খেলাধুলা

বাংলাদেশের নটিংহ্যাম ট্র্যাজেডি

টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের দ্বিতীয় সংস্করণে গ্রুপ রাউন্ডে বাংলাদেশের সব ম্যাচ ছিল নটিংহ্যামে। তা জেনে যাওয়ায় নিজ থেকেই চেনা-জানা ক্রীড়া সাংবাদিকদের ফোন করেছেন বিটিভির সাবেক ক্রীড়া সাংবাদিক ইকবাল। নটিংহ্যামে ইসলামিক কালচারাল সেন্টারের লাইব্রেরিয়ান তখন ইকবাল।

Advertisement

বাংলাদেশ থেকে টি-২০ বিশ্বকাপ কভার করতে আসা সাংবাদিকদের আবাসন ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। এমনকি লেপ, কাঁথা, কম্বল- যা কিছু দরকার, তার ব্যবস্থাও। মোঘল-ই-আজম নামের রেস্টুরেন্টে জনপ্রতি ১০ পাউন্ডে রাতের ডিনারে মজাদার সেট মেন্যু- হোটেল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সেই দফা-রফাও করেছেন ইকবাল।

এই রোদ, এই মেঘ, এই বৃষ্টি- বৃষ্টি মানেই কনকনে ঠান্ডা- জুনে ইংলিশ সামারের এই আবহাওয়ার সঙ্গে মানিয়ে নেয়াটা সহজ নয়। তারপরও ইকবালের আতিথেয়তা, হোটেল মোঘল-ই-আজম এ দল বেধে রাতের ডিনারে অন্য এক অনুভুতি!

রাতের ডিনার খেতে যেয়ে আশরাফুল, মাশরাফি, সাকিব, মুশফিকদের সঙ্গে হাই-হ্যালোর ফাঁকে একটা-দুইটা বাক্য পেলে তা লেখার উপাত্ত হিসেবে নেয়ার সুযোগটাও পেয়েছিলাম আমরা। প্রবাসী বাংলাদেশী মালিকানাধীন এই রেস্টুরেন্টেই রাতের ডিনারে সামছুর রহমান শুভ’র ২১তম জন্মদিন উদযাপিত হয়েছে। কেক কেটে সামছুর রহমান শুভ’র সেই জন্মদিন পালন অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন সে সময়ে বাংলাদেশের যুবও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী আহাদ আলী সরকার। তিনিই সামছুর রহমান শুভ’র মুখে তুলে দিয়েছেন কেক।

Advertisement

বাংলাদেশ-ভারতের ম্যাচের আগে ভারত ক্রিকেট দলে গৃহদাহ-এর খবর বেরিয়েছে মিডিয়ায়। ধোনি ভার্সেস শেবাগের বিপরীতধর্মী অবস্থানে মনস্তাত্বিকভাবে বাংলাদেশ দলের এগিয়ে থাকার কথা। ম্যাচ পূর্ব প্রথাগত সংবাদ সম্মেলনে দু’দলের অধিনায়ক মিডিয়ার প্রশ্নের উত্তর দিবেন- এটাই স্বাভাবিক।

অথচ, অধিনায়ক আশরাফুলকে নিয়ে বাংলাদেশ কোচ জেমি সিডন্স সম্মেলনে হাজিরা দিলেও প্রচলিত এই সংবাদ সম্মেলনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়েছে ভারতীয় দল। মিডিয়াকে কিছুক্ষণ অপেক্ষায় রেখে সংবাদ সম্মেলন মঞ্চে পুরো টিম ইন্ডিয়াকে নিয়ে হাজির মহেন্দ্র সিং ধোনি! হাতে তার লিখিত বক্তব্য। দলটিতে যে ধরেনি ভাঙন, পুরো দলটিই একতাবদ্ধ, তা বোঝাতে ধোনির এই অভিনবত্ব!

