ঠোঁটে ছ্যাকা খাওয়ার পর মখরম বুঝতে পারল, পানি নয়; সে চুমুক দিয়েছে গরম চায়ে। উপজেলা ভূমি অফিসের পাশ ঘেঁষে পর পর তিনটা টঙ দোকান। তিনটাতেই চাসহ নানান আত্তাবাত্তা জিনিস বিক্রি হয়। মখরমকে ঘন্টায় ঘন্টায় এখানে হাজিরা দিতে হয়। লোকজন নানান কাজকর্ম নিয়ে ভূমি অফিসে আসে। তারা মখরমের হাতে নগদ টাকা-পয়সা তুলে দেয়; সেইসঙ্গে আপ্যায়ন করে ধন্য হতে চায়। মখরম তাদের আবদার ফেলতে পারে না।
Advertisement
ঠোঁটপোড়া চায়ের প্রযোজক একরাম খালাসি। ছয়কে নয় করার শর্তে খালাসির সঙ্গে ২০ হাজার টাকায় চুক্তি হয়েছে মখরমের। অগ্রিম হিসেবে এর ফিফটি পার্সেন্ট আজ মখরমের পকেটে চলে এসেছে। সঙ্গে বাড়তি হিসেবে পাওয়া যাচ্ছে চা-বিস্কিট-পান, বেনসন অ্যান্ড হ্যাজেস। খালাসি কড়কড়ে দশটা এক হাজার টাকার নোট দিয়েছে। নোটগুলো জামার বুকপকেটে রাখা। নতুন নোটের গন্ধ ঠোঁট পোড়ার যন্ত্রণা ভুলিয়ে দিল। মখরম লালপুরি জর্দা দিয়ে পান খেল, তারপর সিগারেটের ধোঁয়া উড়াতে উড়াতে অফিসে ঢুকল।
অফিসের হেডক্লার্ক কার্তিক চন্দ্র মুখ গোমড়া করে বসে আছেন। তার মন-মেজাজ ভয়ানক রকমের খারাপ। এক ‘পার্টির’ সঙ্গে উল্টাপাল্টা কাজ করায় একটু আগে তিনি বসের ধমক খেয়েছেন। মখরম এ খবর জানে না। কার্তিক বাবুকে অফিসের সবাই বড়বাবু বলে সম্বোধন করে থাকে। মখরম বলে বড়সাব। সে ফূর্তিমাখা গলায় বলল- : বড়সাব, খবর শুনছেন? খবরাখবরের ব্যাপারে কার্তিক বাবুর মধ্যে কোনো আগ্রহ দেখা গেল না। তিনি অন্যের খবর কী রাখবেন, আরেকটু হলে আজ তার নিজেরই খবর হয়ে যেত। ঈশ্বর সহায় আছেন, তাই রক্ষা। মেন্দামারা ভাবসাব দেখে এক পার্টির ঘাড় ইচ্ছেমতো মটকাতে চেয়েছিলেন তিনি। এখন তার নিজের ঘাড় নিয়েই টানাটানি। কার্তিক বাবু নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে বসে রইলেন। মখরম হাল ছাড়ল না। সে আগের কথার সূত্র ধরে বলল- : বড়সাব, প্যানডোরা তো বাঙ্গি ফাটাইয়া দিছে ! ময়মনসিংহ অঞ্চলে বাঙ্গি শব্দটা কখনো কখনো বিশেষ অর্থে ব্যবহৃত হয়, যা পুরুষের অন্ডকোষের সমার্থক; তবে এর সঙ্গে প্যানডোরার কী সম্পর্ক? কার্তিক বাবু বইয়ে পড়েছিলেন, গ্রিক পুরাণ অনুযায়ী প্যানডোরা হচ্ছেন পৃথিবীর প্রথম নারী। কোনো নারীর ক্ষেত্রে বাঙ্গি শব্দের ব্যবহার হাস্যকর। কার্তিক বাবুর কাছে বিষয়টা একইসঙ্গে জটিল ও রহস্যময় মনে হলো। তিনি এ ব্যাপারে সংশয় প্রকাশ করতেই মখরম হেসে বলল- : দেব-দেবির বিষয় না বড়সাব। এইটা হইল প্যানডোরা পেপার। পেপার মানে কাগজ। কাগজের মতো একটা জড়বস্তু বাঙ্গি ফাটানোর ঘটনা ঘটিয়েছে, এ কথাও তাকে বিশ্বাস করতে হবে? কার্তিক বাবু অথৈ সাগরে পড়লেন। নাহ ! কোনো কুল-কিনারা পাওয়া যাচ্ছে না। কর্ণফুলি পেপারের নাম জানা আছে তার। প্যানডোরা পেপারের নাম এই প্রথম শুনলেন। শুধু তাই নয়; এটা আবার এমন এক পেপার, যার বাঙ্গি ফাটানোর ক্ষমতা আছে। বিশেষ ক্ষমতাসম্পন্ন এ পেপার কি দেশেই উৎপন্ন হচ্ছে, নাকি বিদেশ থেকে এসেছে? বিদেশের কথা মনে হতেই কার্তিক বাবুর মাথায় প্রথমে এলো চীনের নাম। এমন কোনো জিনিস নেই, যা চীনারা এদেশে পাঠাচ্ছে না। প্যানডোরা পেপার চীন থেকে আমদানি হয়েছে, এটা ধরেই নিলেন কার্তিক বাবু। বললেন-: চীনাদের কামই তো হইল যত আন্দিফান্দি লইয়া ধান্ধা কইরা ডলার কামাই করা।চীনের মধ্যে প্যানডোরা কী করে ঢুকল, মখরম বুঝতে পারল না। সে অবাক হয়ে এ ব্যাপারে প্রশ্ন করতেই কার্তিক বাবু বললেন-: কেন, এইটা মেইড ইন চায়না না?কোথায় চায়না আর কোথায় প্যানডোরা ! কার্তিক বাবুর কথা শুনে মখরম গলা ছেড়ে হাসল। বলল-: আরে বড়সাব! আফনে তো পুরা বিষয়টারে লেপ্টাইয়া ফেলছেন। : কেমনে লেপ্টাইলাম?: শুনেন, বিশ্বের মধ্যে এমন কিছু দেশে আছে, যেখানে সরকারি ট্যাক্স-ভ্যাট ফাকি দেওয়া সহজ। সেইসব দেশে ভুয়া কোম্পানি খুইলা মালকড়ি রাইখা দিলে পোকায় কাটে না; রাষ্ট্র কিংবা অন্য কেউ জানতেও পারে না। মানুষের অর্থকড়ি নিরিবিলি থাকে। ট্যাক্স ফাকি ও অর্থ সুরক্ষার কথা শুনে কার্তিক বাবু নড়েচড়ে বসলেন। বিশ্বের বুকে এমন দেশও যে আছে, তা জানা ছিল না কার্তিক বাবুর। এখন জানলেন। কার্তিক বাবু একটা লম্বা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন। বিশ্বে ২শ’র অধিক দেশ আছে; অথচ তিনি আঙুলের কড় গুণে কেবল আমেরিকা, ইন্ডিয়া, নেপাল, ভূটান, সৌদি আরব, জাপান, ইতালি, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুরসহ আরও কিছু দেশের নাম উচ্চারণ করতে পারেন! নিজের জ্ঞানভাণ্ডারের এ দশা দেখে নিজের ওপর খুব করুণা হলো তার। মনে মনে বললেন, ছাতার মাথার জমির খতিয়ান-দাখিলা-নামজারি-জমাখারিজ এবং একর-শতাংশের চক্করে পড়ে জীবনটাই বরবাদ হওয়ার পথে। হা ঈশ্বর ! কত কিছু দেখার ছিল, কত কিছু জানার ছিল ! কিছুই দেখা হলো না। কিছুই জানা হল না। কার্তিক বাবু চুন-খয়েরের আস্তর পড়া জিহ্বা বের করে নিজের অজ্ঞতা প্রকাশ করলেন। বললেন-: এমন দেশও আছে নাকি?: আছে মানে? সেইসব দেশেই তো ঘটনার সূত্রপাত, যা লইয়া দুনিয়া জুইড়া হাউকাউ শুরু হইছে। : কীসের হাউকাউ?: আরে বড়সাব! আপনে দেখতেছি দেশ-বিদেশের কোনো খবরই রাখেন না !: জমির কোণাকানি ভাঙ্গতে গিয়া ডাইনে-বামে তাকানোর ফুসরৎ পাই না। দেশ-বিদেশের খবর কেমনে রাখবাম! থাক এইসব বারোমাইস্যা দুঃখের কাহিনী। আসল ঘটনা কী, সেইটা বলেন। : ঘটনার বিষয়ে তো প্রথমেই বলছি, বাঙ্গি ফাটাইয়া দিছে। : কার বাঙ্গি কে ফাটাইছে ?: বাঙ্গি ফাটাইছে প্যানডোরা পেপার। আর যাদের ভাঙ্গি ফাটছে, তারা সবাই বিশ্বের নামীদামি মানুষ। আবার প্যানডোরা ! আবার বাঙ্গি ফাটার কাহিনী। কার্তিক বাবু উত্তেজিত হয়ে উঠলেন। বললেন-: সেই কখন থেইকা প্যানডোরা পেপার আর বাঙ্গি ফাটার বয়ান করতেছেন। ধুন্দামার্কা কথাবার্তা রাইখা পুরা বিষয়টা পরিষ্কার কইরা বোঝান তো।
পত্র-পত্রিকা মারফত প্যানডোরা পেপারবিষয়ক যত জ্ঞান এই কয়দিনে অর্জিত হয়েছে, তার সবটাই উগড়ে দিল মখরম। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ, বিশেষ করে ধনী ও উন্নত দেশগুলোর ভিভিআইপিরা ট্যাক্স ফাঁকি দেওয়ার উদ্দেশ্যে কী কী পন্থায় ট্যাক্স হ্যাভেন বলে কথিত দেশগুলোয় কোম্পানি বা ব্যবসার পত্তন করে টাকা পাচারজনিত দুর্নীতির সঙ্গে নিজেদের জড়িয়েছে, তা সহজভাবে কার্তিক বাবুর সামনে উপস্থপান করার পর মখরম বলল- : প্যানডোরা পেপার যাদের বাঙ্গি ফাটাইছে, তাদের মধ্যে জর্ডানের বাদশা আবদুল্লাহ, রাশিয়ার প্রেডসডেন্ট পুতিনসহ আরও অনেক হোমরাচোমরা আছেন। কার্তিক বাবু খুবই হলেন। সরু চোখে মখরমের দিকে তাকিয়ে বললেন-: আজব কারবার তো ! এইসব মানুষ তো দেশেই ব্যাপক ক্ষমতার অধিকারী। তারা আমার-আপনের মতো নসুফুসু মার্কা মানুষ না। তাদের টাকাপয়সা গোপনে সংরক্ষণ করার প্রয়োজন কী?কার্তিক বাবুর কথা শুনে মখরম ঘাড় নাড়ল। বলল- : প্রয়োজন আছে না? চিরদির তো কেউ আর ক্ষমতায় থাকে না। ক্ষমতা চইলা গেলে, এমন কী মরহুম হয়ে মাটিতে বিছানা পাতার পর ওইসব মানুষের গচ্ছিত রাখা অর্থসম্পদ ঠিকই রইয়া যায়, যা তার নাট-বল্টুরা ভোগ করতে পারে। এই প্রক্রিয়ায় হোমরাচোমরা লোকজনের অর্থসম্পদ গোপনে সংরক্ষণ করার ডকুমেন্টই হইল বাঙ্গি ফাটাইন্যা প্যানডোরা ডকুমেন্ট। আপনেরে আরেকটা খবর দেই। : কী খবর? : প্যানডোরা পেপার কেলেংকারির সঙ্গে আমাদের আত্তা ভাই পাকিস্তানের অনেক হোমরা-চোমরাও জড়িত। : বলেন কী ! পাস্তিান হইল চানতারা মার্কা পতাকার দেশ!: বড়সাব ! আপনের কি ধারণা, চানতারা মার্কারা ফেরেশতা? : ফেরেশতা না হইলেও তারা ইহকাল-পরকাল মানে। অনেক নিয়ম-কানুনের মধ্যে থাকে। : রাখেন আপনের নিয়ম-কানুন। যত বড় নিয়ম মাইন্যকারীই হোক, একটা পর্যায়ে যাওয়ার পর সবাই খাদক নম্বর ওয়ান হইয়া যায়। আর খাদকরা কখনোই খালি হাঁড়ি চাটে না। চানতারাই হোক আর কাস্তে হাতুড়িই হোক, যেখানে নরম মাংস থাকে, বাইছা বাইছা সেইখানে তারা কামড় বসায়। : তার মানে সব মাছেই পোকা খায়, দোষ হয় কেবল চুইন্যাপুঁটির।