জার্মানিতে অবৈধভাবে বসবাসরত আটক ৮১৬ জন অভিবাসনপ্রত্যাশী বাংলাদেশিকে ইইউ- জার্মানির চাপে বাংলাদেশ সরকারের সিদ্ধান্তে ফেরত পাঠাচ্ছে বার্লিনের বাংলাদেশ দূতাবাস। সবকিছু ঠিক থাকলে চলতি মাসের ২৬ তারিখে অভিবাসনে ব্যর্থ প্রায় ৫৫ জন বাংলাদেশিকে পাঠানোর বিষয়টি চূড়ান্ত বলে জানা গেছে।
Advertisement
জার্মানিতে নিযুক্ত রাষ্ট্রদূত মো. মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া বলেন, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ জার্মানির চাপে নানা কারণে অবৈধ হয়েপড়া এসব বাংলাদেশিকে ফেরত পাঠাতে হচ্ছে। যাদের ফেরত পাঠানো হবে তাদের সব তথ্য এরই মধ্যে দেশের কয়েকটি গোয়েন্দা সংস্থার মাধ্যমে যাচাই করা হয়েছে। ফেরত পাঠানোর দিনে যেকোনো ধরনের পরিস্থিতি মোকাবিলায় সঙ্গে থাকবে জার্মানির কমপক্ষে ১৫০ জনের বিশেষ একটি বাহিনী। এরই মধ্যে বার্লিনের বাংলাদেশ দূতাবাস থেকে তারা ভিসাও নিয়েছেন বলে জানান তিনি।
দীর্ঘদিন ধরে দেশটির বিভিন্ন প্রদেশে আটক অভিবাসনপ্রত্যাশী এসব অবৈধ বাংলাদেশির কারণে দুই দেশের মধ্যে সম্পর্কের অবনতির বিষয়ে রাষ্ট্রদূত জানান, রাজনৈতিক-সামাজিক ও পারিবারিক নানা বিষয় ভেবে তাদের ফেরত পাঠানো সম্ভব হয়নি। তাদের বিষয়ে সব তথ্য-উপাত্ত হাতে আসার পর এই সিদ্ধান্ত নেওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না। সত্যিকার অর্থে এখানে দ্বিতীয় কোনো পথ নেই।
তিনি আরও বলেন, দুই দেশের মধ্যে চলমান সম্পর্ক আরও জোরদার করতেই ইউরোপে বাংলাদেশের সব দূতের সঙ্গে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বৈঠক হয়। আমরা সবাই অবৈধদের ফেরানোর বিষয়ে একমত হয়েছি। যদি বাংলাদেশ এই কঠিন সিদ্ধান্ত না নেয়, তাহলে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) থেকে নানা বাধার মুখে পড়বে।
Advertisement
রাষ্ট্রদূত জানান, আদম দালালদের মাধ্যমে অনেক কষ্ট করে কয়েক দেশ ঘুরে অবৈধ পথে আর নয়। বরং, উচ্চশিক্ষা ও কারিগরি শিক্ষার মাধ্যমেই জার্মানিতে নিরাপদ অভিবাসন এখন অনেকটাই সহজ। ইউরোপের বিভিন্ন দেশে অবস্থানকারী অবৈধ বাংলাদেশিদের ফিরিয়ে আনা হচ্ছে। ইইউ’র সঙ্গে সম্পাদিত স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রসিডিউর (এসওপি) চুক্তির আলোকে সরকারকে এটি করতে হচ্ছে। অবৈধ বাংলাদেশিদের নাগরিকত্ব নিশ্চিত করতে এক্ষেত্রে সরকার নির্বাচন কমিশনের এনআইডি উইং ও পুলিশের বিশেষ বিভাগসহ একাধিক সংস্থার সমন্বয়ে কার্যকরী পদক্ষেপ নিয়েছে।
তিনি জানান, ইউরোপে অবস্থানকারী রোহিঙ্গাসহ ভিনদেশি অনেকেই বাংলাদেশের নাগরিক বলে দাবি করায় ঢাকাকে এই বিশেষ উদ্যোগ নিতে হয়েছে। এছাড়া ইইউ নানা শর্ত জুড়ে দিচ্ছে।
