মতামত

মন্ত্রীদের অভিমান আর অসহায়ত্ব!

মন্ত্রীরাই মন্ত্রণালয়ের প্রধান নির্বাহী। প্রধানমন্ত্রী সরকারের প্রধান নির্বাহী। প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে মন্ত্রিসভা যৌথভাবে সংসদের কাছে দায়ী থাকেন। প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে যেমন সম্মিলিতিভাবে সরকার পরিচালিত হয়। তেমনি মন্ত্রীর নেতৃত্বে পরিচালিত হয় সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়।

Advertisement

মন্ত্রীর নেয়া সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করবেন আমলাতন্ত্র। একসময় ক্যারিয়ার পলিটিশিয়ানরা মন্ত্রী হতেন। তারাই নিয়ন্ত্রণ করতেন মন্ত্রণালয়, নিতেন নীতিগত সব সিদ্ধান্ত। কিন্তু এখন রাজনীতিতে রাজনীতিবিদদের সংখ্যা কমে গেছে। রাজনীতিতে এখন আমলা আর ব্যবসায়ীদের প্রাধান্য। তাতে আমলাতন্ত্রের ওপর রাজনীতিবিদদের নিয়ন্ত্রণ শিথিল হয়ে গেছে। কখনো কখনো মন্ত্রীদের বেশ অসহায় মনে হয়। যেটা তাদের দায়িত্ব সেটা ভুলে গিয়ে তারা তাদের অসহায়ত্ব আর অভিমানের কথা প্রকাশ্যে বলে বেরান।

সাম্প্রতিক সময় ই-কমার্স বেশ আলোচিত ইস্যু। অনেক দিন ধরেই বিশ্বজুড়ে ই-কমার্সের জনপ্রিয়তা বাড়ছিল। ঘরে বসে পছন্দের জিনিস পেয়ে যাওয়াটা মানুষের জীবন অনেক সহজ করে তুলেছিল। আমাজন বা আলীবাবা এখন বিশ্ব জায়ান্ট। বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশেও জনপ্রিয় হচ্ছিল ই-কমার্স। বিশেষ করে করোনা মহামারি কালে, যখন মানুষের ঘরের বাইরে যাওয়া ঝুঁকিপূর্ণ, তখন ই-কমার্স হয়ে উঠেছে অনিবার্য বাস্তবতা। কিন্তু ভালো জিনিসকে ধ্বংস করতে আমাদের একদম সময় লাগে না।

এক পণ্য দেখিয়ে আরেক পণ্য সরবরাহ করা, মান ঠিক না রাখা, সময়মতো সরবরাহ না করা এমন হাজারটা অভিযোগ ছিল বিভিন্ন ই-কমার্স সাইটের বিরুদ্ধে। অনেকেই যেন পুরো ব্যবসাটি প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি দেয়ার চেয়ে একবারে ব্যবসা করার দিকে মনোযোগী ছিলেন। একটা-দুইটা বিচ্যুতিই পুরো ই-কমার্সের বিশ্বাসযোগ্যতা প্রশ্নবিদ্ধ করার জন্য যথেষ্ট ছিল। কিন্তু ই-কমার্সের নামে কয়েকটি হায় হায় কোম্পানির প্রতারণার কাহিনি এখন পুরো ই-কমার্স খাতকেই ধসিয়ে দিতে বসেছে। ই-ভ্যালি, ই-অরেঞ্জ, ধামাকা, কিউকম নানা বাহারি নামের প্রতিষ্ঠানগুলো বিশাল ডিসকাউন্টের ফাঁদ পেতে লাখো মানুষের হাজার কোটি টাকা হাওয়া করে দিয়েছে।

Advertisement

অভিযুক্ত অনেককেই গ্রেফতার করা হয়েছে। কিন্তু সাধারণ মানুষের টাকা কে ফেরত দেবে, সেটার কোনো সুরাহা হয়নি। লক্ষণ দেখে মনে হচ্ছে, সাধারণ মানুষের টাকা ফেরত পাওয়ার কোনো সম্ভাবনাই নেই। যুবক বা ডেসটিনির তবু কিছু সম্পদ আছে, যা বিক্রি করে আংশিক হলেও গ্রাহকদের টাকা ফিরিয়ে দেয়া সম্ভব, যদিও তার কোনো উদ্যোগ নেই। কিন্তু ই-কমার্সের নামে হায় হায় কোম্পানিগুলোর পুরো ব্যবসাটাই ছিল হাওয়াই। তাই তাদের মেরে দেয়া টাকা কে দেবে? সরকার হাত মুছে দায় অস্বীকার করেছে। বাণিজ্যমন্ত্রী বলে দিয়েছেন, গ্রাহকরা অবিশ্বাস্য কম দামে পণ্য কেনার সময় তো তাদের জিজ্ঞাসা করেনি। তাই টাকা ফেরতের দায়ও সরকারের নয়।