ভারতীয় মিডিয়ার ওই খবরে তাদেরকে এড়িয়ে চলতে এ কৌশল অবলম্বন করেছেন তিনি। লিখিত বক্তব্যটা সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত মিডিয়াকে বিতরণ করেছেন ভারতের মিডিয়া ম্যানেজার। এই লিখিত বক্তব্যের বাইরে কোনো প্রশ্ন করা যাবে না, ম্যাচ পূর্ব সংবাদ সম্মেলনে এটাই তার শর্ত।

এক পৃষ্ঠার সেই লিখিত বক্তব্যের চৌম্বক অংশটা ছিল এরকম- আমরা টোয়েন্টি-২০ বিশ্বকাপের প্রস্তুতি নিয়েছি একতাবদ্ধ দল হিসেবে। বর্তমানে দলের টিম স্পিরিট অতীতে কখনোই দেখা যায়নি। মাঠে এবং মাঠের বাইরে সবাই সবার সহায়তা করছে। শেবাগ এবং আমাকে নিয়ে যা বলা হয়েছে, তা নিছকই এক গুজব। মিডিয়ার এ ধরণের প্রচারণা দয়িত্বজ্ঞানহীনতার পর্যায়ে পড়ে। ভক্ত এবং সমর্থকদের বলতে চাই, আমরা দারুণ আত্মবিশ্বাসী এবং একতাবদ্ধ দল, যে ধারাবাহিকতা শেষ পর্যন্ত বজায় রাখতে চাই। এই টুর্নামেন্ট চলাকালে সমর্থকদের কাছ থেকে অব্যহত সমর্থনই আশা করছি।’

Advertisement

নটিংহ্যামের দিকে শুধু বাংলাদেশ ক্রিকেট সমর্থকরাই নয়, ২০০৯ সালে অনুষ্ঠিত টি-২০ বিশ্বকাপে ইংল্যান্ডে বসবাসরত প্রবাসী বাংলাদেশীদেরও রাখতে হয়েছে চোখ। ২০০৭ বিশ্বকাপে ত্রিনিদাদে ভারতকে হারিয়ে, তাদেরকে টুর্নামেন্ট থেকে বিদায় করার পর আইসিসির আর একটি মেগা আসরে ভারতের মুখোমুখি বাংলাদেশ।

সেই সুখস্মৃতির পূণরাবৃত্তি করবে বাংলাদেশ দল, এমন স্বপ্ন দেখেছে সে সময়ে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি)। স্বপ্ন পূরণে নটিংহ্যামে সবার আগে ক্রিকেট দলকে পাঠিয়েছে বিসিবি। টুর্নামেন্ট পূর্ব আইসিসির নির্ধারিত ২টি ওয়ার্মআপ ম্যাচ ছাড়াও বাড়তি তিনটি অনুশীলন ম্যাচ খেলতে পেরেছে বাংলাদেশ।

‘ এ’ গ্রুপে বাংলাদেশের প্রতিপক্ষ ভারত, আয়ারল্যান্ড। এই গ্রুপ থেকে রানার্সআপ হলেও সুপার এইটের টিকিট পাওয়া যাবে। অথচ, বাংলাদেশের লক্ষ্যটা ছিল ভারতকে হারিয়ে সুপার এইট নিশ্চিত করা। নটিংহামে পা রেখে সে লক্ষ্যের কথাই জানিয়েছিলেন আশরাফুল।

২০০৭ সালে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের অভিষেক আসরের ট্রফি জিতেছে ভারত, ২০০৯ সালে অনুষ্ঠিত টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের প্রাক্কালে আইসিসি টি-টোয়েন্টি র‌্যাংঙ্কিংয়ে নাম্বার ওয়ান ধোনির দল। তা আমলেই আনেনি আশরাফুলরা।

ম্যাচের শুরুতেই একাদশ গঠনে ভুল করেছে বাংলাদেশ টিম ম্যানেজমেন্ট। টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপকে সামনে রেখে ইংল্যান্ডে যে পাঁচটি টি-টোয়েন্টি অনুশীলন ম্যাচ খেলেছে বাংলাদেশ দল, তার একটিতেও একাদশে ছিলেন না শাহাদাত হোসেন রাজিব।

