এবার দুর্গাপূজায় কুমিল্লায় পূজামণ্ডপে সুপরিকল্পিতভাবে ঘটনা ঘটিয়ে সাম্প্রদায়িক শক্তি যেভাবে সারাদেশে ভয়ংকর পরিবেশ সৃষ্টি করেছিল তার রেশ এখনও চলছে। এমন নগ্ন সাম্প্রদায়িকতা বাংলাদেশে খুব বেশি দেখা যায়নি। এটি প্রকাশ্য বেয়াদবি যাকে সম্পূর্ণ রুখে দিতে ব্যর্থ হলে বাংলাদেশের অস্তিত্বই থাকবে না।
Advertisement
দেশ-বিদেশ থেকে যেভাবে উস্কানি দেওয়া হল, যেভাবে পরিবেশ সহিংস করার পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হল এরপর আর ‘সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি’ নামক মিথ নিয়ে আত্মপ্রসাদের কোন সুযোগ নেই। আমরা বলতে ভালোবাসি বাংলাদেশের হিন্দু সম্প্রদায়ের পূজা উৎসব হিন্দু-মুসলমান মিলেমিশে উপভোগ করে। গত কয়েক দশকেই আমি দেখছি প্রতিমা ভাংচুরের ঘটনা। তাই বিনয়ের সঙ্গে বলছি এসব ভাবনাকে দূরে রাখাই এখন ভাল। সত্য স্বীকার করাই উত্তম।
সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির কথা বলতে গিয়ে হিন্দু-মুসলিম বিভাজনের যে বিশাল ক্ষেত্র সৃষ্টি করা হয়েছে, শান্তিতে বসবাস করে আসছে বলে আমরা যেন সেই বাস্তবতাকে অস্বীকার না করি। মনোজগতে ধর্ম বিদ্বেষ জিইয়ে রেখে মুখে সম্প্রীতির আওয়াজ তুললে প্রকারান্তরে মৌলবাদী শক্তির হাতকেই শক্তিশালী করা হয়।
এ কথা সত্য যে, স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে কোনো সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়নি। কিন্তু যা হয়ে চলেছে তা হলো একতরফা সন্ত্রাস। সংখ্যাগুরুদের একতরফা আক্রমণ সংখ্যালঘুদের ওপর। কোনো পাল্টা আক্রমণ বা প্রতিরোধ নয়, শুধুই মলম দিয়ে ক্ষতস্থান শুকানোর চেষ্টা। সমস্যা হলো যাদের আমরা উদারনৈতিক রাজনৈতিক দল বলে জানি, তারাও ভোট ব্যাংকের হিসেব কষে কষে, রাজনৈতিক চর্চা বাদ দিয়ে ক্ষমতার চর্চা করে করে সাম্প্রদায়িক বিভেদের রাজনীতিকেই উপজীব্য করে তুলেছে। প্রতিক্রিয়াশীলতার দীর্ঘ ছায়ার নিচে থাকার অভ্যাস করে ফেলেছি আমরা এবং এখন শুধু সংখ্যালঘু নয়, যে কোন বিবেকবান, সংবেদনশীল ও উদার মানুষ মৌলবাদের ধারালো চাপাতির নিচে নিজেকে নিয়ত আবিষ্কার করছে।
Advertisement
নবমীর দিন বৃহস্পতিবার প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, কিছু মানুষের মধ্যে দুষ্ট বুদ্ধিটা আছে, যখন একটা জিনিস খুব সুন্দরভাবে চলছে তখন সেটা নষ্ট করা; বাংলাদেশ যখন উন্নয়নের পথে দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে সেই সময় এই যাত্রাটাকে ব্যাহত করা এবং দেশের মধ্যে সমস্যা তৈরি করা। হ্যাঁ উন্নয়ন হচ্ছে, মাথা পিছু আয় বাড়ছে, প্রবৃদ্ধি বাড়ছে, কিন্তু সমান্তরালে চাপাতিওয়ালাদের দৌরাত্ম বাড়ছে।
