শুরুতেই শারদীয় দুর্গাপূজার শুভেচ্ছা জানাচ্ছি জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলকে। কারণ ধর্ম যার যার ঠিকই তবে উৎসব তো সবারই। গত বছরের মতো এ বছরও বাস্তবতার নিরিখে করোনাকালে স্বাস্থ্যবিধি মেনে হিন্দু সম্প্রদায়ের সবচেয়ে বড় এ পূজা অনুষ্ঠান আয়োজন ও উদযাপন বেশ কিছুটা চ্যালেঞ্জিং হলেও তা প্রায় ভালোই ভালোই চলেছে। তবে, পূজা শেষ হয়ে গেলেও এর শিক্ষাটা যদি সকলের হৃদয়ে প্রোথিত হতে পারে তবে সেটাই হবে দুর্গাপূজার আসল শিক্ষা। দুর্গাপূজার শিক্ষাটা কি এবং কেমন-সেদিকে লেখার পরের অংশে আলোকপাত করে আবারও আশা করব আমরা যেন সে শিক্ষা ভুলে না গিয়ে হৃদয়ে ধারণ করতে পারি। বাস্তবে কাজে লাগাতে পারি।
Advertisement
শিউলি ফুলের সুগন্ধের সাথে ধূপধুনোর এক চমৎকার যুগলের উপলক্ষ্য হয়ে প্রতি বছর শরতে দেবী দুর্গা আসেন মর্তে। দেবীর এ আগমন সনাতন ধর্মাবলম্বীদের কাছে অসীম আনন্দের বার্তা নিয়ে আসে। ভক্তকুল তাদের হৃদয় উৎসারিত আবেগ দিয়ে দেবী দুর্গার এ "অকালবোধন"কে স্বাগত জানান। পরম্পরায় পূজার এ আনুষ্ঠানিকতার সাথে সাথে দেবীর চরণে নিজের ভেতরকার দানবীয় শক্তিকে সমর্পিত করে অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করার এক অসীম প্রেরণাও লাভ করেন।
ইতিহাস বলছে, ত্রেতাযুগে রাজা রামচন্দ্র বনবাস কালে রাক্ষস শিরোমনি রাবন কর্তৃক স্ত্রী সীতা অপহৃত হলে তার কবল থেকে তাকে উদ্ধারের জন্য দেবী দুর্গার পূজা করেছিলেন এই শরৎকালে। প্রকৃতপক্ষে বসন্তকালে দেবী দুর্গার পূজার বিধান থাকলেও শরৎকালে দেবীর অনুষ্ঠিত হওয়ায় দেবীর এই আবাহনকে "অকালবোধন" বলা হয়ে থাকে। দেবীর ঐতিহাসিক সেই বিষয়কে ধারণ করেই সনাতন ধর্মাবলম্বীদের কাছ শরৎকালেই দেবী দুর্গার পূজিত হওয়ার প্রচলন শুরু হয়।পরিচিত পায় সর্বজনীন শারদীয় দুর্গোৎসব হিসেবে।
যাই হোক,যদিও তারও পেছনের রয়েছে প্রায় একশ বছরব্যাপী দেবতা ও অসুরদের যুদ্ধের ইতিবৃত্ত। সেই যুদ্ধে পরাজিত হয়ে দেবতারা স্বর্গলোক থেকে বিতাড়িত হন। এদিকে সেখানে যখন অসুর রাজত্ব শুরু হয় দেবতারা তখন ছদ্মবেশ ধারণ করে সময় অতিবাহিত করছিলেন। তারই এক পর্যায়ে দেবতারা শরণাপন্ন হন ব্রহ্মার। পরে সকলে মিলে উপস্থিত হন শিব ও নারায়ণের সমীপে। অসুররাজ মহিষাসুরের অত্যাচার কাহিনী শুনে তারা উভয়েই অত্যন্ত ক্রোধান্বিত হয়ে ওঠেন। সেই ক্রোধরই পুঞ্জীভূত শক্তির প্রকাশে এক নারীরূপের সৃষ্টি হয় এবং সেই নারী শক্তির কাছেই পরিশেষে প্রতাপশালী মহিষাসুর বধ হন। অর্থাৎ নারী শক্তির জাগ্রত উপাখ্যানই দেবী দুর্গার সৃষ্টি ইতিহাস বলে খ্যাত। অশুভ, অত্যাচারী, নিপীড়নকারী শক্তির বিরুদ্ধে শুভ, নিপীড়িত, নির্যাতিত শক্তির সম্মিলিত প্রয়াসযুক্ত বিজয়ের ইতিহাসই বস্তুত মনে করিয়ে দেয় এই দুর্গোৎসব।
Advertisement
দুর্গাপূজার এটা যদি হয় ভাবগত এবং ঐতিহাসিক তাৎপর্য তাহলে এর একটা বাস্তব ও বস্তুগত তাৎপর্যও আমাদের সামনে ফুটে ওঠে। একজন নারী যাকে আমরা কেবলই কোমল হৃদয়, প্রতিবাদহীন দেখতে অভ্যস্থ তার হাতে চরম প্রতিক্রিয়াশীল, অশুভ শক্তির পরাজয় বস্তুতপক্ষে নারীশক্তির জাগরণের ঐতিহাসিক ইঙ্গিত বহন করে।
বর্তমানের এই বিরুদ্ধ সময় করোনাকালেও যখন নারীর প্রতি সহিংসতা বাড়ছে নানা মাত্রায়, নারী ঘরে-বাইরে নিরাপত্তাহীন হয়ে পড়ছে- তখন দেবী দুর্গার পূজা অত্যন্ত সময়োপযোগী। নারীকে সম্মান করার শিক্ষা যেমন এতে প্রতিভাত হয়ে ওঠে তেমনিভাবে নারী নিজেই যে এক প্রতিবাদী চরিত্র সেটারও স্বীকৃতি মিলে অতি সহজেই। বাস্তবতার নিরিখে ভাবগত ইতিহাসের পাশাপাশি তাই বস্তুগত স্বীকৃতিও নারীর জন্য অত্যন্ত গুরুত্ববাহী হয়ে ওঠে এ পূজার মাধ্যমে।
পাশাপাশি পূজাকেন্দ্রিক ৫ দিনব্যাপী যে আনন্দযজ্ঞ চলে, পারস্পারিক সৌহার্দ্য এবং সৌভাতৃত্ববোধের যে অমিয় ফল্গুধারা বহমান হয় সেটাও দেশ ও বিশ্ব পরিস্থিতিতে বেশ খানিকটা শান্তির পরশ বুলিয়ে দেয়। অন্ত এবং আন্তঃধর্মীয় ভালোবাসা, শান্তি এবং কল্যাণময়তাকে উপরোক্ত বোধ পরম আদরে লালনপালন করে থাকে। সাম্প্রদায়িক বিষের বিরুদ্ধেও যা চমৎকার "এন্টিডট" হিসেবে কাজ করে থাকে। এ কারণেই বলা হয়ে থাকে " ধর্ম যার যার, উৎসব সবার"।
উৎসবকেন্দ্রিকতায় মানুষে মানুষে যে মিলনমেলা এবং ভাববিনিময় চলে সেটাই শান্তিপূর্ণ, প্রগতিশীল, অসাম্প্রদায়িক সমাজ বিনির্মাণে কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারে। উৎসবের উপলক্ষ দিয়ে এমন সমাজ বিনির্মাণ করা যতটা সহজ অন্য কোনোভাবে সেটা হয়ত সম্ভবপর নয়।
Advertisement
পরিশেষে, আবারও শারদীয় শুভেচ্ছা জানিয়ে সবার মঙ্গলময় জীবন কামনা করছি। করোনাকালকে পেছনে ফেলে মঙ্গলময় হয়ে উঠুক সবার জীবন। শান্তিময় হয়ে উঠুক পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র তথা পুরো বিশ্ব।
লেখক : চিকিৎসক ও শিক্ষক। সহযোগী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগ, এনাম মেডিকেল কলেজ।
এইচআর/এএসএম