সারাদেশের হাসপাতালগুলোতেই রয়েছে চিকিৎসক সংকট। নতুন পদ সৃষ্টি হচ্ছে না, শূন্য রয়েছে অনেক পদ। করোনাকালে এই সংকট বেড়েছে কয়েকগুণ। মহামারি চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে স্বাস্থ্যখাতের এই দূরবস্থা। সংকট নিয়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে হাসপাতালগুলো। তবুও নির্বিকার কর্তৃপক্ষ।
Advertisement
জানা যায়, স্বাস্থ্যখাতের এই সংকটের পরেও ৪২তম বিসিএসে উত্তীর্ণ প্রায় দুই হাজার চিকিৎসক নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে না। পিএসসি বলছে, পদ স্বল্পতার কারণে নিয়োগ দেওয়া যাচ্ছে না। অথচ স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলছেন, ১১ হাজার পদ শূন্য। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় বলছে, ‘তাদের কাছে সুনির্দিষ্ট তথ্য নেই।’
মুজিববর্ষে স্বাস্থ্যখাতকে এগিয়ে নেওয়ার লক্ষ্যে ও করোনা পরিস্থিতি মোকাবিলায় বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশন ৩০ নভেম্বর, ২০২০ তারিখে প্রকাশিত বিজ্ঞপ্তিতে দুই হাজার চিকিৎসককে ‘সহকারী সার্জন’ পদে নিয়োগের কথা বলা হয়। পরে ৩০ জুন, ২০২১ তারিখে অনুষ্ঠিত স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সভায় আরও চার হাজার চিকিৎসক নিয়োগের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। পিএসসির মোট ছয় হাজার চিকিৎসক নিয়োগের এই সিদ্ধান্ত থাকলেও অদৃশ্য কারণে পরে ৭ সেপ্টেম্বর, ২০২১ তারিখে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের নবনিয়োগ শাখার এক বিজ্ঞপ্তিতে চার হাজারের পরিবর্তে দুই হাজার অতিরিক্ত চিকিৎসক নেওয়ার কথা জানানো হয়। ৪২তম বিসিএস (বিশেষ) পরীক্ষার চূড়ান্ত ফল অনুযায়ী মোট পাঁচ হাজার ৯১৯ জন উত্তীর্ণ হলেও পিএসসি পদ স্বল্পতার কারণে চার হাজার জনকে সহকারী সার্জন পদে নিয়োগের সুপারিশ করে। অবশিষ্ট ১৯শ ১৯ জনকে পদ স্বল্পতার কারণে নিয়োগে সুপারিশ করেনি।
সব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে দপ্তরগুলোর সমন্বয়হীনতা ফুটে উঠেছে। স্বাস্থ্যের তথ্য জানে না সুপিরিয়র মন্ত্রণালয় জনপ্রশাসন। চিকিৎসকদের অধিকার নিয়ে কাজ করা বিএমএ-ও দেখছে না দুই মন্ত্রণালয়ের দায়। তারা দুষছে পিএসসিকে।
Advertisement
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, ডাক্তার ও জনসংখ্যার অনুপাত ১: ১০০০ থাকতে হয়। সেখানে বাংলাদেশে আছে ১: ১৭২৪।
জান যায়, ৩৮তম বিসিএস থেকে ২৯০ জনকে নিয়োগ দেওয়া হয়। ৪২তম বিসিএস (বিশেষ) থেকে চার হাজার চিকিৎসক নিয়োগের অপেক্ষায় আছেন। ৪০তম বিসিএস থেকে ২৬০ জন এবং ৪১তম বিসিএস থেকে আরও ১১০ জন চিকিৎসকের শূন্যপদ পূরণের কার্যক্রম চলমান। এরপরও শূন্য রয়ে গেছে ৬ হাজার ৭০৪ পদ। তবে কোভিড পরিস্থিতির কারণে দীর্ঘদিন স্বাভাবিক কার্যক্রম বন্ধ থাকায় বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশন পাঁচটি বিসিএস পরীক্ষা ও সুপারিশসংক্রান্ত জটে হিমশিম খাচ্ছে বিধায় আগামী ২-৪ বছরের আগে এসব শূন্যপদ পূরণ অসম্ভব।
সব মিলিয়ে ৪২তম বিসিএস (বিশেষ) এর চার হাজার জন চিকিৎসক নিয়োগ পাওয়ার পরেও বর্তমানে দেশের সরকারি চিকিৎসা সেবাদান কেন্দ্রগুলোতে ছয় হাজার ৭০৪টি পদ শূন্য থাকবে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেমের এইচআরআইএস রিপোর্টের (গত ৫ সেপ্টেম্বর, ২০২১ তারিখের) তথ্যানুযায়ী, শুধু স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের আওতাধীন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানেই চিকিৎসকের পদ শূন্য রয়েছে পাঁচ হাজার ৮৪৮টি। এছাড়া, বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের তথ্যানুযায়ী, করোনায় এ পর্যন্ত ১৮৬ জন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক মারা গেছেন। ফলে, কিছুটা হলেও দেশে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের সংকট তৈরি হয়েছে। হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসক সংকটের কারণে স্বাস্থ্য সেবাদান কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে।
Advertisement
৪২তম বিসিএস (বিশেষ) হতে উত্তীর্ণ অপেক্ষমাণ এই ১৯শ ১৯ জন চিকিৎসককে নিয়োগ দেওয়া হলে এই সমস্যা ও সম্ভাব্য সংকট অনেকাংশে লাঘব হবে বলে মনে করেন চিকিৎসকরা।
তারা বলছেন, চিকিৎসকদের জন্য আগের প্রতিটি বিশেষ বিসিএসে ছয় হাজারের বেশি নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। ৩৯তম বিসিএস (বিশেষ) এ সহকারী সার্জন হয়েছেন ছয় হাজার ২০৩ জন আর ৩৩তম বিসিএস এ সহকারী সার্জন হয়েছেন ছয় হাজার ৩৪২ জন। তাহলে এই মুজিববর্ষ ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে ছয় হাজারের বেশি চিকিৎসক নিয়োগ কেন নয়?