নিজে বাঁচব, অন্যকেউ বাঁচতে দিব – এমন বহুত্বাদী দর্শন আমাদের মাঝে আসলে নেই। আমরা লিখতে চাই না, বলতে অপারগতা প্রকাশ করি সাম্প্রদায়িক সহিংসতা নিয়ে। কিন্তু বাস্তবতা হলো বাংলাদেশে হাঙ্গামার ইতিহাস সুপ্রাচীন।
আমাদের কত কত সমস্যা। পানি ও বিদ্যুতের সমস্যা, দ্রব্যমূল্য বাড়ার সমস্যা, শিক্ষার সমস্যা, স্বাস্থ্যের সমস্যা। এগুলো নিয়ে আমরা কথা বলি কম। কিন্তু সংখ্যালঘুদের ওপর হামলে পড়ার জন্য মানুষকে তাতিয়ে দিতে সদা প্রস্তুত আমরা। রাজনীতির তালিবানিকরণ কবে শুরু হয়েছে তা দিন তারিখ দিয়ে বলা যাবে না, তবে তা দিন দিন বিকশিত হচ্ছে। ভোট মেরুকরণের জন্য কোন রাজনীতিটা না করছি আমরা।
সুফিবাদের ইসলামে যে স্বাাধীন যুক্তিবাদী চিন্তার একটা ধারা বরাবর মুসলমানদের মধ্যে ছিল সেটা আজ অস্তমিত। কট্টরবাদীদের দাপটে উদারপন্থীরা আজ বিলীন হয়ে গেছে। এ কারণেই সাম্প্রদায়িক হাঙ্গামা হচ্ছে। সমাজের ভেতর সাম্প্রদায়িক সত্তার বিরোধ কমানোর কোন দৃশ্যমার প্রচেষ্টা নেই, আছে কেবল হাঙ্গামা সৃষ্টিকারীদের তোয়াজ করার নীতি। সাম্প্রদায়িক শক্তিকে তোষণ করার যে রাজনীতি তার প্রতিক্রিয়ায় সংখ্যাগরিষ্ঠদের সাম্প্রদায়িকতা মাথাচাড়া দিচ্ছে।
Advertisement
বঙ্গবন্ধু পরমতসহিষ্ণুতার যে দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন তা আর নেই। আমরা বলি ধর্ম বিষয়ে মুসলমানের উদারতার তুলনা জগতে কোথাও নেই। কিন্তু আমাদের বাস্তব আচরণ ভিন্ন কথা বলছে। কিন্তু বসে থাকলে তো চলবে না। দেশজুড়ে যে সাম্প্রদায়িকতার অশুভ শক্তি মাথাচাড়া দিয়েছে, তার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর জন্য বিষয়টির সঠিক অনুশীলন উপলব্ধি প্রয়োজন। একের পর এক মুক্তমনা ব্লগার মৌলবাদীদের হাতে নিহত হয়েছেন, আমরা কোন ব্যবস্থা নেই নি। এখন নিতে হবে।
উগ্রবাদীরা যে ধর্মেরই হোক, তাদের মাঝে মিল অনেক। বাংলাদেশের উন্নয়ন যদি আমাদের লক্ষ্য হয়, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের বিকাশ যদি আমাদের আকাঙ্ক্ষা হয়, তা হলে সাম্প্রদায়িকতাকে আমাদের দূরে সরিয়ে রেখে এগোতে হবে। রাজনৈতিক আদর্শের যত বিভেদ থাকুক, সবাই এক বাক্যে বলুক সাম্প্রদায়িক বিভেদের রাজনীতি চলবে না। এ দল বনাম ও দল, মুসলমান বনাম হিন্দু – এরকম সব রাজনৈতিক এবং ধর্মীয় মেরুকরণের বাইরে আমরা কি এক মুহূর্তের জন্য বাঙালির সত্ত্বাকে নিয়ে ভাবতে পারি না?
লেখক : প্রধান সম্পাদক, জিটিভি।
এইচআর/জিকেএস