অথচ, তাকেই খেলানো হয়েছে টি-টোয়েন্টি বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন ভারতের বিপক্ষে। প্রথম ২ ওভারের স্পেলটা ভালই ছিল অফ স্পিনার নাইম ইসলামের (২-০-১৩-২)। তাই বলে ডেথ ওভারে তাকে আনতে হবে কেন? ১৭তম ওভারে নাইম ইসলামের হাতে বল তুলে দিয়ে ১৯ রান খরচায় সেই মাশুলই দিয়েছেন আশরাফুলরা। স্লগের ৩০ বলে ৬৭ রান খরচাও একটু বেশিই মনে হয়েছে।

২০০৭ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ হিরো বানিয়েছে যুবরাজকে। স্টুয়ার্ট ব্রডকে পরপর ৬ বলে ছয় ছক্কায় মাতিয়েছেন। সেই যুবরাজ সিং বাংলাদেশের বিপক্ষে স্লগে তুলেছেন ঝড়। উইকেটে ছিলেন মাত্র ১২ মিনিট। ১৮ বলে ৩ চার, ৪ ছক্কায় ৪১ রানের ইনিংসে ব্যবধানটা গড়ে দিয়েছেন তিনিই।

ভারতের ৫ উইকেটে করা ১৮০ রানের জবাব দিতে নেমে জুনায়েদ সিদ্দিকী ধোনিদের আঁতকে দিয়েছিলেন। ২২ বলে ২ চার, ৩ ছক্কায় ৪১ রানের সেই ইনিংসটির পাশে দ্বিতীয় কারো নাম বলতে হলে তিনি হবেন নাইম ইসলাম।

১৯তম ওভারে ইরফান পাঠানকে লং অফের উপর দিয়ে একটি এবং ২০তম ওভারে ইশান্ত শর্মাকে লং অনের উপর দিয়ে ২টি ছক্কায় বুকের পাটাটা দেখিয়েছেন তিনি। ঘরোয়া ক্রিকেটে যে ছেলেটি ৬ বলে ছয় ছক্কা মেরেছেন, সেই নাইম ইসলামকে কি না ৯ নম্বরে নামিয়ে দেয়া হলো? ১৫তম ওভার পর্যন্ত সমানতালে লড়ে শেষ ৫ ওভারেই তৈরি হলো ম্যাচটিতে ব্যবধান। বাংলাদেশ হেরে গেল ২৫ রানে।

২০০৭ সালে অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপে ভারত, দক্ষিণ আফ্রিকাকে হারিয়ে শেষটা ছিল হতাশার। বারবাডোজে আইসিসির সহযোগী সদস্য আয়ারল্যান্ডের কাছে হেরে সেই বিশ্বকাপ মিশন শেষ করেছে বাংলাদেশ। ঘরের মাঠে আয়ারল্যান্ডকে ৩-০ তে হোয়াইট ওয়াশ করে জবাবটা দিতে পেরেছে টাইগাররা।

আইসিসির মেগা ইভেন্টে দ্বিতীয় মোকাবেলায় সেই আয়ারল্যান্ডের কাছেই বাংলাদেশ খেয়েছে হোঁচট। হেরে গেছে ৬ উইকেটে। পেস বোলার জনস্টনের কাছেই (৪-০-২০-৩) করেছে অসহায় আত্মসমর্পণ। সুপার এইট-এ ওঠার জন্য দুই দলের কাছেই ছিল ম্যাচটি ‘ডু অর ডাই’। বাংলাদেশ দলের অনুশীলনে সবার চোখ ছিল আশরাফুলের দিকে। ব্যাটিং প্র্যাকটিসে লেট কাটকে দিয়েছেন তিনি গুরুত্ব।

ব্যাপারটা মোটেও ভাল লাগেনি মিডিয়ার। ম্যাচেও একই কাজটিই করেছেন আশরাফুল! পেস বোলার জনস্টনকে লেট কাট করতে যেয়ে স্লিপে ক্যাচ দিয়েছেন (১১ বলে ১৪)! তার এই আত্মহত্যায় স্কোরটা বড় হতে পারেনি। থেমেছে বাংলাদেশ ৮ উইকেটে ১৩৭ রানে। যে স্কোরে টেল এন্ডার মাশরাফির অবদান ১৬ বলে ৩৩ নট আউট!

