দেশজুড়ে

লোকমানের হত্যাকারীর সঙ্গে স্ত্রীর ফোনালাপ নিয়ে শহর জুড়ে তোলপাড়

নরসিংদীর পৌর নির্বাচনে কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে মেয়র প্রার্থী কামরুজ্জামান কামরুল। একদিকে প্রবীণ আওয়ামী লীগ নেতাদের ক্ষোভ। অন্যদিকে পারিবারিক কলহ নৌকা প্রতিককে ঘাম ঝড়ানো অবস্থার মুখোমুখি করে তুলেছে। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে সম্প্রতি লোকমান হোসেন হত্যা মামলার আসামি পলাতক মোবারক হোসেনের সঙ্গে তামান্না নুসরাত বুবলীর ফোনালাপ। যেখানে তিনি স্বামীর হত্যাকারী হিসেবে চার্জশিটভুক্ত আসামির সঙ্গে ফোনে পারিবারিক অশান্তির কথা প্রকাশ করেছেন। ওই রেকর্ডেও পারিবারিক বিদ্রোহের সূর পাওয়া গেছে। বুবলী হচ্ছেন লোকমানের স্ত্রী। নরসিংদীর বিভিন্ন ব্যক্তির ফেসবুকে ফোনালাপের এসব রেকর্ড আপলোড করা হয়েছে। এদিকে নরসিংদী পৌর এলাকাকে ডেঞ্জার জোন হিসেবে তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। দলীয় কোন্দলের কারণে বিক্ষুব্ধ আওয়ামী লীগ দুই ভাগ হওয়ায় এই অবস্থা। এক পক্ষ নৌকা প্রতীকের পক্ষে নামলেও অপর আরেক পক্ষের নেতারা এক অভিনব কৌশলে দলের বিদ্রোহী প্রার্থী এসএম কাইয়ুমের মোবাইল প্রতীকে ভোট চাচ্ছেন। এই মোবাইলের মাধ্যমেই ভোটারদের বলা হচ্ছে ‘ভাই মোবাইলে কিন্তু একটি মিসকল’ দিয়েন। গোপনে ভোটারদের কাছে আওয়ামী লীগ নেতাদের এই কৌশলী অবস্থান নৌকা প্রতীককে কোণঠাসা অবস্থায় ফেলেছে বলে মনে করছেন এলাকার সচেতন ভোটাররা। প্রয়াত মেয়র লোকমান হোসেনের ছোট ভাই নৌকা প্রতীকধারী কামরুল। কাইয়ুম হচ্ছেন লোকমানের ঘণিষ্ট সহযোগী। যিনি মোবাইল প্রতীক নিয়ে মেয়র পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নেমেছেন। এই শক্তিশালী দুই প্রতিদ্বন্দ্বীর মাঝখানে ধানের শীষের অবস্থান কোথায় গিয়ে ঠেকেছে সেই হিসেব কারো কাছেই নেই। বুবলীর ফোনালাপ : তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, লোকমান হত্যা মামলার চার্জশিটভুক্ত আসামি মোবারক হোসেন ওরফে হাজারী ফকির। তিনি লোকমানের ঘণিষ্ট বন্ধুদের একজন। ফোনালাপে বুবলী আসামি মোবারককে হাজারী ফকির ভাই হিসেবে সম্বোধন করেন। জেলা ছাত্রলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক রেহানুল ইসলাম ভূইঞা লেলিন টেলি কনফারেন্সের মাধ্যমে তাদের ফোনালাপের মধ্যস্ততা করেন বলে জানা যায়। তার বাড়ি পৌর এলাকার দত্তপাড়ায়। ঘটনার আগে থেকেই তিনি দেশের বাইরে পলাতক। পৌর নির্বাচনের ডামাঢোল শুরু হলে বুবলীর সঙ্গে কয়েক দফায় কথা হয় মোবারকের। তথ্যনুসন্ধানে নরসিংদীর রেহানুল ইসলাম ভূইয়া লেলিনের ফেসবুক থেকে ফোনালাপের এই অডিও রেকর্ডের কপি সংগ্রহ করা হয়। এ বিষয়ে জানতে চাইলে লেলিন বলেন,  লোকমান হত্যাকারীর সঙ্গে বুবলী ভাবী কথা বললে দোষ হয় না। আমি আপলোড করলে দোষ কি? ভাবীর পারিবারিক অশান্তির কথা আমার সহ্য হয়নি। দীর্ঘ ৪/৫ ঘণ্টার এই ফোনালাপে বুবলী মেয়র কামরুল, তার স্ত্রী, দেবর ও শাশুড়ির জ্বালা-যন্ত্রণার কথা প্রকাশ করেন। এই ফেসবুক থেকে হাজার হাজার একাউন্টে তা শেয়ার হওয়ায় নরসিংদীতে রীতিমত তা নিয়ে তোলপাড় চলছে। সবার মুখে মুখে বুবলীর পারিবারিক অশান্তির কথা। শ্বাশুড়িকে তিনি ঘষেটি বেগম আখ্যায়িত করে নানা ধরনের বিদ্রুপ মন্তব্য করতেও শোনা যায়। পারিবারিক এই অশান্তি নিয়েই দুই সন্তানের পিতৃ পরিচয়ের দিকে তাকিয়ে স্বামীর বাড়িতেই আছেন তিনি তাও উল্লেখ করেন। ওই ফোনালাপের অংশ বিশেষ তুলে ধরা হলো। বুবলী মোবারককে বলেন, যারা সরল মানুষ তারাই বেশি বিপদে পড়ে। আপনি জড়িত (লোকমান হত্যা) না থাকলেও মামলায় আসামি করে আপনাদেরকে মেয়র কামরুল যেভাবে পেঁচিয়ে দিয়েছে তাতে আপনি আর নরসিংদীতে আসতে পারবেন না। লোকমানের সম্পদ সম্পর্কে বুবলী বলেন, আমার স্বামী মারা গেছে, আজকে আমার এই অবস্থা কেন? ওনার (লোকমান) টাকা-পয়সা কোথায় গেলো? কার কাছে ছিল ওনার টাকা? আজকে আমাকে মানুষের হাতের দিকে তাকিয়ে থাকতে হয়। কারো হাতের নিচ দিয়ে পড়বে, আর আমি তা তুলে খাব। এটা কেন? ফোনালাপে বুবলীকে বলতে শোনা যায়, কামরুলের স্ত্রী গাড়ি চড়ে মার্কেটে যায়। আর আমি রিকসায় চড়ে মার্কেটে, লাইব্রেরি ও বাচ্চাদের নিয়ে স্কুলে যাই। সে (দেবর মেয়র কামরুল) আমাকে একটি রি-কন্ডিশন গাড়িও কিনে দেয়নি। বুবলী কামরুলের দিকে ইঙ্গিত দিয়ে বলেন, যে লোকটা চেয়ারে (মেয়র) বসেছে সে কিন্তু সব সময় আমাকে সন্দেহের মধ্যে রাখে। কামরুলের একটাই ধারণা, একমাত্র তার প্রতিপক্ষ হিসেবে যদি আমাকে দাঁড় করায় তাহলে সে ভ্যানিশ। গেল পৌরসভা উপ-নির্বাচনের পরই বাড়ির সকলের চেহারা পাল্টে গেছে উল্লেখ করে বুবলী বলেন, তারা ছেলে-মেয়েকে রেখে আমাকে বাড়ি থেকে বের করে দেয়ার ষড়যন্ত্র করছে। কোনো মা-তো ছেলে-মেয়েকে ছাড়া ভালো থাকতে পারে না। তাই আমি রাজি হইনি। প্রয়োজনে আমার স্বামীর সম্পদ বিক্রি করে ব্যাংকে ফিক্সড ডিপোজিট করে দেয়ার অনুরোধ করি। কিন্তু আমার প্রয়োজনগুলো তাদের কাছে নগণ্য। এখন আমি আলাদা রান্না করে খাই। তারা আমাকে হাত খরচ দেয় না। আমি ছেলে-মেয়ে নিয়ে কীভাবে চলি?ওই ফোনালাপে বুবলী আরো বলেন, মহিলা এমপির ফলাফল বের হওয়ার আগেই গেইম খেলার জন্য আমাকে উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের মনোনয়ন ক্রয় করানো হয়। তাদের একটাই উদ্দেশ্য ছিল, উপজেলা নির্বাচনে ফেল করিয়ে আমার কোমড় ভেঙে ঘরে ফেলে রাখা। যাতে সামনে (চলমান) মেয়র নির্বাচনে আমার নাম না আসে। এক পর্যায়ে বুবলীকে বলতে শোনা যায়, অনেক সহ্য করেছি, হয় প্রতিবাদ করে বাঁচবো, নয়তো নিজের গায়ে নিজে কেরোসিন ঢেলে আত্মহত্যা করবো।বুবলী দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, তারা যদি মনে করতো ওনি (বুবলী) আমাদের সৌভাগ্যের প্রতীক, ওনি আমাদের ঘরের লক্ষী, চেয়ারের লক্ষী, অস্তিত্বের লক্ষী। ব্যবহার ও ভালোবাসা দিয়ে আমাকে আগলে রাখতো, তাহলে আজ আমার মনে এই ক্ষোভের জন্ম হতো না।