তাদের দাবি, ২০২১ সালে এরই মধ্যেই চার হাজার জন চিকিৎসককে ‘সহকারী সার্জন’ ও ৪০৯ জন অ্যানেসথেশিওলজিস্টকে ‘জুনিয়র কনসালট্যান্ট’ পদে নিয়োগের জন্য সুপারিশ করা হয়েছে। ৪২তম বিসিএস (বিশেষ) এর সুপারিশ বঞ্চিত ১৯শ ১৯ জনকে নিয়োগ দেওয়া হলে ২০২১ সালে মোট চিকিৎসক নিয়োগের সংখ্যা হবে ছয় হাজার ৩২৮ জন, যা নিঃসন্দেহে স্বাস্থ্যখাতে সংকট ঘুঁচিয়ে মুজিববর্ষ ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীর শোভা বর্ধন করবে।
এ বিষয়ে পিএসসির চেয়ারম্যান সোহরাব হোসাইন জাগো নিউজকে বলেন, সরকার যদি চায় তখন সুপারিশবঞ্চিতদের নিয়োগের বিষয়টি বিবেচনা করা যাবে। আমাদের যা বলা হয়, যা চাওয়া হয়, সেই সংখ্যা নিয়োগ করার জন্য বিজ্ঞাপন দেই, পরীক্ষা নেই ও সেই সংখ্যাই সুপারিশ করি। চিকিৎসকদের বেলায়ও আমাদের কাছে যা চাওয়া হয়েছে সুপারিশ করেছি।
সরকার চাহিদা দেবে কি না বা এদের নিয়োগ দেওয়ার সুযোগ আছে কি না, এমন প্রশ্নে জবাবে জনপ্রশাসন সচিব কে এম আলী আজম জাগো নিউজকে বলেন, এ বিষয়টি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় বলতে পারবে। এখন পর্যন্ত এ বিষয়ে আমাদের কাছে কংক্রিট তথ্য আসেনি। এর কোনো অফিসিয়াল বিষয় আমাদের কাছে নেই।
এ বিষয়ে চিকিৎসকদের সংগঠন বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন (বিএমএ) মহাসচিব অধ্যাপক ডা. ইহতেশামুল হক চৌধুরী পিএসসিকে দোষারোপ করছেন। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, পিএসসি বলছে, উত্তীর্ণ কিন্তু পদ নেই। এটাই ঝামেলা সৃষ্টি করেছে। কারণ পিএসসিকে তো বলা হয়েছে, আমার এতজন পদের বিপরীতে আপনি লোক নেন। বলা হয়েছে, চার হাজার নিতে, তাদের তো বলা হয়নি ছয় হাজার নিতে। ঝামেলাটা এখানেই। এগুলো তো প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষা। টপ মার্ক দেখে আপনি চার হাজার নিয়ে নেবেন, শেষ। আপনি বললেন, ছয় হাজার উত্তীর্ণ, চার হাজার নিলাম আর বাকিগুলো ওয়েটিং। এটাই তো সমস্যা।
এ সংকট কাটাতে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন বিসিএস উত্তীর্ণ তবে নিয়োগবঞ্চিত চিকিৎসকরা। তাদের দলনেতা ডা. আশরাফুল ইসলাম রবিন জাগো নিউজকে বলেন, আসলে আমাদের কর্মই সেবামূলক। যার কারণে দাবিটি মানুষের কল্যাণেই। আমাদের নিয়োগ দিলে শুধু আমরা লাভবান হবো তা কিন্তু নয়, দেশের চিকিৎসক সংকটও কিছুটা কাটবে।
তিনি বলেন, আমাদের নিয়োগ দিলে করোনা মহামারির মতো যে কোনো সংকটে প্রাণপণ সেবা দেওয়া চেষ্টা করবো। এক্ষেত্রে আমরা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একটি মাত্র সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় আছি। আমরা তার কাছে আবেদনও করেছি।
চিকিৎসাখাতের এই সংকট নিয়ে আশার কথা জানিয়েছেন স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের (স্বাচিপ) মহাসচিব অধ্যাপক ডা. মো. আব্দুল আজিজ। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, সারাদেশের নতুন মেডিকেলগুলোতে পদ সৃষ্টি হয়নি। শিক্ষকশূন্যতা, প্রমোশন হচ্ছে না, পদ ফাঁকা, নতুন পদ সৃষ্টি হচ্ছে না, এগুলো নিয়ে আমরা হোম ওয়ার্ক করছি।
এসইউজে/এএ/এমএস