২০১৫ সালের প্রথম দিকে বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের ডাকা ৯৩ দিনের লাগাতার অবরোধে অস্থির ছিল ঢাকাসহ সারাদেশ। বেড়ে গিয়েছিল অপরাধ। বছরের মাঝামাঝি সময়ে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। তবে বছরের শেষ দিকে হঠাৎ করেই শুরু হয় নতুন ধরনের টার্গেট কিলিং। যার একমাত্র টার্গেট ছিল বিদেশিরা। একটি কুচক্রী মহল একের পর এক হামলা চালায় বিদেশিদের ওপর।তাবেলা সিজার হত্যা ও বড় ভাইয়ের সন্ধান২৮ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যা। গুলশান-২ নম্বরের গভর্নর হাউজের পাশের সড়কে দুর্বৃত্তদের গুলিতে নিহত হন ইটালিয়ান নাগরিক তাবেলা সিজার। সিজার ঢাকায় নেদারল্যান্ডস ভিত্তিক বেসরকারি প্রতিষ্ঠান আসিসিও-বিডি এর প্রকল্প ব্যবস্থাপক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। এ ঘটনার দু’দিনের মাথায় হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার করে আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠন ইসলামিক স্টেটস (আইএস)। এ ঘটনার পরপরই কূটনৈতিক চাপে পড়ে ঢাকা। তবে বাংলাদেশে আইএসের কোনো অস্তিত্ব নেই বলে জানিয়ে দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল।ঘটনার প্রায় ১ মাস পর ২৬ অক্টোবর সিজার হত্যাকাণ্ডের রহস্য উন্মোচন হয়। সন্দেহভাজন চার হত্যাকারীকে গ্রেফতার করে মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশ। তাদের গ্রেফতারের পর সংবাদ সম্মেলনে করেন ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি)। কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া জানান, সরকারকে চাপে ফেলতে কথিত বড় ভাইয়ের নির্দেশে হত্যা করেন গ্রেফতারকৃতরা। ওই বড় ভাই একটি রাজনৈতিক দলের নেতা।কথিত সেই ‘বড় ভাইয়ের’ নাম না বললেও সরকারি বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায়, বিএনপি নেতা আবদুল কাইয়ুমের নির্দেশেই হত্যাকাণ্ডটি ঘটানো হয়েছে। তিনি দেশের বাইরে রয়েছেন। তবে বেনাপোল সীমান্ত থেকে তার ছোট ভাইকে গ্রেফতার করে পুলিশ।জাপানি নাগরিক হত্যাতাবেলা সিজার হত্যাকাণ্ডের রহস্য উন্মোচন হতে না হতেই ৩ অক্টোবর রংপুরের আলুটারি গ্রামে জাপানি নাগরিক হোশি কুনিওকে হত্যা করে মুখোশধারী দুর্বৃত্তরা। একইভাবে ঘটনার পরপরই হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার করে আইএস। বরাবরের মতো এবারো আইএসের সংশ্লিষ্টতা অস্বীকার করে সরকার।হত্যাকাণ্ডের দিন বিকেলে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আটক করা হয় হোশি কুনিওর ব্যবসায়িক সহযোগী হুমায়ুন কবির হীরা ও রংপুর মহানগর বিএনপি নেতা রাশেদুন্নবী খান বিপ্লবকে। পরে তাদের গ্রেফতার দেখিয়ে রিমান্ডে নেয় পুলিশ।অবশেষে জেএমবির মাসুদ রানাকে গ্রেফতারের পর প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে এই হত্যাকাণ্ডের মূল পরিকল্পনাকারী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এছাড়াও রংপুরে সহিংসতা ও হামলার প্রতিটি ঘটনার সঙ্গে নিজের সম্পৃক্ততার কথাও স্বীকার করে রানা।তাইওয়ান দম্পতি উপর হামলানভেম্বরের ৫ তারিখ, রাতে ঢাকার উত্তরায় তাইওয়ান নাগরিক লিচি ক্লাই ও তার স্ত্রী লিলি হু-এর বাসায় ঢুকে হামলা চালায় দুর্বিত্তরা। তারা ১০ বছর যাবত বাংলাদেশে বসবাস করছিলেন। একটি ছোট কারখানাও রয়েছে তাদের। পুলিশের ভাষ্য মতে, কারখানার শ্রমিকদের বেতন বাবদ ব্যাংক থেকে ছয় লাখ টাকা উত্তোলন করেন তারা। ওই টাকার জন্যই হামলাকারীরা হয়তো এ বাসায় প্রবেশ করেছিলেন এবং হামলা চালায়। পরে ওই ঘটনায় জাহাঙ্গীর নামে এক কর্মচারীকে আটক করে পুলিশ।পাদ্রি পিয়েরোকে হত্যা চেষ্টাদিনাজপুরের মির্জাপুরে ১৮ নভেম্বর সকালে ইতালীয় নাগরিক পিয়েরো পারোলারি সামিওকে গুলি করে দুর্বৃত্তরা। ওই হামলার দায়ও স্বীকার করে আইএস।পিয়ারো ১৯৮৫ সালে দিনাজপুর হাসপাতালে যোগ দেন। সেখানে তিনি একটানা ২৩ বছর কাজ করেন। এরপর ২০০৮ সালে দিনাজপুর সেন্টভিসেন্ট হাসপাতালে যক্ষ্মা রোগ বিশেষজ্ঞ হিসেবে যোগ দেন তিনি। এটিই ছিল তার সর্বশেষ কর্মস্থল।চিকিৎসা সেবার পাশাপাশি ডা. পিয়েরো পাদ্রী হিসেবে মানবসেবায় জড়িত ছিলেন। দিনাজপুর শহরের সুইহারী ক্যাথলিক মিশন চার্চের ফাদার তিনি। দুই দফায় ১৫ বছর ধরে তিনি এ মিশনে কর্মরত আছেন।ওই ঘটনার পর আহত অবস্থায় প্রথমে দিনাজপুরে এবং পরবর্তীতে ঢাকার সিএমএইচে চিকিৎসা শেষে বর্তমানে তিনি আশংকামুক্ত।জাপানি নারীর অস্বাভাবিক মৃত্যু ও দাফনএ বছরের আগস্ট মাসে জাপানি নাগরিক হিরোয়ি মিয়াতোকে অপহরণ করে জাকির পাটোয়ারী রতন নামে তার ব্যবসায়িক পার্টনার। ১৯ নভেম্বর তাকে খুন করা হয়।পুলিশের ভাষ্য মতে, আগস্ট মাসে তাকে অপহরণ করে ভাটারা থানা এলাকার এক বাসায় রাখেন রতন। জাপান দূতাবাস থেকে মৌখিকভাবে জানানোর পর ১৯ নভেম্বর উত্তরা পূর্ব থানায় হিরোয়ি নিখোঁজ থাকার বিষয়ে সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন। অনুসন্ধানের চারদিন পর প্রযুক্তির মাধ্যমে পুলিশ নিশ্চিত হয় ওই জাপানি নারী খুন হয়েছেন। পড়ে জাকিরকে ভারত থেকে আটক করে বাংলাদেশে ফিরিয়ে আনে সিআইডি।হিরোয়ি মিয়োতা উত্তরার ৬ নম্বর সেক্টরে ১৩-বি নম্বর সড়কের ৮ নম্বর হোল্ডিংয়ে সিটি হোমস নামে এক ডরমেটরিতে থাকতেন। এআর/আরএস/এআরএস/এমএস
Advertisement