খেলাধুলা

আশরাফুলের স্মৃতিতে অবিস্মরণীয় সেই জয়

এখন যতই অস্ট্রেলিয়া আর নিউজিল্যান্ডকে হারাক টাইগাররা, কঠিন ও রুঢ় সত্য হলো- সেই ২০০৭ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার জোহানেসবার্গে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে হারানোর পর আজ পর্যন্ত টি টোয়েন্টি বিশ্বকাপের মূল পর্বে একটি জয়ও পায়নি বাংলাদেশ।

Advertisement

প্রাথমিক বা বাছাই পর্ব যাই বলা হোক না কেন, সেখানে ওমান, আফগানিস্তান, নেপালের মত দলের বিপক্ষে জিতলেও টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের মূল পর্বে একটি ম্যাচও জেতা সম্ভব হয়নি। তাই সবেধন নীলমনি ওই জয়টিই এখন পর্যন্ত টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে টাইগারদের একমাত্র সাফল্য।

তাই টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ এলেই ২০০৭ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর জয়ের সুখ স্মৃতি জেগে ওঠে ভক্তদের মনে। ওই অবিস্মরণীয় জয়ের ম্যাচে আরও একটি ব্যক্তিগত সাফল্যের ফলকও উন্মোচিত হয়েছিল।

সেই ম্যাচে ২০ বলে ফিফটি করে হৈ চৈ ফেলে দিয়েছিলেন তখনকার টাইগার ক্যাপ্টেন মোহাম্মদ আশরাফুল। বলার অপেক্ষা রাখে না, সে সময়ে টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটে সেটাই ছিল দ্রুততম ফিফটি।

Advertisement

জাগো নিউজের সাথে একান্ত আলাপচারিতায় সে ঐতিহাসিক জয়, তার নিজের ম্যাচ জেতানো ব্যাটিং, আফতাব আহমেদের দারুণ সহায়ক ভূমিকার কথা এবং সাকিব, সৈয়দ রাসেল ও আব্দুর রাজ্জাকের বোলিং নিয়ে অনেক খোলামেলা কথা বলেছেন আশরাফুল। সে ম্যাচের শেষ ২ ওভারে তার দেয়া ৪৪ রানের কথা অকপটে স্বীকার করতে একটুও ভুল করেননি।

জাগো নিউজ: কেমন ছিল সেবারের প্রস্তুতি? একটু বলবেন?আশরাফুল: আসলে আমাদের সেবারের প্রস্তুতিও খারাপ ছিল না। বিশ্বকাপের আগে কেনিয়ায় তিন জাতির টুর্নামেন্ট খেলেছিলাম। তারপর দক্ষিণ আফ্রিকায় গিয়ে কয়েকটি প্র্যাকটিস ম্যাচও খেলেছিলাম। তবে খুব একটা ভালো খেলিনি। মানে পারফরমেন্স প্রত্যাশিত মানে পৌঁছেনি।

জাগো নিউজ: প্রস্তুতি পর্বে ভাল না খেলেও নাকি আপনি সাফল্যের আশা করেছিলেন? সেটা কী ঠিক?আশরাফুল: হ্যাঁ, করেছিলাম। আমার মনে হচ্ছিল আমরা ভাল করতে পারি।

জাগো নিউজ: কেন, কী কারণে এমন মনে হয়েছিল?আশরাফুল: আমি টুর্নামেন্ট শুরুর আগে সবার সাথে বসে একটা কথা বলছিলাম, আমাদের খুব ভাল সম্ভাবনা আছে এই ফরম্যাটে চাইলে ভাল কিছু করা সম্ভব। কারণ ছিল, ওই দলে আমরা যারা ছিলাম- আমি, আফতাব, তামিম, সাকিব, মুশফিক, অলক ভাই, বেশিরভাগ প্লেয়ারই আমরা মারতে পছন্দ করতাম। যেহেতু খেলাটা মাত্র ২০ ওভারের, তাই দলে ৪-৫ জনের বেশি ফ্রি-স্ট্রোক মেকার থাকায় আমার মনে হচ্ছিল আমাদের পক্ষে ভাল করা সম্ভব। তারপর ওয়েস্ট ইন্ডিজের সাথে ম্যাচ খেলতে নেমে আমরা দারুণ টিম পারফরমেন্স করে অবিস্মরণীয় জয় পেলাম।

Advertisement

জাগো নিউজ: ওয়েস্ট ইন্ডিজ বধের গল্পটা একটু বলবেন কী?

