মো. আমিনুল ইসলাম (৬০)। প্রায় দুই যুগ ধরে নগরীর নওদাপাড়া এলাকায় বসবাস করছেন তিনি। সিনিয়র অফিসার হিসেবে কর্মরত ছিলেন রাজশাহী জনতা ব্যাংকের বিভাগীয় অফিসে। চলতি বছরের ৪ ফেব্রুয়ারি নিয়েছেন অবসর। তবে দীর্ঘদিন ধরে ছাদ বাগানের অভ্যস্ত তিনি।
Advertisement
ইউটিউব দেখে নিজের তিনতলা ভবনের ছাদে ছোট একটি টবে পিঙ্ক রোজ জাতের ড্রাগনের চারা গাছ রোপণ করেছিলেন। সেই একটি চারা থেকে আজ ৮০টি ড্রাগন গাছ হয়েছে আমিনুল ইসলামের ছাদ বাগানে।
গত সোমবার (০৪ অক্টোবর) সকালে অবসরপ্রাপ্ত ব্যাংক কর্মকর্তা আমিনুল ইসলামের ছাদ বাগানে সরেজমিনে দেখা গেছে বেশ পরিপাটি করেই সাজিয়ে রেখেছেন তিনি। ছাদের পূর্ব পাশে দুই পাশে রয়েছে দুটি ড্রাগনের বাগান। প্রথমদিকে প্রায় শখের বসে বাড়িতে পরিত্যক্ত পুরনো পাইপ ও বাঁশ দিয়ে চারকোণা সেড তৈরি করেছিলেন।
পরবর্তীতে পাশে আরও একটি সেট তৈরি করেছেন চারদিকে সিমেন্টের ঢালাই ও পাইপের দ্বারা। পূর্বে আরও তিনটি টবে ড্রাগন গাছ রয়েছে। বর্তমানে তার ছাদে রয়েছে ৮০টি ড্রাগন গাছ। প্রতিটি গাছেই ফুল ও কাঁচা-পাকা ফলের সমারোহ দেখা গেছে।
Advertisement
কৃষিবিদ ও চাষিদের ভাষ্যমতে, ছাদে ড্রাগন গাছ লাগাতে হলে প্রয়োজন একটি বড় ড্রামের। কিন্তু সকলকে তাক লাগিয়ে আমিনুল ইসলাম ৮/১০ ইঞ্চি ও ১০/১২ ইঞ্চির ছোট টবে গাছ লাগিয়েছেন এবং পেয়েছেন সফলতা। ছোট টবে সঠিক পরিচর্যার মাধ্যমে তিনি পেয়েছেন সুস্বাদু ও পরিপক্ক ফলন।
আমিনুল ইসলামের ছাদ বাগানে শুধু ড্রাগন গাছই নয়, সাথে রয়েছে লেবু, পেয়ারা, মরিচ, আম গাছ, পুদিনাপাতা, লেমন গ্রাস, পামট্রি, তুলসি, সাইকা, সিডলেস বড়ই, স্ট্রবেরি পেয়ারা, সাদা জামের গাছ ও কারিপাতাসহ অন্যান্য গাছ। এসব গাছ পরিচর্যার জন্য সিঁড়িঘরে রয়েছে নিড়ানি, কাঁচি, কাটিংপ্লাস, রশি, স্প্রেমেশিন।
এছাড়াও সার ও কীটনাশক হিসেবে রয়েছে- নিমখৈল, শিংকুচি, হারেরগুড়ো, কোকোপিট, জৈবসার, কম্পোস্ট সার। ড্রাগনগাছকে সতেজ রাখার জন্য রয়েছে বুস্টার ঔষধ এবং ড্রাগন গাছে ফুল আসার জন্য রয়েছে ফ্লোরা নামের আরেকটি ঔষধ।
আমিনুল ইসলাম বলেন, ২০০৬ সাল থেকে ছাদ বাগান শুরু করি। প্রথমদিকে আমি ও আমার স্ত্রী বিভিন্ন ফুলের গাছসহ পামট্রি, সাইকা, লেবু, মরিচ, পেয়ারা প্রভৃতি গাছ লাগিয়েছিলাম। তবে ২০১৩ সালে আমার স্ত্রী মারা যাওয়ায় আগ্রহ হারিয়ে ফেলি। এ কারণে প্রায় শতাধিক গাছও মারা যায়।’
Advertisement
ছাদে ড্রাগন চাষে কিভাবে আগ্রহী হলেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘২০১৭ সালে অফিসে বসে ইউটিউবে ড্রাগন ফল সম্পর্কে দেখি। সেই থেকে আগ্রহ জন্মে এর প্রতি। এরপর বাড়িতে একটি চারা রোপণ করি। ২০১৮ সালের ওই গাছটিতে ৩টি ফুল ফোটে, তাতে ১টি ড্রাগন ফল ধরে। পরে এলাকার সার-কীটনাশকের দোকানে গিয়ে পরামর্শ নিই। পরামর্শ অনুযায়ী সঠিকভাবে পরিচর্যা নেবার পর পরের বছর অর্থাৎ ২০১৯ সালে ২৬টি ফল পাই, ২০২০ সালে পাই ২০০টি এবং চলতি বছরে প্রায় ৩৫০টি ফল পেয়েছি। বর্তমানে কাঁচা-পাকা মিলে ৩৭টি ফল রয়েছে এবং পরাগায়িত ফুল রয়েছে ২১টি। সেই একটি চারা থেকে বর্তমানে ছাদ বাগানে ৮০টি ড্রাগন গাছ রয়েছে।
