১৯৭১ সাল। চারদিকে যুদ্ধের দামামা। দুই দিকে দুই পক্ষ। এক দিকে লাল-সবুজের পতাকার লড়াই। মুক্তির সংগ্রাম। স্বাধীনতার লড়াই। অন্যদিকে রক্তের হোলি খেলায় মত্ত পাকিস্তানি হানাদার আর তাদের এ দেশীয় দোসর-রাজাকার, আলবদর, আল শামস। পড়ছে একের পর এক লাশ। পুড়ছে শহর-বন্দর-নগর-গ্রাম। এক বিভীষিকাময় পরিস্থিতি। এমন সময় জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের ভাষণ আমার মতো মুক্তিপাগল মানুষের রক্তে আলোড়ন তোলে। এখন আর ঘরে বসে থাকার সময় নেই। ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে যুদ্ধে। নূরুল ইসলাম খান পাঠান তখন কিশোরগঞ্জ গুরুদয়াল সরকারি কলেজের ছাত্র। বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার মন্ত্রে উদ্বুদ্ধ হয়ে ঘর ছাড়েন এপ্রিলে। মার্চের শেষ দিকে দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অধিনায়ক কেএম শফিউল্লাহর নেতৃত্বে নূরুল ইসলামসহ ১৯ জন মুক্তিযোদ্ধা যুদ্ধে অংশ নিতে ভারতের উদ্দেশ্যে ঘর ছাড়েন। তার সঙ্গে ছিলেন রফিকুল হক, (পরবর্তীতে বীর প্রতীক খেতাব প্রাপ্ত), শহীদ আতিক, বাছির উদ্দিন ফারুকী, খায়রুল বাসার খান পাঠান, কামরুজ্জামার কমরু, পরশ আলী, মুর্শেদ, নাজিম উদ্দিনসহ অনেকেই।`আমরা প্রথমে ভৈরবের উদ্দেশ্যে কিশোরগঞ্জ রেলওয়ে স্টেশনে যায়। আমার বাবা আব্দুস ছাত্তার খান পাঠানসহ সহযোদ্ধাদের অনেকেরই বাবা রেলস্টেশনে গিয়ে আমাদের ট্রেনে তুলে দেন। কিন্তু কুলিয়ারচর যাওয়ার পর জানতে পারি ভৈরবে পাকহানাদার বাহিনী ব্যাপক গোলাগুলি করছে। এ অবস্থায় আমরা কুলিয়ারচর গিয়ে ট্রেন থেকে নেমে পড়ি। নদী পার হয়ে পায়ে হেটে ব্রাহ্মণবাড়িয়া যায়। সেখান থেকে তেলিয়াপাড়া। সেখানে একটি চা-বাগানে ১৫/২০ দিন আমাদের অস্ত্রের ট্রেনিং দেয় সেনাবাহিনী।’ অস্পষ্ট স্বরে শহরের খড়মপট্টির বাসায় শয্যাশায়ী নূরুল ইসলাম এভাবেই বর্ণনা করছিলেন তার যুদ্ধে যাওয়ার গল্প। তিনি আরও বলেন, এরই মধ্যে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও তাজউদ্দিন আহমেদ মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্য ভারতে যান। মে মাসের দিকে আমাদের ১৯ সদস্যের দলটি ভারতের উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। প্রথমে গিয়ে উঠি শিবনাথ ট্রেনিং সেন্টারে। পরে সেখান থেকে ভারতের অম্পিনগর ক্যাম্পে তিন মাস অস্ত্র চালানোর প্রশিক্ষণ নেই। তারপর আবারও শিবনাথ ক্যাম্পে ফিরে আসি। এ সময় ৩ নম্বর সেক্টরের কমান্ডার মেজর জেনারেল আব্দুল মতিনের নেতৃত্বে এবং সাব-সেক্টর কমান্ডার এম এ মতিনের অধীনে আমরা তেলিয়াপাড়াসহ বিভন্ন স্থানে পাকিস্তানের বিরুদ্দে সম্মুখযুদ্ধে অংশ নিই। এরপর আমরা বিভিন্ন ছোট ছোট গ্রুপে ভাগ হয়ে যাই। জানা গেছে, ৩ নং সেক্টরের কমান্ডার কেএম শফিউল্লার নির্দেশে নূরুল ইসলামের দলটিকে পাঠানো হয় কিশোরগঞ্জে। এটি সম্ভবত জুন মাসের শেষ দিকে হবে। সে-সময়কার পূর্ব পাকিস্তান নেজামে ইসলাম পার্টির সভাপতি ও কিশোরগঞ্জে রাজাকার বাহিনীর প্রধান ছিলেন মাওলানা আতাহার আলী। নূরুল ইসলাম খান পাঠান, মুক্তিযোদ্ধা খলিল, খায়রুল বাসার খান পাঠানসহ ৬ জনের ছোট দলটি কিশোরগঞ্জ এসেই তাকে হত্যার পরিকল্পনা করে। অনেক চেষ্টা করেও মাওলানা