বোলিংটাও করেছেন দারুণ (৪-০-৩০-২)। বাংলাদেশের অভিষেক টি-টোয়েন্টি ম্যাচের ম্যান অব দ্য ম্যাচকে হতাশায় ডোবানোর জন্য দায়ী বাংলাদেশের মিডল অর্ডাররা। ৬ষ্ঠ থেকে ১৫তম- এই ১০ ওভারে ৫০ রানের বেশি যোগ করতে পারেনি বাংলাদেশ মিডল অর্ডার ব্যাটসম্যানদের বড্ড বেশি সতর্ক ব্যাটিংয়ে।

আয়ারল্যান্ডের কাছে হেরে বাংলাদেশের টি-২০ বিশ্বকাপ মিশন শেষ হয়েছে। স্বপ্নভঙ্গের বেদনায় কাতর বাংলাদেশ। বাংলাদেশ ব্যাটসম্যানদের আত্মাহুতি দেখে ভিষণ চটেছেন হেড কোচ সিডন্স। ম্যাচ উত্তর সংবাদ সম্মেলনে বলতে বাধ্য হয়েছেন-‘ এসব ভুল নিয়ে অনেক কথা হয়েছে; কিন্তু তারা কথা শুনছে না। তাদেরকে আগে কথা শুনতে হবে। তা না হলে ভবিষ্যতে আরও ভুল হবে।’

টি-২০ বিশ্বকাপে বাংলাদেশ দলের ব্যর্থতায় দেশবাসীর কাছে ক্ষমা পর্যন্ত চেয়েছেন সিডন্স। একদিন পর গণমাধ্যমকে দেয়া সাক্ষাতকারে বাংলাদেশের সমর্থকদের কাছে ক্ষমা চেয়েছেন আশরাফুল।

গ্রুপ রাউন্ড থেকে বাংলাদেশ বিদায় নেয়ার পর একটা ভারতীয় রেস্টুরেন্টে রাতের খাবারের সময় ভারত পেস বোলার ইরফান পাঠানের সঙ্গে মাশরাফির দেখা হতেই পাঠানের প্রশ্ন- ‘ কি ব্যাপার বলতো? ভারতকে হারিয়ে সুপার এইট নিশ্চিত করতে চাও, এমন টার্গেট করে তোমরা তো নিজেরাই নিজেদের উপর চাপটা নিলে? আয়ারল্যান্ডকে হারালেই সুপার এইটে উঠবে, এটাই তো তোমাদের টার্গেট হওয়া উচিৎ ছিল। দুই বছর আগে বিশ্বকাপে এমন পরিণতি হয়েছিল আমাদের, এবার হলো তোমাদের।’

পুরো একটা বাড়িতে বাংলাদেশ মিডিয়ার রাত্রিযাপন, আড্ডা। দল বেধে প্রতিরাতে মোঘল-ই-আজম-এ ডিনার, নটিংহ্যামে প্রবাসীদের ভালবাসা, ইংল্যান্ডে বসে বাংলাদেশের পরিবেশ। টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ কভার করতে যেয়ে নিজের কাছে দারুণই লেগেছে। নটিংহ্যাম ক্রিকেট স্টেডিয়ামের খুব কাছে ট্রেন্ট রিভার, নদীর পানিতে দল বেধে হাসেদের ভেসে বেড়ানোর দৃশ্য সত্যিই চোখ জুড়ানো। তবে বাংলাদেশ দলের পারফরমেন্সে যে লিখতে হলো অন্য কিছু। লিখতে হলো ‘নটিংহ্যাম ট্রাজেডি।’

আইএইচএস/