জানা যায়, যদি অবৈধদের বাংলাদেশ ফিরিয়ে না নেয় তাহলে শেনজেন ভিসা সুবিধা পাবে না বাংলাদেশ।পাশাপাশি সরকারি কর্মকর্তাদের যে এক বছরের ভিসা দেওয়া হয়, তার সময়কালও কমিয়ে দেবে তারা। এর বাইরে আরও কিছু জটিল শর্ত জুড়ে দিয়েছে বলে কূটনীতিক সূত্র নিশ্চিত করেছে।
ইইউ বলছে, ইউরোপের শেনজেনভুক্ত ২৬টি দেশেই অবৈধ বাংলাদেশি রয়েছে। এসওপি চুক্তি অনুযায়ী এই অবৈধ অভিবাসীদের বাংলাদেশকে ফেরত নিতে হবে। এ ব্যাপারে বারবার ঢাকাকে তাগিদ দিয়েছে সংস্থাটি। ইইউ’র সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে সরকার এই প্রত্যাবাসনকে গুরুত্বের সঙ্গে দেখছে। এ বিষয়ে বিভিন্ন সংস্থার সমন্বয়ে একাধিক বৈঠকও অনুষ্ঠিত হয়েছে বলে জানা যায়।
Advertisement
ইউরোপীয় ইউনিয়নে অনুপ্রবেশকারীদের সংখ্যার বিবেচনায় শীর্ষে রয়েছে যুদ্ধবিধ্বস্ত সিরিয়া ও আফগানিস্তান। বিশেষ করে গৃহযুদ্ধকবলিত সিরিয়ার মানুষজন প্রাণ বাঁচাতে ইতালি ও গ্রিস হয়ে ইউরোপে প্রবেশ করছে। ইইউ’র হিসাব মতে, অনুপ্রবেশকারীদের সংখ্যার বিবেচনায় বাংলাদেশের অবস্থান ৩০টি দেশের মধ্যে ১৬তম স্থানে।
অভিবাসন ইস্যুতে ইইউ সদস্য দেশগুলোর সঙ্গে নতুন চুক্তির আওতায় অবৈধ বাংলাদেশিদের ইউরোপে থাকার সুযোগ উঠে গেছে। চুক্তি অনুযায়ী, ২০১৯ সালে মধ্যে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার আহ্বান জানিয়েছিল ইইউ।
অবৈধ বাংলাদেশিদের ফেরত আনতে ২০১৯ সালের শুরুর দিকে এনআইডি উইংয়ের সার্ভিস সংশ্লিষ্ট এপিআই সংক্রান্ত সভা অনুষ্ঠিত হয়। ২০১৯ সালের ২০ মে সভার কার্যবিবরণী পর্যালোচনা করে জানা যায়, ইউরোপে অবস্থিত অবৈধ বাংলাদেশিদের ফেরত না আনলে সেখানে বসবাস করা বৈধ বাংলাদেশিরাও সমস্যার সম্মুখীন হবেন।
প্রাপ্ত তথ্যমতে, এসওপির অংশ হিসেবে এরই মধ্যে জার্মানি, নরওয়ে, গ্রিস থেকে বেশকিছু অবৈধ বাংলাদেশিকে ফেরত আনা হয়েছে। তবে সমস্যা তৈরি করছে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত, পাকিস্তান ও মিয়ানমারের রোহিঙ্গারা। তাদের অনেকেই এখন নিজের পাসপোর্ট ফেলে দিয়ে নিজেদের বাংলাদেশি নাগরিক হিসেবে পরিচয় দিচ্ছেন।
এরই প্রেক্ষিতে ইউরোপে অবস্থিত অবৈধ বাংলাদেশিদের ফিরিয়ে আনতে সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী পুলিশের স্পেশাল ব্র্যাঞ্চের (এসবি) একটি ইন্টারফেস তৈরি করা হয়। এটার সহায়তায় অবৈধদের তথ্য এনআইডি, ডিআইপি ও বিএমইটি, এপিআইয়ের (ডেটা ভার্সন) সংরক্ষিত ডেটার সঙ্গে মিলিয়ে দেখা হবে। সেখানে ফিঙ্গারপ্রিন্টের মাধ্যমে নাগরিকত্ব নির্ধারণের সুযোগ রয়েছে, যা এপিআই ও এসবির ইন্টারফেসের সঙ্গে সিক্রোনাইজ করে প্রস্তুত করা হয়।