অবসরপ্রাপ্ত এই ব্যাংক কর্মকর্তা বলেন, ‘৮/১০ ইঞ্চি ও ১০/১২ ইঞ্চির টবে ড্রাগন গাছগুলো লাগানো হয়েছে। ছোট টবে গাছ লাগানোর পরও সফল হাওয়ায় অনেকেই অবাক হয়েছেন। আমার এই সফলতার গল্পটি ফেসবুকের ‘ছাদ বাগান’ নামের একটি গ্রুপে শেয়ার করেছি। এতে অনেকেই আমার কাছে ছাদে ড্রাগন চাষের পরামর্শ চেয়েছেন। এমনকি বড় বড় চাষিরাও আমার সফলতায় অবাক হয়েছেন। তারাও জানতে চেয়েছেন ছাদ ড্রাগন বাগান সম্পর্কে।’
আমিনুল ইসলামের দাবি, তার ছাদ বাগানের ড্রাগন ফল বাজারে বিক্রি করা ফলের চাইতে বহুগুণ সুস্বাদু। তার প্রতিটি ফলের ওজন ১৫০ গ্রাম। সর্বোচ্চ ৩৮৫ গ্রাম ওজনের ড্রাগন ফলও হয়েছে তার ছাদ বাগানে। তিনি কখনই তার বাগানের ফল বিক্রি করেন না।
তবে কেউ চাইলে তাকে এমনিতেই দিয়ে দেন। টানা দুই বছর তার চাচাতো ভাইয়ের এক প্রতিবন্ধী মেয়েকে দিয়েছেন তার বাগানের ফল। এছাড়াও আত্মীয়-স্বজন প্রতিবেদশীদের মধ্যে বিলি করতে পচ্ছন্দ করেন তিনি।
‘ইতিমধ্যে আমি আমার অফিসের কলিগ, প্রতিবেশীসহ প্রায় দু’শজনেরও বেশি মানুষকে চারা বিতরণ করেছি। এমনকি ঢাকা, সিরাজগঞ্জ, নাটোর, চাপাইনবাবগঞ্জ, বাগমারা প্রভৃতি জায়গা থেকে যারা চেয়েছেন তাদেরকে নিজ খরচে বিনামূল্যে কুরিয়ার করে চারা পাঠিয়েছি। আমার ছাদ বাগান দেখে বাড়ি আশপাশের প্রায় ২৫ থেকে ৩০টি বাড়িতে ছাদ বাগান করেছে এবং ড্রাগন গাছ লাগিয়েছেন। তারা প্রায়ই আমাকে পরামর্শ নেওয়ার জন্য কল করে থাকেন বলে জানান তিনি।’
আমিনুল ইসলামের এই কাজে সহযোগিতা করেন তার ছোট মেয়ে আজিজা তাসনিম তনি (১৯) ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ম্যানেজমেন্ট বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষে পড়ুয়া ভাগ্নে নাজিরুজ্জামান নাইম (২১)। তারা অনেক সময় ছাদের বাগানে সময় দেন।
আমিনুল ইসলাম বলেন, নিজ হাতে কৃত্রিমভাবে পরাগায়ন করলে ফলন ভালো হয়। আর এ কাজে আমার মেয়ে বেশ সহযোগিতা করে। চলতি বছরে একদিনেই ৭৮টি ফুলের পরাগায়ন করেছে সে। গত বছরে সর্বোচ্চ ৬৩টি পরাগায়ন করেছিল। অন্যদিকে ভাগ্নে নাইম বাগানে সব ধরনের পরিচর্যায় সহযোগিতা করে থাকে। তারা দু’জনেই আমার মতো ছাদ বাগানপ্রেমী হয়ে উঠেছে।
নাজিরুজ্জামান নাইম বলেন, ‘যখনই সময় পায় মামার ছাদ বাগানে সময় দেওয়ার চেষ্টা করি। গত মাসে আমাদের ছাদ বাগান নিয়ে ফেসবুকের ‘ছাদ বাগান’ নামের একটি গ্রুপে আমাদের বাগানের ভিডিও দিয়েছিলাম। সেখানে ৬ হাজার লাইক ও ৫০ হাজার ভিউ হয়। অনেকেই সেখানে পরামর্শ চেয়েছেন ছাদে ড্রাগন চাষের বিষয়ে। আমরা বহু মানুষকে সহযোগীতাও করেছি এবং করে যাচ্ছি।’
এ বিষয়ে রাজশাহী ফল গবেষণা ইনস্টিটিইউটের বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা জিএমএম আব্দুল বারী ডলার বলেন, ‘মাটি কম-বেশি হওয়ায় কিংবা বড় ড্রামে গাছ লাগানোতে ড্রাগন চাষে সফলতা আসে না। সফলতা আসে ড্রাগন চাষে সঠিকভাবে পরিচর্যার কারণে। আমিনুল ইসলাম সঠিক পরিচর্যার কারণেই ছাদ বাগানে সফলতা পেয়েছেন।’
তিনি বলেন, ‘কয়েকটি কারণে ছাদ বাগানে ড্রাগন চাষ বেশ যুতসই। সেটি হচ্ছে, ড্রাগন গাছ কেমিক্যালের চাইতে জৈব সার বেশি পচ্ছন্দ করে। রাতে ফুল ফোটার কারণে প্রাকৃতিক পরাগায়ন হয় না, এক্ষেত্রে হাত পরাগায়ন বেশ কার্যকর যা ছাদ বাগানে সম্ভব। পানির যথাযোগ্য ব্যবহার। কারণ, ফুল ফোটার সময় গাছে পানি কম দিতে হবে। বেশি পানি হলে ফুল ঝরে যায় বা নষ্ট হয়ে যায়। এছাড়া ডাল গুলো ঝুলানোর ব্যবস্থা যতকরা যাবে ততই ফুল ও ফল হয়।’
ফয়সাল আহমেদ/এমএমএফ/জিকেএস