আশরাফুল: আমি আসলে খুব চিন্তায় ছিলাম ক্রিস গেইলকে নিয়ে। ঠিক আগের ম্যাচে স্বাগতিক দক্ষিণ আফ্রিকান ফাস্ট বোলিংকে দুমড়ে মুচড়ে দারুণ এক সেঞ্চুরি উপহার দিয়েছিলেন গেইল। এখন আমাদের সাথেও যদি তেমন বড় ইনিংস খেলে ফেলেন, তাহলে নির্ঘাত ওয়েস্ট ইন্ডিজের স্কোর দু’শো, টু’শো হয়ে যাবে। এই ভেবে অস্থির ছিলাম।

যেহেতু আমি অধিনায়ক ছিলাম, তাই আমি চিন্তায় ছিলাম গেইলকে কিভাবে হ্যান্ডেল করবো? আমার প্রথম চিন্তাই ছিল কিভাবে গেইলকে ঠেকাবো। গেইলকে কম রানে আউট না করলে সব লক্ষ্য ও পরিকল্পনা ভেস্তে যাবে। এমন চিন্তাই মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল।

আমি কিভাবে তাকে হ্যান্ডেল করবো- ভেবেই ছিলাম অস্থির; কিন্তু আমার চিন্তা কমিয়ে দিল পেসার সৈয়দ রাসেল। ওই বাঁ-হাতি পেসারের প্রথম ওভারের তৃতীয় বলেই শূন্য রানে ফিরে গেলেন গেইল। গালিতে অলক কাপালি ভাই ক্যাচটি ধরেছিলেন। গেইল কোন রান করতে না পারায় আমি তো বটেই, পুরো দলের সাহস বেড়ে গেল। মনে হলো আমরা এবার ক্যারিবীয়দের নাগালের ভিতরে আটকে রাখতে পারবো। আমিও অনেকটাই দুশ্চিন্তামুক্ত হলাম।

জাগো নিউজ: আপনার শেষ দুই ওভারে ৪৪ রান ওঠায় খুব সমালোচনা হয়েছিল। দলের অবস্থা তখন কেমন ছিল। ড্রেসিংরুমের পরিবেশ?

আশরাফুল: হ্যাঁ..., হ্যাঁ। কী আর বলবো? শেষ ২ ওভারে ৪৪ রান দিয়ে আমি যে কী পরিমাণ গালি খেয়েছিলাম, বলে বোঝানো যাবে না। আমাদের সমর্থন করতে আসা হাজারো প্রবাসী বাঙালি ভাই আমাকে গালাগাল করেছেন। আর সহযোগি ক্রিকেটারদের মুখ ফ্যাকাসে হয়ে গিয়েছিল।

এখনো মনে আছে, ওই ম্যাচে আমি প্রথম দিকে খুব ভাল বোলিং করেছিলাম। আমার প্রথম ২ ওভারে রান উঠেছিল মোটে ১১। যা যে কোন স্ট্যাান্ডার্টে খুব কম। কিন্তু পরের দুই ওভারে আমি প্রচন্ড মার খেলাম। ৪০ প্লাস রান দিয়ে ফেললাম। তাতে করে পুরো দল মানসিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়েছিল। আমি ড্রেসিং রুমে এসে দেখি সবার চোখমুখে খানিক হতাশার ছাপ। সবাই মেন্টালি খুব ডাউন। আমি ড্রেসিং রুমে ঢুকে সবাইকে বলছিলাম ভাই তোমরা কোন ডাউন হয়ো না। আমি যে রান দিয়েছি, সেই রান করে দেব। তারপরও সবাই আপসেটই ছিল।

জাগো নিউজ: পরে সত্যি সত্যি আপনিই ম্যাচ জিতিয়েছিলেন। অসাধারণ ব্যাটিং করে। আপনার ওই উত্তাল ব্যাটিংয়ের গল্পটা একটু শোনাবেন?

