বিশেষ প্রতিবেদন

দায়িত্ববণ্টন নয়, সম্মেলন চান ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নেতারা

ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ছাত্রসংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগের ২৯তম সম্মেলনের মাধ্যমে হওয়া কমিটি ৩৮ মাস পার করেছে। পূর্ণাঙ্গ কমিটির মেয়াদও পেরিয়েছে ৩০ মাস। গঠনতন্ত্র অনুযায়ী, এ অবস্থায় কেন্দ্রীয় কমিটি সম্মেলন আয়োজন ছাড়া কোনো সাংগঠনিক কার্যক্রম করতে পারে না।

Advertisement

তবে মেয়াদ পেরিয়ে যাওয়ার পর সংগঠনটির সভাপতি আল নাহিয়ান খান জয় ও সাধারণ সম্পাদক লেখক ভট্টাচার্য এখন কেন্দ্রীয় নেতাদের মধ্যে দায়িত্ববণ্টনের কথা বলছেন। কিন্তু অধিকাংশ কেন্দ্রীয় নেতা দায়িত্ববণ্টনের বদলে সম্মেলনের মাধ্যমে নতুন নেতৃত্বের দাবি জানান হাইকমান্ডে।

তারা বলছেন, এখন তারা দায়িত্ব নিতে চান না। দুই বছর পরপর সংগঠনটির সম্মেলন করার গঠনতান্ত্রিক বাধ্যবাধকতা থাকলেও এ কমিটির মেয়াদ পেরিয়েছে বহু আগে। তারা (জয়-লেখক) এখন দায়িত্ববণ্টনের নামে নিজেদের ক্ষমতা দীর্ঘ করার পাঁয়তারা করছেন। সম্মেলনের মাধ্যমে নতুন কমিটি হলে সাংগঠনিকভাবে নিষ্প্রাণ ছাত্রলীগকে পুনরুজ্জীবিত করতে পারবেন তারা। আওয়ামী লীগের ভ্যানগার্ড হিসেবে পরিচিত ছাত্রলীগকে আগামী নির্বাচনের জন্য গুছিয়ে নিতে এখনই সম্মেলন দেওয়া দরকার।

ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক লেখক ভট্টাচার্য গত ২১ সেপ্টেম্বর জাগো নিউজকে বলেন, করোনার কারণে আমাদের স্বাভাবিক সাংগঠনিক কার্যক্রমে ব্যাঘাত সৃষ্টি হয়। এখন করোনা সংক্রমণ কমে আসায় আমরা আমাদের সাংগঠনিক কার্যক্রম আবার পুরোদমে শুরুর পরিকল্পনা হাতে নিয়েছি। অক্টোবরের শুরু থেকে বিভিন্ন বিভাগে সাংগঠনিক সফর শুরু করবো। সেই লক্ষ্যে সাংগঠনিক দায়িত্ববণ্টনের তালিকা প্রস্তুত করছি। সেপ্টেম্বরের মধ্যে কেন্দ্রীয় নেতাদের সাংগঠনিক দায়িত্ব বুঝিয়ে দেবো।

Advertisement

যদিও গত ১ অক্টোবর তিনি আগের বক্তব্য অস্বীকার করে বলেন, আমরা সাংগঠনিক সফরের আগে দায়িত্ব বুঝিয়ে দেবো।

ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদকের এ বক্তব্য ধরে সংগঠনের কেন্দ্রীয় কমিটির সহ-সভাপতি, যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক, সাংগঠনিক সম্পাদক, সম্পাদক, উপ-সম্পাদক পর্যায়ের অন্তত ২০ জন নেতার সঙ্গে কথা হয় জাগো নিউজের। তারা দায়িত্ববণ্টনের বদলে সম্মেলনের দাবির কথাই বলেন।

এ বিষয়ে ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি সোহান খান জাগো নিউজকে বলেন, বাংলাদেশ ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটিতে থাকা ২৭০ জনের মতো নেতা ছাত্রলীগের সম্মেলন চাচ্ছেন। তারা কেউ বর্তমান সভাপতি সাধারণ সম্পাদকের সঙ্গে কাজ করতে চান না। ১০-১২ জন নেতা আছেন যারা তাদের (জয়-লেখক) থেকে ‘অবৈধ’ সুবিধা নিচ্ছেন। তারা ছাড়া সবাই ছাত্রলীগের সম্মেলন চান।

সংশ্লিষ্ট সূত্রের দাবি, আওয়ামী লীগ নেতাদের কাছ থেকে সংকেত পেয়েই ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা সম্মেলনের দাবি তুলছেন। ৪ জানুয়ারি প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর আগেই ছাত্রলীগে নতুন নেতৃত্ব আসার বিষয়ে আশ্বস্ত করেছেন আওয়ামী লীগ নেতারা। ছাত্রলীগের দেখভালের দায়িত্বে থাকা আওয়ামী লীগের একাধিক নেতাও সংগঠনির বর্তমান সভাপতি সাধারণ সম্পাদকের কর্মকাণ্ডে ক্ষুব্ধ। আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করে ছাত্রলীগের নতুন সম্মেলন করার বিষয়ে মতামত জানাবেন তারা।

