ব্রিটেনের টনি ব্লেয়ার, জর্ডানের আবদুল্লাহ, রাশিয়ার পুতিন, আজারবাইজানের আলিয়েভ, - আরো অনেক নেতার গোপন সম্পদের তথ্য ফাঁস। কেউই না-কি বাদ যাবে না। তবে, বাংলাদেশের কারো নাম এখনো আসেনি।
Advertisement
নিজ দেশ থেকে অন্যদেশে নিরাপদ জায়গা মতো অর্থ পাচারের তালিকায় উঠে এসেছে সাবেক-বর্তমান মিলিয়ে ৩৫ জন বিশ্বনেতার। বিশ্বের ৩৩০ জন রাজনীতিকের নাম আছে প্যান্ডোরা পেপারসে। এর বাইরে আছেন সেলেব্রেটি, বিলিওনারি ব্যবসায়ী, সরকারি কর্মকর্তা এমন কি বিচারক পর্যন্ত। ফাঁস হয়ে যাওয়া গোপন নথিপত্রে পাচারকারী এইসব বিশ্ব নেতা, রাজনীতিক এবং বিশিষ্ট ব্যক্তিদের নাম পরিচয়ের পাশাপাশি অর্থ পাচারের সবিস্তার তথ্য উঠে এসেছে। ওয়াশিংটন ভিত্তিক ইন্টান্যাশনাল কনসোর্টিয়াম অব ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিষ্টস-আইসিআইজের কাছে দলিলগুলো ফাঁস করা হয়।
ফিনসেন ফাইলস, প্যারাডাইস পেপারস, পানামা পেপারস এবং লাক্সলিক্সের পর প্যান্ডোরা পেপারস বড় ঝাঁকুনি দিলো গোটা বিশ্বকে। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় আর্থিক কেলেঙ্কারির নথিগুলোর একটি বলা হচ্ছে প্যান্ডোরা পেপারসকে। এটি বিশ্বের প্রভাবশালী বিশ্বনেতা ও ধনকুবেরদের অনেককে আপাতত বেকায়দায় ফেলে দিয়েছে। প্যান্ডোরা পেপার্স প্রস্তুত করেছে ওয়াশিংটন ডিসির ইন্টারন্যাশনাল কনসোর্টিয়াম অব ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিস্টস -আইসিআইজে টিম। যেখানে ১১৭টি দেশের ৬৫০ এরও বেশি সাংবাদিক অংশ নিয়েছেন।
ফাঁস হওয়া নথিতে দেখা গেছে, যুক্তরাজ্যের সাবেক প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ার ও তার স্ত্রী লন্ডনে একটি অফিস কেনার সময় তিন লাখ ১২ হাজার পাউন্ড কর ফাঁকি দিয়েছেন। আর তারা ভবনটি কিনেছিলেন বিদেশে নিজেদের মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান থেকে। জর্ডানের বাদশা গোপনে যুক্তরাজ্য, আমেরিকা ও মালিবুতে ১০ কোটি ডলারের সম্পদ করেছেন। মোনাকোতে গোপন সম্পদ আছে পুতিনের। লন্ডনে অফিস কেনার সময় তিন লাখ পাউন্ড কর ফাঁকি দিয়েছেন টনি ব্লেয়ার।
Advertisement
পুতিনের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ বান্ধবী হিসেবে পরিচিত প্রভাবশালী নারী সভেৎলানা ক্রিভোনোগিখের নামও রয়েছে। পুতিনের প্রভাবকে কাজে লাগিয়ে তিনি রাশিয়া থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ আত্মসাৎ করে বিদেশে পাচার করেছেন। দুর্নীতি দূর করার অঙ্গীকার নিয়ে ক্ষমতায় বসা ইউক্রেনিয়ার প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি তিনিও পূর্বসূরিদের মতোই দুর্নীতিগ্রস্ত। প্যান্ডোরা পেপারসে ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে, তারও অফশোর কোম্পানিতে মালিকানা আছে।