আশরাফুল: এদিকে আমাদের শুরুও তেমন ভাল হয়নি। ২৮ রানে ২ উইকেট পড়ে গিয়েছিল। নাজিমউদ্দীন আর তামিম আউট হয়ে গেল। তারপর আমি নামলাম চার নম্বরে। আমার সঙ্গী ছিল আফতাব । এখনো মনে আছে আমি উইকেটে নেমেই ব্যাট হাতে ঝড় তুলি। বোলার ছিলেন ওয়েস্ট ইন্ডিজ পেসার ড্যারেন পাওয়েল ।

তার প্রথম বলেই বাউন্ডারি হাকালাম। তারপর একটানা তিনটি চার এবং মোট ৫ বলে ৪টি বাউন্ডারি ও একটি ডাবলসহ ১৮ রান নিলাম। তখন আমার কনফিডেন্সে লেভেল তুঙ্গে চলে গেল। মনে হলো আজ কিছু একটা হবে। ঠিক পরের ওভারে রবি রামপাল আসলেন বোলিংয়ে। তাকে প্রথম বলেই স্কুপ করে ছক্কা মারলাম।

তারপরের বলে মিড অফের ওপর দিয়ে চার। আমার কাছে মুখস্থের মত মনে হচ্ছিল। যেন আগে থেকেই বুঝে ফেলছিলাম, কে কোন লাইন ও লেন্থে বল করবে। আমিও তা জেনে বুঝেই ব্যাট চালিয়ে একের পর এক বাউন্ডারি হাঁকিয়েছি। এরপর ডোয়াইন ব্রাভো আসলেন বোলিংয়ে। তিনি মিড অন রেখে আমার দিকে এমনভাবে তাকালেন যে আমি মিড অনেক ক্যাচ দেব।

আমি তার চোখের ও শরীরি ভাষায় কোন ভ্রুক্ষেপ না করে উল্টো মিড অফ ও মিড অনের ওপর দিয়ে মারলাম। তারপর স্কোয়ার লেগ আনলো যে আমি পুল বা হুক করবো। আমি স্কোয়ার লেগের ওপর দিয়ে তুলে মারলাম ব্রাভোকেও। আমি তাকে রিড করে ফেলছিলাম। বাউন্সার ছুড়েছে ছয় মেরেছি। এভাবে করেই এক সময় ২০ বলে ফিফটি হয়ে যায়। যা শুধু আমার বা বাংলাদেশের কোন ব্যাটসম্যানেরই না, ক্রিকেট দুনিয়ারই টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটে তখন দ্রুততম অর্ধশতক।

জাগো নিউজ: ওই ম্যাচে আপনি ছাড়াও আরও অনেকেরই পারফরমেন্স ছিল দারুণ। তাদের সম্পর্কে কিছু বলবেন কী?

আশরাফুল: হ্যাঁ, অবশ্যই ছিল। একা তো আর ম্যাচ জেতানো সম্ভব হয় না। ব্যাটিংয়ে আফতাব আর বোলিংয়ে তিন বাঁ-হাতি সৈয়দ রাসেল, সাকিব ও রাজ্জাক ভাইয়ের কথা ভুলি কি করে? তারাও দারুণ পারফরম করেছেন।

আমি আর আফতাব জুটি গড়ে আগালাম অনেকদুর। ওকে বলছি তুই থাক আমি মারি; কিন্তু আফতাবও কম যায়নি। ব্রিলিয়ান্ট খেলছে। সেও ৬০ প্লাস নট আউট ছিল ৪০ বলে (৪৯ বলে ৬২*)। ওই ম্যাচে সাকিব (৪/৩৪) অসাধারন বোলিং করে ৪ উইকেট পেয়েছিল। সৈয়দ রাসেল আর রাজ ভাই (রাজ্জাক, ৪ ওভারে ২/২৫) ও খুবই ভাল বোলিং করেছিলেন।

রাসেল ৪ ওভারে মাত্র ১০ রান দিয়ে ১ উইকেটের পতন ঘটিয়ে শুরুতে ক্যারিবীয়দের রান তোলার চাপে ফেলে দিয়েছিল। সব মিলে দারুণ টিম পারফরমেন্সে আমি পেলাম অবিস্মরণীয় এক জয়। সে জয়ের সুখস্মৃতি এখনো মনকে দোলা দেয়। আলোড়িত করে। এই ভেবে পুলক অনুভব করি আমার নেতৃত্বে ক্রিস গেইল, ডেভন স্মিথ, চন্দরপল, মারলন স্যামুয়েলস, সারওয়ান, ডোয়াইন ব্রাভো, ডোয়াইন স্মিথ, ড্যারেন পাওয়েল, রবি রামপাল আর ফিডেল এডওয়ার্ডসের গড়া দারুন শক্তিশালি ওয়েস্ট ইন্ডিজকে হারিয়েছিল।

এআরবি/আইএইচএস/