Advertisement

এ বিষয়ে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি সৈয়দ আরিফ হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, কেন্দ্রীয় কমিটিরই এখন মেয়াদ নেই। এখন আমাদের যদি দায়িত্ব দিয়ে কোনো জায়গায় পাঠানো হয়, সেখানকার কেউ যদি বলে আপনাদেরই তো মেয়াদ নেই, তখন জবাবে আমরা কী বলবো? এ মুহূর্তে দায়িত্ববণ্টন না করে সম্মেলনের আয়োজন করা উচিত।

তিনি বলেন, এরই মধ্যে মেয়াদ শেষ হওয়া ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির নেতাদের জেলাভিত্তিক দায়িত্ববণ্টন করা হলে সেটি হবে একটি আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত। সংগঠনের গতিশীলতা, চেইন অব কমান্ড প্রতিষ্ঠা ও গঠনতন্ত্র সমুন্নত রাখার জন্য হলেও বাংলাদেশ ছাত্রলীগের ৩০তম সম্মেলনের আয়োজন করা জরুরি।

ছাত্রলীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক আরিফুজ্জামান আল ইমরান জাগো নিউজকে বলেন, ব্যক্তিগতভাবে তাদের সঙ্গে আমাদের কোনো বিরোধ নেই। সাংগঠনিকভাবে বিভিন্ন কার্যক্রমে কেন্দ্রীয় নেতাদের সঙ্গে তারা সমন্বয় করছেন না। আলোচনা না করে বিভিন্ন সিদ্ধান্ত নেওয়ার কারণে সাংগঠনিকভাবে অসন্তোষ ও মতবিরোধ তৈরি হয়েছে। এসব মতবিরোধ মেটাতেও সভাপতি সাধারণ সম্পাদক কাজ করছেন না। যুবলীগ কিন্তু করোনার মধ্যেও পূর্ণাঙ্গ কমিটি, দায়িত্ববণ্টন ও সাংগঠনিক সফর শুরু করেছে। ছাত্রলীগের ভালো সংবাদের শিরোনাম হওয়ার সুযোগ ছিল। অথচ তা না হয়ে সাংগঠনিক বিভিন্ন সমস্যার কথা সামাজিক ও গণমাধ্যমে উঠে আসছে।

কেউ সাংগঠনিক দায়িত্ব এখন বুঝে নিতে না চাইলে কী হবে, জানতে চাইলে ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক লেখক ভট্টাচার্য জাগো নিউজকে বলেন, আমরা কেন্দ্রীয় কমিটির সবাইকে দায়িত্ব বুঝিয়ে দেবো। তারপর কেউ যদি দায়িত্ব পালন করতে না পারেন, তাহলে সেখানে অন্য কাউকে দায়িত্ব দেবো। আমাদের কেন্দ্রীয় নেতা তো আর কমেনি। তাদের একজনের হয়তো দুই জায়গায় দায়িত্ব পালন করা লাগতে পারে। এতদিন দায়িত্ববণ্টন না করেও আমরা ছাত্রলীগের কর্মসূচিগুলো পালন করেছি। আমরা যেসব কর্মসূচি পালন করেছি সেসব কর্মসূচিতেও কিন্তু অনেক কেন্দ্রীয় নেতা উপস্থিত থাকেননি। সুতরাং কেউ কর্মসূচিতে অংশ না নিলে যে আমাদের কর্মসূচি থেমে থাকবে, এমনটি নয়।

মধুর ক্যান্টিনে সংঘবদ্ধ সম্মেলনপ্রত্যাশীরা

ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির বড় একটি অংশ সম্মেলনের দাবিতে সংঘবদ্ধ থাকছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যান্টিনে। এদের মধ্যে রয়েছেন সংগঠনটির সহ-সভাপতি শওকতুজ্জামান সৈকত, সোহান খান, ইয়াজ আল রিয়াদ, মাজহারুল ইসলাম শামীম, সৈয়দ মো. আরিফ হোসেন, যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক আরিফুজ্জামান আল ইমরান, সাংগঠনিক সম্পাদক সাবরিনা ইতি।