তর্কের খাতিরে বাণিজ্যমন্ত্রীর যুক্তি ঠিক আছে। কিন্তু ই-কমার্স খাতে সুশাসন নিশ্চিত করার দায়িত্ব তো সরকারের। তাই চাইলেই তারা দায় অস্বীকার করতে পারবেন না। নৈতিক দায় সরকারকে অবশ্যই নিতে হবে। সাধারণ মানুষ তো কোনো অবৈধ প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে পণ্য কেনার জন্য টাকা দেয়নি। ইভ্যালি বা ই-অরেঞ্জ তো সরকারের অনুমতি নিয়েই ব্যবসা করছিল। ইভ্যালির বিজনেস পলিসি যে ভুল, সেটা তো অনেক দিন ধরেই বলাবলি হচ্ছিল। বাংলাদেশ ব্যাংক একবার তাদের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ফ্রিজ করে মাসখানেক পর আবার খুলেও দিয়েছিল।

অ্যাকাউন্ট খুলে দেয়ার মানে হলো, ইভ্যালিকে এক ধরনের গ্রিন সিগনাল দেয়া। তো এখন সরকার দায় নেবে না কেন? সরকার যে দায় নেবে না বা নিতে পারবে না, সেটা আমি বুঝে গেছি বাণিজ্যমন্ত্রীর এক বক্তব্যে। ই-কমার্স ব্যবসায় সুশাসন নিশ্চিত করার দায়িত্ব বাণিজ্যমন্ত্রীর। সেই বাণিজ্যমন্ত্রীই তার অসহায়ত্ব স্বীকার করেছিলেন প্রকাশ্যে। সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বলেছিলেন, ‘দু’বছর আগে একটি ই-কমার্স সাইটের উদ্বোধনীতে কোরবানির জন্য এক লাখ টাকায় গরুর অর্ডার দিয়ে কাঙ্ক্ষিত গরু পাইনি। আমাকে যে গরুটি দেখিয়েছিল, আমি সেটি পাইনি। ৫-৬ দিন পর জানানো হলো আমাকে যে গরুটি দেখানো হয়েছিল, তা বিক্রি হয়ে গেছে। পরে আমাকে কম দামে অন্য একটি গরু দিয়েছিল। সাথে একটি ছাগলও পেয়েছিলাম। গরু পাওয়ার আগে টাকা পরিশোধ করে আমি তাদের কাছে বন্দি হয়ে গিয়েছিলাম। তাই পরে ওরা যে গরুটি দিয়েছে, তাই নিয়েছি।‘

বাণিজ্যমন্ত্রীর অসহায়ত্বের মধ্যে এক ধরনের সততা আছে। সে জন্য তাকে ধন্যবাদ জানাই। কিন্তু একজন সাধারণ মানুষের প্রতারিত হওয়া আর বাণিজ্যমন্ত্রীর প্রতারিত হওয়া এক নয়। বাণিজ্যমন্ত্রীর প্রতারিত হওয়ার গল্প শুনে আমরা আহা-উহু করবো না। আমরা জানতে চাইবো, দুই বছর আগে প্রতারিত হয়ে বাণিজ্যমন্ত্রী সেই প্রতারক ই-কমার্স সাইটের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নিয়েছিলেন। যে ব্যবস্থা নেয়ার ক্ষমতা সরাসরি তার হাতেই। বাণিজ্যমন্ত্রী অভিযোগ করলেও সেই ই-কমার্স সাইটটির নাম বলেননি। তিনি যদি দুই বছর আগেই এই প্রতারক সাইটের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতেন তাহলে হয়তো, আজ দেশজুড়ে ই-কমার্স নিয়ে যে সচেতনতা, তা তখনই সৃষ্টি হতে পারতো। সেটা হলে এই দুই বছরে হাজার হাজার মানুষ প্রতারিত হওয়া থেকে বেঁচে যেতেন।

Advertisement

বাণিজ্যমন্ত্রী নিজে যে ই-কমার্স সাইটটি উদ্বোধন করেছেন, তারাই তার সাথে প্রতারণা করেছে। কিন্তু মন্ত্রী কোনো ব্যবস্থা নেননি বলে এ প্রতিষ্ঠানটি নিশ্চয়ই এই দুই বছর ধরে আরও অনেককে প্রতারিত করেছে। বাণিজ্যমন্ত্রী নিজে যেটি উদ্বোধন করেছেন, সেটির প্রতি নিশ্চয়ই সাধারণ মানুষের বাড়তি আস্থা ছিল। সেই আস্থাকে পুঁজি করে তারা যে মানুষকে ঠকালো, তার দায় কিন্তু বাণিজ্যমন্ত্রীকে নিতেই হবে। ভালোমানুষি আর সুশাসন এক নয়। অসহায়ের মত প্রতারিত হওয়া নয়, মন্ত্রীর দায়িত্ব সুশাসন নিশ্চিত করা।

বাংলাদেশে সেবাখাতগুলোতে সেবা সম্পর্কে কোনো ধারণাই নেই। যেখানেই সেবার প্রশ্ন সেখানেই হয়রানি, সেখানেই ঘুস, সেখানেই দুর্নীতি। সেটা পাসপোর্ট বলেন, এনআইডি বলেন, জমি রেজিস্ট্রি বলেন, ব্যাংক বলেন- সবখানে পদে পদে হয়রানি আর দুর্ভোগ। কিন্তু কয়েক দিন আগে যশোরে এক অনুষ্ঠানে স্থানীয় সরকার প্রতিমন্ত্রীর বক্তব্য শুনে আমি চমকাতেও পারছিলাম না।