এছাড়াও জানা গেছে, সাইপ্রাসের প্রেসিডেন্ট নিকোস আনাসতাসিয়াদিসের রাশিয়ায় গোপন সম্পদ রয়েছে। অফশোর কোম্পানিগুলোতে বিনিয়োগকারী হিসেবে বিভিন্ন দেশের সাবেক ও বর্তমান অন্তত ৩৫ জন নেতার নাম যাদের নাম পাওয়া গেছে। এছাড়াও পাওয়া গেছে ৩০০-র বেশি সরকারি কর্মকর্তার নাম। করস্বর্গ হিসেবে পরিচিত পানামা, দুবাই, মোনাকো, সুইজারল্যান্ড ও ব্রিটিশ ভার্জিনিয়া দ্বীপপুঞ্জের মতো দেশ এবং অঞ্চলের বিভিন্ন কোম্পানিতে বিভিন্ন দেশের প্রভাবশালীরা যে অর্থ রেখেছেন ও গোপন লেনদেন করেছেন সেই তথ্য ফাঁস হয়েছে প্যান্ডোরা পেপারসে। গার্ডিয়ান-বিবিসিসহ প্রভাবশালী কয়েকটি বিশ্বগণমাধ্যম ওই সব কোম্পানির প্রায় এক কোটি ১৯ লাখ নথি বিশ্লেষণ করে খুঁটিনাটি নানা তথ্য প্রকাশ করেছে।
পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের একান্ত কাছের মানুষ, তার মন্ত্রী ও তাদের পরিবারের সদস্যরা গোপনে কোটি কোটি ডলার আয়ের তথ্যও এসেছে। এছাড়াও আছেন আগামী সপ্তাহে নির্বাচনের মুখে দাঁড়ানো চেক প্রজাতন্ত্রের প্রধানমন্ত্রী আন্দ্রেই ব্যাবিস। তিনি গোপনে ফ্রান্সের দক্ষিণাঞ্চলে ১২ মিলিয়ন পাউন্ড দিয়ে একটি বিদেশি কোম্পানি মারফত দুটি বাড়ি কিনেছেন।
আজারবাইজানের প্রেসিডেন্ট ইলহাম আলিয়েভ ও তার সহযোগীরা যুক্তরাজ্যে প্রায় ৫০ কোটি ডলারের জমি ও বাড়ি কেনাবেচার চুক্তিতে জড়িত ছিলেন বলে দেখা গেছে ফাঁস হওয়া নথিতে। এই আর্থিক কেলেঙ্কারি ফাঁস জিরা আন্তর্জাতিক জোট আইসিআইজেতে রয়েছেন ৬৫০ জনের বেশি সাংবাদিকও আছেন। প্রকাশিত তথ্যের প্রতিবাদ শুরু হয়েছে। রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিন, জর্ডানের বাদশা আবদুল্লাহসহ হাফ ডজন বিশ্ব নেতা আছেন এই প্রতিবাদের পুরোভাগে।
Advertisement
নিজের কিছু সহযোগীর নাম আসার বিষয়ে প্রতিক্রিয়া দিয়েছেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান। বলেছেন, খতিয়ে দেখবেন। কাউকে ছাড় দেবেন না। তদন্ত করে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া হবে। প্যান্ডোরা পেপারসে ইমরান সরকারের অর্থমন্ত্রী শওকত তারিন, পানিসম্পদ মন্ত্রী মনিস এলাহী পিপিপি নেতা শারজিল মেমন, পিএমএল-এন সিনেটর ইসহাক দার পুত্র আলী দার, পাঞ্জাব প্রদেশের মন্ত্রী আলীম খান, পিটিআই সিনেটর ফয়সাল ওয়াওদা, পিএমএল-কিউ নেতাসহ প্রায় ৭০০ পাকিস্তানির নাম উল্লেখ করা হয়েছে।
প্যান্ডোরা পেপারস প্রাকাশের কিছুক্ষণ পরই স্বাগত জানিয়ে ইমরান খান এক টুইটে তিনি বলেন, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি যেভাবে ভারতের সম্পদ লুট করেছিল, তেমনি উন্নয়নশীল বিশ্বের শাসকগোষ্ঠীরাও একই কাজ করে চলছে। দুর্ভাগ্যবশত, ধনী রাষ্ট্রগুলো এই বড় আকারের লুণ্ঠন রোধ করতে বা এই লুট করা অর্থ ফেরত দিতে মোটেও আগ্রহী নয়।
দুর্নীতির শীর্ষদেশ বলা হয় নাইজেরিয়াকে। অনেক দেশ না-কি প্রতারণা এবং দুর্নীতি শিখছে নাইজেরিয়ার থেকে। এই কর্ম শিখতে এখন আর ওস্তাদ লাগে না। কেমন করে মুদ্রা পাচার করতে হয়, ক্রেডিট কার্ড জালিয়াতি করতে হয়, জমির জাল দলিল, জাল পাসপোর্ট, জাল ভিসা, নকল টাকা, ভুয়া এলসি, ভুয়া পুলিশ, ভুয়া ইমিগ্রেশন অফিসার, ভুয়া ব্যাংকার, ভুয়া ব্যাংক একাউন্ট, ভুয়া তৈরি করতে হয় তা অনেকেই জানে। এ জন্য গুরু ধরতে হয় না।
লেখক: সাংবাদিক-কলামিস্ট; বার্তা সম্পাদক, বাংলাভিশন।
এইচআর/এমএস