: ঠিক ধরছুইন বড়সাব। এসি ল্যান্ডের কাছ থেকে একটা ফাইল এসেছে। কার্তিক বাবু সেটা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। মখরম উসখুশ করছিল কখন কার্তিক বাবুর কাজ শেষ হবে। কাজ শেষ হতেই মখরম আর দেরি করল না। বলল-: বড়সাব, আমার মনে একটা ভাবনার উদয় হইছে। : কী ভাবনা?: আমরার এই অফিসে বড়স্যার থেইকা শুরু কইরা মাইজলা স্যার, অফিসার-পিয়ন-কর্মচারি সবাই মিইলা মাসে কত টাকা ঘুষ খাই?অফিসে বারো রকম মানুষের যাতায়াত। এভাবে প্রকাশ্যে ঘুষ খাওয়ার প্রসঙ্গ উঠানো কি ঠিক হচ্ছে? কার্তিক বাবু মখরমকে সতর্ক করার জন্য গলা খাঁকারি দিলেন। মখরমের অ্যান্টেনায় এ সতর্কবার্তা কোনো রেখাপাত করল না। সে তার আগের বক্তব্যের ধারাবাহিকতা বজায় রেখে বলল-
Advertisement
: আমরা ঘুষ খাইলেও মানুষের সঙ্গে মোনাফেকি করি না। কারও কাছ থেইকা টাকা নিলে বিনিময়ে তার কাজ কইরা দেই। তার উপকার করি। সবচেয়ে বড় কথা হইল, আঙুলের চিপা দিয়া অল্প যে কয়টা টাকা আমরার পকেটে ঢুকে, সেইটা আমরা দেশেই খরচ করি। ফলে সরকার ভ্যাট ও ট্যাক্স হিসেবে এই টাকার একটা অংশ পায়, যা দেশের উন্নয়নে কাজে লাগে। এখন আপনে আমারে বলেন, আসল দুর্নীতিবাজ কারা? আমরা, নাকি যারা ট্যাক্স ফাঁকি দেওয়ার জন্য ভুয়া কোম্পানির নামে বিদেশে টাকা পাচার করে, তারা?
কার্তিক বাবু দুর্নীতিবাজ হিসেবে দেশ থেকে টাকা পাচারকারীদের চিহ্নিত করলেন। কার্তিক বাবুর মতামত শুনে মখরম খুশি হলো; বলল- : অথচ আজব তামশা কী দেখেন, যখনই দুর্নীতির প্রসঙ্গ উঠে, ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল(টিআই)আমরার ভূমি অফিসসহ অন্যান্য প্রাতিষ্ঠানিক খাতের হালকা-পাতলা দুর্নীতির তথ্য-উপাত্ত দিয়া দুর্নীতিতে বাংলাদেশরে চ্যাম্পিয়ন ঘোষণার তালে থাকে। এইটা কি ঠিক?ঠিক, না বেঠিক- এ নিয়ে কার্তিক বাবু কোনো মতামত পেশ করার আগেই মখরম পুনরায় বলল-: একটা কাজ করলে কেমন হয়, বড়সাব?: কী কাজ?: চলেন, আমরা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের বিরুদ্ধে একটা বিবৃতি মাইরা দেই।: বিবৃতিতে কী বলবেন?: বলবাম, অই মিয়ারা ! তোমরা বিশ্বব্যাপী দুর্নীতির ব্যাপারে তথ্য সংগ্রহ করো। গবেষণা করো। এখন প্যানডোরা পেপার সামনে রাইখf ঈমানে কওছে দেখি, প্রকৃতপক্ষে দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ন কি আমরা; নাকি বাঙ্গিফাটারা?
লেখক : সাংবাদিক।mokamia @hotmail.com
এইচআর/জিকেএস
Advertisement