পর পাচারকারীদের গ্রেফতার করেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। একাধিকবার রিমান্ডেও নেওয়া হয় আসামিদের।

মানবপাচারের ঘটনায় ঢাকা মহানগর হাকিম আদালতে এসব মামলায় মোট ১৭৪ জনের বিরুদ্ধে চার্জশিট দিয়েছে মামলার তদন্ত সংস্থা সিআইডি। তাদের মধ্যে একই ব্যক্তির নাম একাধিক চার্জশিটেও রয়েছে। এছাড়া গত বছর মে মাসে লিবিয়ার মিজদা শহরে বন্দিশিবিরে গুলি করে ২৬ বাংলাদেশিকে হত্যা করে অপহরণকারীরা। গুলিবিদ্ধ হলেও প্রাণে বেঁচে যান ১২ জন। হতাহতের ঘটনায় দেশের বিভিন্ন থানায় ২৫টি মামলা করে তাদের পরিবার। এ পর্যন্ত ২৩টি মামলার চার্জশিট দেওয়া হয়েছে আদালতে। এসব চার্জশিটে মোট আসামি ২৮৮ জন। গ্রেফতার করা হয়েছে ১৫৩ জনকে। পলাতকদের মধ্যে ছয়জনের বিরুদ্ধে ইন্টারপোলের মাধ্যমে রেড নোটিশ দিয়েছে সিআইডি।

চার্জশিটে সিআইডি বলছে, মানবপাচারকারী চক্রের সদস্যরা প্রথমে ভুক্তভোগীদের কম টাকায় বিদেশে নেওয়ার প্রস্তাব দেন। রাজি হলে বিদেশে নিয়ে ভুক্তভোগীকে পরিবারের কাছ থেকে লাখ লাখ টাকা আনার জন্য চাপ দিতে থাকেন। টাকা না দিলে তাদের অমানবিক নির্যাতন করা হতো।

Advertisement

ভুক্তভোগী জুয়েলকে বিদেশে পাচারের অভিযোগে তার মা জোসনা বেগম বাদী হয়ে গত বছরের ৬ জুন রাজধানীর মতিঝিল থানায় মানবপাচার প্রতিরোধ ও দমন আইনে মামলা করেন। তদন্ত শেষে সিআইডির উপ-পরিদর্শক মো. রফিকুল ইসলাম ২১ মানবপাচারকারীর বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র (চার্জশিট) দাখিল করেন।

এ বিষয়ে সিআইডির উপ-পরিদর্শক মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, জুয়েলকে ভ্রমণভিসায় দুবাই হয়ে লিবিয়া পাঠানো হয়। লিবিয়া পৌঁছানোর পর লিবিয়া ও বাংলাদেশের দালালরা জুয়েলের কাছ থেকে পাসপোর্ট ও অন্যান্য কাগজপত্র নিয়ে যায়। এরপর মুক্তিপণ আদায়ের জন্য তাকে টর্চারসেলে আটকানো হয়। সেখানে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন চলে। কান্নাকাটির আওয়াজ শুনিয়ে জুয়েলের পরিবারের কাছ থেকে দুই কিস্তিতে চার লাখ টাকা হাতিয়ে নেয় চক্রটি।

বিদেশে পাচারের অভিযোগে ভুক্তভোগী রাকিবের বাবা মান্নান মুন্সি বাদী হয়ে গত বছরের ৪ জুন পল্টন থানায় মামলা করেন। তদন্ত শেষে সিআইডির উপ-পরিদর্শক মো. নওশাদ হোসেন ২১ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দাখিল করেন।

এ বিষয়ে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা সিআইডির উপ-পরিদর্শক মো. নওশাদ হোসেন বলেন, কান্নাকাটির আওয়াজ বাড়িতে শুনিয়ে ভুক্তভোগীর পরিবারের কাছ থেকে মোট সাত লাখ পাঁচ হাজার টাকা হাতিয়ে নেয় চক্রটি।

এদিকে সুমন ব্যাপারীকে বিদেশে পাচারের অভিযোগে তার স্ত্রী দোলন চাঁপা ২০১৯ সালের ১ জুন পল্টন থানায় বাদী হয়ে মামলা করেন। মামলায় সিআইডির উপ-পরিদর্শক সোহাগ বেগম ১৪ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দাখিল করেন।

মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা সিআইডির উপ-পরিদর্শক সোহাগ বেগম জাগো নিউজকে বলেন, মামলার চার্জশিটভুক্ত ১৪ আসামি ও অন্যান্য লোকজনসহ দোলনচাঁপার স্বামীকে বাংলাদেশ থেকে অবৈধভাবে মরক্কো হয়ে নৌপথে স্পেনে পাঠানোর প্রলোভন দেখিয়ে মরক্কোর রাবাত শহরে মুক্তিপণের জন্য আটক করে রাখে। এরপর দোলনচাঁপার কাছ থেকে মুক্তিপণের টাকা আদায় করেছে। প্রাথমিক তদন্তে আসামিদের বিরুদ্ধে ঘটনার সত্যতা পেয়েছি। তাই ১৪ আসামিকে অভিযুক্ত করে আদালতে চার্জশিট দাখিল করা হয়েছে।

ভুক্তভোগী রাকিবের বাবা মান্নান মুন্সি জাগো নিউজকে বলেন, আমার ছেলে রাকিবকে ছাড়ানোর জন্য ভিটেমাটি বিক্রি করে সাত লাখ পাঁচ হাজার টাকা দিয়েছিলাম, কিন্তু তারা ছাড়েনি। শেষ পর্যন্ত আমার ছেলে সেখান থেকে পালিয়ে অন্য জায়গায় চলে যায়। এরপর বাড়িতে ফোন করে জানায়, সে বেঁচে আছে। এখনো আমার ছেলে কোনো বৈধ কাগজপত্র পায়নি। চুরি করে কাজ করে।

তিনি বলেন, আমার সব শেষ হয়ে গেছে। যারা আমার সাজানো সংসার ও আমার ছেলের করুণ পরিণতির জন্য দায়ী, সবার বিচার চাই।

সুমন ব্যাপারীর স্ত্রী দোলন চাঁপা জাগো নিউজকে বলেন, আমার কষ্টের শেষ নেই। স্বামী মানুষের খপ্পরে পড়ে বিদেশ গেছে। সেখানে যাওয়ার পর মাঝে মধ্যে যোগাযোগ হলেও এখন কোনো যোগাযোগ নেই। এখন স্বামী ছাড়া দুই সন্তান নিয়ে টিউশনি করে সংসার চালাচ্ছি। যারা আমার স্বামীকে বিদেশে নিয়ে খারাপ পরিস্থিতির মধ্যে ফেলেছে তাদের বিচার চাই।

আসছে না রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষী, খালাস পাচ্ছে মানবপাচারের আসামিরা

মানবপাচারের মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তি ও ন্যায়বিচার ত্বরান্বিত করার লক্ষ্যে ময়মনসিংহ বাদে দেশের সাত বিভাগে মানবপাচার অপরাধ দমন ট্রাইব্যুনাল গঠনের অনুমতি দেওয়া হয়। এরপর ২০২০ সালের ৯ মার্চ ঢাকায় মানবপাচার অপরাধ দমন ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়। ট্রাইব্যুনাল গঠনের পর ২৫২টি মামলার রায় ঘোষণা করেন আদালত। এর মধ্যে খালাস পেয়েছেন ২৪৯টি মামলার আসামি।

অধিকাংশ মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষীদের অনুপস্থিতির কারণে আসামিদের খালাস দেন আদালত। এ বিষয়ে রাষ্ট্রপক্ষ বলছে, সাক্ষীদের সাক্ষ্য দিতে সমন জারি করার পরও তারা আদালতে উপস্থিত হন না।

জাগো নিউজের অনুসন্ধানে দেখা দেখা গেছে, অধিকাংশ মামলায় সাক্ষী উপস্থিত না হওয়ায় আসামিদের খালাস দেওয়া হয়েছে। এছাড়া তিনটি মামলায় পাঁচ আসামিকে সাজা দিয়েছেন আদালত। এর মধ্যে একজনের যাবজ্জীবন, দুজনের ১৪ বছর, দুজনের ১০ বছর ও একজনের সাত বছরের কারাদণ্ডের আদেশ দেওয়া হয়। বর্তমানে ঢাকার মানবপাচার ট্রাইব্যুনালে এক হাজার ২২০টি মামলা বিচারাধীন।

ব্র্যাকের অভিবাসন কর্মসূচির তথ্যানুসারে, ২০২০ সাল পর্যন্ত দেশে মানবপাচারের ছয় হাজার ১৩৪টি মামলা হয়েছে। এগুলোর মধ্যে বিভিন্ন আদালতে ২৩৩টির নিস্পত্তি হয়েছে। বিচারাধীন ৫ হাজার ৯০১টি। এর মধ্যে ৩৩টি মামলায় ৫৪ জনের বিভিন্ন মেয়াদে সাজা হয়েছে।