এক্ষেত্রে অবৈধ বাংলাদেশির ফিঙ্গারপ্রিন্ট ডব্লিউএসকিউ ফরমেটে এসবি থেকে ইইউ’র কাছ থেকে সংগ্রহ করার পর নির্বাচন কমিশনে পাঠানো হয়। কমিশন আঙুলের ছাপ যাচাই করে এসবির কাছে ফিরতি তথ্য পাঠায়।
তবে জার্মানিতে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া বলছেন, বাংলাদেশ সরকারের বিভিন্ন সংস্থার নিশ্চয়তা আর ক্লিলিয়ান্সের পর আমরা বাংলাদেশি পরিচয় নিশ্চিত হয়ে তাদের দেশে ফেরত পাঠাচ্ছি। চলতি মাসের একটি ফ্লাইটে ৫৫ জন অবৈধ বাংলাদেশিকে দেশে ফেরত পাঠানো হচ্ছে। অনেকে নিজ উদ্যোগে দেশে ফেরত গেছেন। অন্যদের যাবতীয় প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে পর্যায়ক্রমে পাঠানো হবে বলে জানান তিনি।
ইউরোস্ট্যাটের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০০৮-১৫ সময়ের মধ্যে মোট ৯৩ হাজার ৪৩৫ জন বাংলাদেশি অবৈধভাবে ইউরোপে অনুপ্রবেশ করেন। ২০১৬ সালে সেই সংখ্যা দাঁড়ায় ১০ হাজার ৩৭৫ জন। ২০১৭-২০২০ সালে আরও কিছু অবৈধ বাংলাদেশির অনুপ্রবেশ ঘটেছে বলে ধারণা করছেন সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।
২০১৪ সাল থেকে অভিবাসীদের নিয়ে কড়াকড়ি আরোপ করে ইইউ। দীর্ঘদিন ধরে অনুপ্রবেশ করা এসব অভিবাসীরা মূলত মানবপাচারের শিকার। তাদের বেশিরভাগই সমুদ্রপথে ইতালি হয়ে ইউরোপে প্রবেশ করেছে। মানবপাচার ঠেকাতে এই পথ বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নেয় ইইউ। এ পথে আসা বেশিরভাগই মধ্যপ্রাচ্য, উত্তর আফ্রিকা, আফগানিস্তান, পাকিস্তান ও বাংলাদেশের নাগরিক।
সম্প্রতি লিবিয়া উপকূলে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপে অনুপ্রবেশের আগে নৌকাডুবে বাংলাদেশের কয়েকজন মারা যান। এরপরই নতুন করে অবৈধ বাংলাদেশিদের ফেরত আনতে তোড়জোড় শুরু হয়। এ কাজের সঙ্গে যেসব সংস্থা বা প্রতিষ্ঠান জড়িত তারাও তৎপর হয়ে উঠেছে।
এ বিষয়ে কমিউনিটি নেতা সেলিম ভূঁইয়া বলেন, আসলে ইউরোপের অন্য দেশের চেয়ে জার্মানির অভিবাসননীতি ভালো কিন্তু ভাগ্য অন্বেষণে আসা এসব তরুণদের দেশে ফিরতে হচ্ছে, নতুবা দুই দেশের সঙ্গে কূটনীতিক সম্পর্কের অবনতি হবে।
ডুসেলডর্ফে বসবাস করা বাংলাদেশি ব্যবসায়ী বকুল ভূঁইয়া বলেন, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও জার্মানির অনবরত চাপের মুখে বাংলাদেশ সরকার তাদের ফিরিয়ে নিতে বাধ্য হচ্ছে। তবে আমাদের দেশের তরুণদের বৈধ উপায়ে আসার চেষ্টা করতে হবে। কারিগরি শিক্ষার মাধ্যমে বৈধ ভিসা নিয়ে আসলে জার্মানিতে জীবনযাপন সহজ হবে বলে মন্তব্য করেন তিনি।
এআরএ/এমআরএম