ফেসবুকে ফোনালাপের অডিও ফাঁস হওয়ার পর বিষয়টি শহরজুড়ে টক অব দ্য টাউনে পরিণত হয়েছে। পৌরসভার বেশিরভাগ মানুষই আসামি মোবারকের সঙ্গে বুবলীর ফোনালাপকে স্বাভাবিকভাবে নেয়নি। এতে বিব্রতকর অবস্থায় পড়েছে মেয়র লোকমান হোসেনের পরিবার। এ কারণেই প্রতি বছর মেয়র লোকমান হোসেনের মৃত্যুবার্ষিকীতে পৌর কবরস্থানে সমাধি সৌধে ছেলে-মেয়েকে নিয়ে বুবলী শ্রদ্ধার্ঘ্য অপর্ণ করলেও এবার তিনি যাননি। সর্বশেষ বুবলী তার ফেসবুক অ্যাকাউন্টে স্ট্যাটাস দিয়ে ফোনালাপের জন্য দুঃখ প্রকাশ করেন। এ বিষয়ে জানতে চাইলে বুবলী বলেন, মোবারকের সঙ্গে কথা বলার বিষয় নিয়ে আমাদের প্রতিপক্ষ বিভিন্ন প্রচারণা তো করবেই। তবে পারিবারিক এসব দ্বন্দ্ব নিয়ে লেখালেখি করবেন না। এসব কানেও নিবেন না।এ ব্যাপারে কামরুজ্জামান কামরুল বলেন, আমার কোনো ফেসবুক অ্যাকাউন্ট নেই। তিনি কি বলেছেন তা আমি শুনিনি। এ নিয়ে আমার কোনো আগ্রহও নেই।সরেজমিন নরসিংদী এলাকা ঘুরে জানা গেল, প্রয়াত লোকমানের জনপ্রিয়তাকে পূঁজি করে ২০১২ সালের উপ-নির্বাচনে বিজয়ী হন কামরুল। এরপর তিন বছরে অনেক হিসেবে-নিকেশ পাল্টেছে। লোকমানের অসমাপ্ত উন্নয়নমূলক প্রতিশ্রতি বাস্তবায়নের কথা বলে মেয়র পদে আসীন হয়েছিলেন তিনি। কিন্তু যার জনপ্রিয়তার বদৌলতে অন্ধকার জগৎ থেকে ফিরে এসে পৌর পিতার চেয়ারে বসেন তার স্ত্রী’র প্রতি অমর্যাদা প্রকাশ পাওয়ায় আওয়ামী লীগে এখন বিদ্রোহ। রাজনৈতিক সচেতন মহলের ধারণা শুধু আওয়ামী লীগ নয়, এই বিদ্রোহের ডালপালা মেলেছে প্রয়াত লোকমানের অনুসারীদের মধ্যেও। আওয়ামী লীগ নেতাদের বড় অংশ মনে করছেন এ কারণেই কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি কামরুল। বুবলীর পারিবারিক এই অশান্তি পূঁজি করে মাঠে নেমেছেন কাইয়ুম। বিভিন্ন নির্বাচনী পথসভার পাশাপাশি এসএম কাইয়ুম বলেছেন, বুবলী ভাবী নির্বাচন করলে আমি নির্বাচন করতাম না। তার প্রতি অমার্যাদা হওয়ায় প্রয়াত লোকমানের স্বার্থ ক্ষুণ্ন হয়েছে।তিনি বলেন, কামরুল ছিলেন অন্ধকার জগতের মানুষ। যে কারণে লোকমানের জীবদ্দশায় তার কাছে যাওয়ার অবস্থান ছিল না। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এমন কোনো অপকর্ম নেই যা কামরুল ভাই করেননি। তিনি ডাকাতির মামলার আসামি হিসেবে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দীও দিয়েছেন। এসময় ওই জবানবন্দীর রেকর্ড চাইলে কাইয়ুম এ সংক্রান্ত নথিও তুলে ধরেন । কাইয়ুম বলেন, তাই নির্বাচনী পথসভায় বলেছি আমার নেত্রীর নৌকায় ডাকাত উঠেছে। নৌকার মর্যাদা রক্ষা করতেই মেয়র পদে নির্বাচনে অংশ নিয়েছি। উপ-নির্বাচনে মেয়র হয়ে গত তিন বছর অপরাধীদের যে সর্গরাজ্য নরসিংদীতে প্রতিষ্ঠিত করেছেন তার জবাব মানুষ ব্যালটের মাধ্যমেই দিবেন। এমএএস/আরআইপি

Advertisement