আতাহার আলীকে ধরার সুযোগ পাওয়া যাচ্ছিল না। এ সময় কটিয়াদী উপজেলার ধুলদিয়া রেলসেতুর কাছে এক কুখ্যাত রাজাকার কমান্ডারকে হত্যা করে আমার দল। কিন্তু স্থানীয় রাজাকাররা হানাদার বাহিনীর কাছে তাদের খবর পৌঁছে দেয়। নূরুল ইসলাসকে হত্যার জন্য হন্যে হয়ে খুঁজতে তাকে পাঞ্জাবিরা। এ অবস্থায় কয়েকদিন এখানে-সেখানে পালিয়ে থেকে বৌলাইর নাজিম উদ্দিনকে সঙ্গে নিয়ে অষ্টগ্রাম চলে যান তিনি। সেখানে কয়েকদিন অবস্থানের পর স্থানীয় কয়েকটি পরিবারের লোকজনের সঙ্গে আবারও ভারতে যায়। সেখানেই সবচেয়ে বড় ও বিভীষিকাময় সম্মুখযুদ্ধে সরাসরি অংশ নেন এ বীর যোদ্ধা। এ যুদ্ধে তার কয়েকজন ঘনিষ্ঠ সহযোদ্ধাকে হারাতে হয়। নভেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে তাকে একটি যুদ্ধ দলের কমান্ডার করা হয়। তিনি একটি দল নিয়ে ভারতের সীমান্তবর্তী আখাউড়া এলাকার চাঁনপুর গ্রামে ক্যাম্প স্থাপন করেন। তিনি জাগো নিউজকে বলেন, ২ ডিসেম্বর রাত ১২টার দিকে আমরা ডিফেন্স দিচ্ছিলাম। এমন সময় পাঞ্জাবিদের একটি আর্টিলারি দল হঠাৎ আমাদের ওপর হামলা করে। আমরা পাল্টা হামলা চালাই। শুরু হয় তুমুল যুদ্ধ। পাক বাহিনীর সাঁড়াশি আক্রমণে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ি আমরা। আমার দলের বেশিরভাগ মুক্তিযোদ্ধা পিছু হটে। বুঝতে পারি সামনে নিশ্চিত মৃত্যু। কিন্তু আমি যে কমান্ডার! আমাকে পিছু হটলে হবে না। হয় জয়-না হয় মৃত্যু। কয়েকজন সাহসী সহযোদ্ধাকে নিয়ে দ্বিগুণ উৎসাহে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে লাগলাম। একের পর এক গ্রেনেড চার্জ করে পাক বাহিনীর অগ্রযাত্রা রোধ করতে থাকে। এ সময় বেশ কিছু পাকসেনা নিহত হয়। শত্রু শিবিরে ভয় দেখা দেয়। আমাদের সহসিকতায় উদ্বুদ্ধ হয়ে কিছুটা পিছু হটে যাওয়া মুক্তিযোদ্ধারাও এসে যোগ দেয় আমাদের সঙ্গে। চার দিন এ যুদ্ধ স্থায়ী হয়। এক সময় পাক বাহিনী পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। এ যুদ্ধে প্রাণ হারান আমার সহযোদ্ধা খুর্শেদ উদ্দিনসহ অন্তত ২০/২৫ জন মুক্তিযোদ্ধা।`তিনি বলেন, ‘চোখের সামনে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন খুর্শেদ। তখন সবেমাত্র ক্যাডেট কলেজে ভর্তি হয়েছিলেন তিনি। প্রস্তুতি না থাকায় আমাদের অনেক ভাই প্রাণ হারান। আহত হন অসংখ্য। হাতে রাইফেল আর পিঠে রক্তাক্ত সহযোদ্ধার নিথর দেহ। কারো হাত নেই, কারও পায়ের একটি অংশ উড়ে গেছে, কেউবা গুলিবিদ্ধ হয়ে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে আছেন। যে কোন সময় শত্রু পক্ষের গুলিতে উড়ে যেতে পারে আমার মাথা। কিন্তু জীবনতো থেমে থাকেন না। সে সময় মৃত্যু ভয় ছিল না আমার মধ্যে। এ অবস্থায় আহতদের কাঁধে করে আগরতলায় মাটির নিচে নির্মিত চিকিৎসা কেন্দ্রে নিয়ে যায়। চাঁনপুর যুদ্ধে আমার অন্যতম সহযোদ্ধা ছিলেন জামান মজুমদার বীর প্রতীক, রফিকুল হক বীর প্রতীক, খায়রুল বাশার খান বীর প্রতীক। দেশের জন্য তাদের সাহসের কথা কোনো দিন ভুলতে পারবো না।’