কয়েক দিন আগে যশোরে এক অনুষ্ঠানে স্থানীয় সরকার প্রতিমন্ত্রী স্বপন ভট্টাচার্য বলেন, “কখনও মিথ্যা তথ্য দেওয়া উচিত নয়। আমরা যেখানে কথা বলছি, একটি অফিস দেখছি এখানে। সেখানে লেখা আছে, ‘আমি এবং আমার অফিস দুর্নীতিমুক্ত।’ এই তথ্য কি সঠিক? সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে টাকা ছাড়া কোনো কাজ হয় না। আমি গত সপ্তাহে একটি জমি রেজিস্ট্রি করতে গিয়ে দুর্নীতির রেট অনুযায়ী টাকা দিতে না পারায় সেই জমি রেজিস্ট্রি হয়নি।”

ভাবুন একবার, কী অবস্থা! রেট অনুযায়ী ঘুস দিতে না পারলে যদি প্রতিমন্ত্রীর জমি রেজিস্ট্রি আটকে যায়, তাহলে আমজনতার কী হবে? আমজনতার কী হচ্ছে, সেটা আমজনতা জানে। কিন্তু একজন প্রতিমন্ত্রী যখন এই দুর্ভোগের শিকার হন, তখন সাধারণ মানুষ কার কাছে যাবে। প্রতিমন্ত্রী যদি সাধারণ মানুষের দুর্ভোগ অনুভব করার জন্য পরিচয় লুকিয়ে লোক পাঠিয়ে থাকেন, তাহলে তিনি অবশ্যই ধন্যবাদ পাবেন। কিন্তু ব্যাপারটা তেমন নয়। তার কণ্ঠে ছিল অসহায়ত্ব। একজন প্রতিমন্ত্রী যদি ঘুষের শিকার হন, তাহলে তিনি প্রকাশ্যে নিজের অসহায়ত্ব প্রকাশ না করে, দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবেন, যাতে আর কেউ এ ধরনের দুর্ভোগের শিকার না হন। প্রতিমন্ত্রী বলার পর অবশ্য সেই জমি দ্রুত রেজিস্ট্রি হয়েছে, অভিযুক্তদের শোকজ করা হয়েছে। কিন্তু প্রতিমন্ত্রীর অসহায়ত্ব আমাদের বেদনাকে আরও বাড়িয়েছে শুধু।

দুই মন্ত্রীর অসহায়ত্বের পর খাদ্যমন্ত্রীর অভিমানের গল্প বলি। সম্প্রতি চালের দাম নিয়ে এক ওয়েবিনারে বাংলাদেশ ভূমিহীন সমিতির সভাপতি সুবল সরকার বলেন, ‘খাদ্যমন্ত্রী নিজেই তো অটোরাইস মিলের মালিক।’ তার এই বক্তব্যে ক্ষুব্ধ হন খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার। তিনি বলেন, ‘এ কথা যে বলেছে, তাকে সামনে আসতে হবে। প্রমাণ দিতে হবে। এ কথা পুরো অনুষ্ঠানকে কলঙ্কিত করেছে। আমার মনে হয়, সভা থেকে প্রস্থান করা উচিত। এ কলঙ্ক নেওয়ার চেয়ে আমার পদত্যাগ করা ভালো। আপনারা চাইলে আমি আজই পদত্যাগ করতে পারি।’ পরে সুবল সরকার তার বক্তব্যের জন্য ক্ষমা চাইলে খাদ্যমন্ত্রী শান্ত হন। কিন্তু আমি খুব অবাক হচ্ছি, ভূমিহীন মালিক সমিতির সভাপতির বক্তব্যে যদি খাদ্যমন্ত্রী পদত্যাগ করতে চান, তাহলে মন্ত্রণালয় চলবে কীভাবে?

মন্ত্রীরা নিজ নিজ মন্ত্রণালয়ের প্রধান নির্বাহী। তারা যদি এভাবে অভিমান করেন বা নিজেদের অসহায়ত্বের গল্প বলেন, তাহলে সাধারণ মানুষের কী হবে। আমরা প্রত্যাশা করি, মন্ত্রীরা দৃঢ়তার সঙ্গে মন্ত্রণালয় পরিচালনা করবেন। জনগণের স্বার্থে আইনের কঠোর প্রয়োগ নিশ্চিত করবেন। যাতে সাধারণ মানুষ সেবা পায়, তাদের প্রতারিত হতে না হয়, ভোগান্তি পোহাতে না হয়। প্রত্যেক খাতে সুশাসন নিশ্চিত করা, মানুষের সেবা পাওয়ার অধিকার নিশ্চিত করা সরকারের দায়িত্ব।

১০ অক্টোবর, ২০২১ লেখক : বার্তাপ্রধান, এটিএন নিউজ।

এইচআর/জেআইএম