উচ্চ আদালতের এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ২০১৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত মানবপাচারের মোট মামলা পাঁচ হাজার ৯৯টি। এর মধ্যে চার হাজার ৮৫১টি মামলা বিচারাধীন। নিষ্পত্তি হয়েছে ১৯০টি। ৫৮টি মামলা বদলি করা হয়েছে। উচ্চ আদালতের নির্দেশে ১৩টির বিচার কার্যক্রম স্থগিত।

এ বিষয়ে ঢাকা মহানগর পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) আব্দুল্লাহ আবু জাগো নিউজকে বলেন, ‘মানবপাচার আইনের মামলাগুলো আদালতে আসার পর সাক্ষীদের সাক্ষ্য দিতে সমন পাঠানো হয়। জামিন অযোগ্য গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয় সাক্ষীদের বিরুদ্ধে। এরপরও অধিকাংশ সাক্ষী সাক্ষ্য দিতে আদালতে আসেন না। সাক্ষীদের উচিত আদালতে এসে সাক্ষ্য দেওয়া।’

আইনজীবী খালেদ হোসেন বলেন, ‘সাক্ষীর মাধ্যমেই আদালত মামলা প্রমাণ করেন। মানবপাচার আইনের অধিকাংশ মামলায় আদালতে উপস্থিত হন না সাক্ষী। তারা আদালতে না আসায় অপরাধ প্রমাণ করা সম্ভব হয় না। রাষ্ট্রপক্ষের উচিত সাক্ষীদের আদালতে উপস্থিত করানো। সাক্ষীর মাধ্যমেই ন্যায়-অন্যায় প্রমাণ হবে।’

শাস্তি বাড়লে কমবে মানবপাচার

২০১২ সালের ‘মানবপাচার প্রতিরোধ ও দমন আইনে’ সংঘবদ্ধভাবে মানবপাচারের জন্য মৃত্যুদণ্ড, যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ও সর্বনিম্ন ৭ বছরের কারাদণ্ড এবং অন্যূন পাঁচ লাখ টাকা অর্থদণ্ডের বিধান আছে। আইন অনুযায়ী আসামিদের শাস্তি নিশ্চিত হলে অপরাধ অনেকটাই কমে আসবে বলে মন্তব্য করেছেন আইন বিশেষজ্ঞরা। এজন্য মামলার বাদী ও সাক্ষীদের আরও আন্তরিক হতে হবে।

এ বিষয়ে ঢাকা মহানগর পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) আব্দুল্লাহ আবু বলেন, মানবপাচার প্রতিরোধ, দমন এবং এ অপরাধের শিকার ব্যক্তির সুরক্ষা, অধিকার বাস্তবায়ন ও নিরাপদ অভিবাসন নিশ্চিতকরণের উদ্দেশ্যে ২০১২ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি আইন প্রণীত হয়। এ আইনে মানবপাচারের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের বিধান রয়েছে। মামলা দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য গঠন করা হয়েছে মানবপাচার ট্রাইব্যুনাল। আইন অনুযায়ী আসামিদের শাস্তি নিশ্চিত হলে অপরাধ অনেকটাই কমে আসবে। আমরা রাষ্ট্রপক্ষ আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণ করতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করবো।

আইনজীবী জিএম মিজানুর রহমান বলেন, মানবপাচারের অভিযোগে করা অধিকাংশ মামলায় আসামিদের শাস্তি হয় না। আসামিদের শাস্তি নিশ্চিত হলে অপরাধ অনেকটাই কমে আসবে।

আইনজীবী খাদেমুল ইসলাম বলেন, মানবপাচার একটি দেশের অভ্যন্তরে বা এক দেশ থেকে অন্য দেশে সংঘটিত হয়। মানবপাচার বলপ্রয়োগের মাধ্যমে সংঘটিত একটি অপরাধ, যা মানুষের মুক্ত চলাচলের অধিকার হরণ করে। মানবপাচার মূলত নারী ও শিশু পাচারকেই ইঙ্গিত করে। যারা এর সঙ্গে জড়িত তাদের আইনের আওতায় এনে শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হলে অন্যরা এ ধরনের অপরাধ করতে সাহস পাবে না। এতে মানবপাচার অনেকটা কমে আসবে।

জেএ/এমএইচআর/এএ/জেআইএম/এএসএম