মুক্তিযোদ্ধা নূরুল ইসরাম খান পাঠান বলেন, ‘হানাদার বাহিনী আখাউড়া থেকে পিছু হটার পর তাদের বন্দি শিবিরে গিয়ে চোখের পানি ধরে রাখতি পারিনি। তারা শুধু মানুষ হত্যা করেই ক্ষান্ত হয়নি। যেভাবে নারীদের বিভৎসভাবে নির্যাতন করা হয়েছে তা নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাস হবে না। এ অবস্থা দেখে আমরা আরও উজ্জীবিত হই। শপথ নেই যে করেই হোক দেশ স্বাধীন করতে হবে। হয় মারো-না হয় মরো এই ছিল আমাদের পণ। আখাউড়া যুদ্ধে হানাদার বাহিনীকে তাড়া করে ব্রাহ্মণবাড়িয়া পর্যন্ত নিয়ে যাই। আখাউড়া শত্রুমুক্ত হয়।’ ১৬ ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হয়। কিন্তু তার নিজের জেলা তখনও হানাদার বাহিনীর দোসরদের নিয়ন্ত্রণে। শহরকে মুক্ত করতে মুক্তিযোদ্ধারা তখনও প্রাণপাণ লড়াই করছে। ১৭ ডিসেম্বর পাকুন্দিয়ার পুলেরঘাট হয়ে কিশোরগঞ্জ আসেন নূরুল ইসলাম। মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরোধের মুখে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয় রাজাকার বাহিনী। মুক্ত হয় কিশোরগঞ্জ। রাজাকার আতাহার আলী, আব্দুল আউয়াল খান, তারা মিয়া, বাদশা মিয়াসহ স্থানীয় রাজাকারদের ধরে এনে রামানন্দ স্কুলে জড়ো করা হয়। পরে তাদের গণধোলাই দিয়ে পুলিশে সোপর্দ করা হয়।তিনি বলেন, স্বাধীন দেশে মুক্তিযোদ্ধারা ধুকে ধুকে মরছে। অপর দিকে রাজাকার ও তাদের আত্মীয়রা আজ দাপটের সঙ্গে চলে। স্বাধীনতার পর দীর্ঘদিন দেশ শাসন করেছে মুক্তিযুদ্ধ বিরোধীরা। স্বাধীনতা বিরোধীদের গাড়িতে শোভা পায় রক্তমূল্যে কেনা আমার প্রিয় পতাকা। কিন্ত এ জন্য মুক্তিযোদ্ধারা জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ করিনি। তবে আশার কথা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সরকার ক্ষমতায় আসার পর তাদের দম্ভে ফাঁটল ধরেছে। মানবতাবিরোধী অনেক রাজাকারের ফাঁসি হয়েছে। বাকিদের ফাঁসি কার্যকর দেখে মরতে চান এ বীরসেনা। তিনি জানান, ‘পদকের জন্য লড়াই করিনি। যুদ্ধ শেষে কারা জিতবে, জিতলে কি পাবো তা চিন্তা করিনি। স্বাধীনতার তিন বছর পর জানতে পারি আমাকে সরকার বীর বীক্রম উপাধি দিয়েছে। ১৯৭৩ সালে সৈয়দ নজরুল ইসলামের সঙ্গে তার বাসায় দেখা করতে যাই। তিনি আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরেন। বলেন, তুই বীর বিক্রম পদক পেয়েছিস। যা বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করে আয়। পর দিন ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করি। সেটি ছিল আমার জীবনে সবচেয়ে সুখের ক্ষণ। বঙ্গবন্ধু আমাকে জড়িয়ে ধরে কপালে চুমু দিতে থাকেন। এই প্রথম আমার চোখ ভিজে উঠেছিল আনন্দ অশ্রুতে। সেদিন প্রাণ খুলে আনন্দে কেঁদেছিলাম। সে কান্নায় আনন্দের পাশাপাশি ছিল স্বজন হারানোর বেদনাও।’স্বাধীন দেশে আমরা এখনও বেঁচে আছি। জীবনের মায়া ত্যাগ করে যুদ্ধে গিয়েছিলাম। তখন রক্তে ছিল মুক্তির নেশা। পদক কি জানতাম না। শুধু জানতাম দেশ স্বাধীন করতে হবে। মানুষকে মুক্তির স্বাদ দিতে হবে। এ জন্য তো জীবনকে তুচ্ছ মনে করেছি। আমি মনে করি, এ দেশে মুক্তিযোদ্ধাদের বংশধর যতদিন বেঁচে থাকবে ততদিন স্বাধীনতা বিরোধী শক্তি আর রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসতে পারবে না। বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়তে হলে রাজাকারমুক্ত দেশ বিনির্মাণ করতে হবে। তবেই স্বাধীনতার সুফল পাবে জাতি।এসএস/এমএস
Advertisement