তাদের সঙ্গে বিভিন্ন সম্পাদক, উপ-সম্পাদক পদে থাকা নেতারাও যোগ দিচ্ছেন।

ছাত্রলীগের সভাপতি আল নাহিয়ান খান জয় ও সাধারণ সম্পাদক লেখক ভট্টাচার্য

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মঙ্গলবার (৫ অক্টোবর) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হল খোলায় এখন আনুষ্ঠানিকভাবে মাঠে নামবেন সম্মেলনপ্রত্যাশীরা। এর মধ্যে সম্মেলনের যৌক্তিকতা নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচারণা চালাচ্ছেন তারা। কয়েকদিনের মধ্যে সংবাদ সম্মেলন করে বর্তমান সভাপতি সাধারণ সম্পাদকের বিভিন্ন ‘অপকর্ম’র ফিরিস্তি গণমাধ্যমে তুলে ধরবেন বলে জানিয়েছে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির একটি অংশ।

এ বিষয়ে সংগঠনটির উপ-প্রশিক্ষণ বিষয়ক সম্পাদক মেশকাত হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, বাংলাদেশ ছাত্রলীগের বর্তমান সভাপতি সাধারণ সম্পাদক কেন্দ্রীয় নেতাদেরই খোঁজ নিচ্ছেন না। আমি অসুস্থ হয়ে মৃত্যুশয্যায় ছিলাম। তারা কেউ আমার খোঁজ নেননি। অথচ ময়মনসিংহসহ বিভিন্ন জেলায় কমিটি দেওয়ার নামে লাখ লাখ টাকা নিয়েছেন। আমরা ছাত্রলীগ নিয়ে কাউকে ব্যবসা করতে দেবো না। জাতির সামনে তাদের অপকর্ম তুলে ধরতে চাই।

যেসব কারণে সম্মেলন চান ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নেতারা

সম্মেলনপ্রত্যাশীরা বলছেন, বাংলাদেশ ছাত্রলীগের বর্তমান কমিটি সাংগঠনিকভাবে মেয়াদোত্তীর্ণ। পূর্ণাঙ্গ কমিটি হওয়ার পর কেন্দ্রীয় নেতাদের দায়িত্ববণ্টন না করা, ত্যাগীদের বাদ দিয়ে সভাপতি সাধারণ সম্পাদকের পছন্দের লোকদের পদায়ন করা, সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডে সিনিয়র নেতাদের বাদ দিয়ে জয়-লেখকের কাছের লোকদের গুরুত্ব দেওয়া, দলীয় সাধারণ সভা ও বর্ধিত সভা না করা, কেন্দ্রীয় নেতাকর্মীদের খোঁজ না নেওয়া, সম্মেলন ছাড়া প্রেস বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে কমিটি করা, মধুর ক্যান্টিনে না আসাসহ বিভিন্ন কারণে তৈরি হওয়া সাংগঠনিক স্থবিরতার জন্য নতুন সম্মেলন দরকার।

সম্মেলনের দাবিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যান্টিনে সংঘবদ্ধ থাকছে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নেতাদের একটি অংশ

এ বিষয়ে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি সোহান খান বলেন, করোনাকালে যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ দায়িত্ববণ্টন করেছে। তারা সারাদেশে ছড়িয়ে গেছে। আওয়ামী লীগের অন্যান্য সহযোগী সংগঠনের নেতারাও সারাদেশে ছড়িয়ে পড়েছেন। বাংলাদেশ ছাত্রলীগ এক্ষেত্রে সম্পূর্ণ ব্যর্থ। যেহেতু এ কমিটির মেয়াদ অনেক আগেই শেষ হয়েছে সেহেতু আমরা নতুন সম্মেলন চাই। অভিজ্ঞতা, মাননীয় নেত্রী ও দলের প্রতি কমিটমেন্ট এবং যাদের বুকে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ প্রোথিত— এমন কিছু ছাত্রনেতাকে নিয়ে কমিটি দিয়ে নতুনভাবে ছাত্রলীগ শুরু করুক। ভাঙা আয়না কি জোড়া লাগে?

আরিফুজ্জামান আল ইমরান বলেন, কেন্দ্রীয় কমিটির নেতারা যেসব অভিযোগ তুলেছেন তারা (সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক) এসবের সমাধান করছেন না। আবার সাংগঠনিক গতিশীলতাও বাড়াচ্ছেন না। আমার মনে হয় ছাত্রলীগকে তাদের যা দেওয়ার ছিল তা তারা দিয়ে ফেলেছেন।

সম্মেলনের দাবির বিষয়ে ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক লেখক ভট্টাচার্য জাগো নিউজকে বলেন, আমাদের কাছে সম্মেলন দাবি করে লাভ নেই। যারা সম্মেলন দাবি করছেন, তারা যদি কেন্দ্রীয় কমিটির নেতা হয়ে থাকেন, তাহলে তাদের ছাত্রলীগের সম্মেলন নিয়ে ধারণা আছে। ধারণা থাকার পরও যদি তারা এগুলো বলেন, তাহলে আর কী বলার আছে? তারা না জেনে এগুলো বলছেন।

এমএইচআর/এইচএ/জেআইএম