অবৈধভাবে অর্জিত সম্পদ বিদেশে পাচার এবং কর ফাঁকির গোপন জগত নিয়ে অনুসন্ধানী রিপোর্টে একের পর এক গোপন তথ্য বেরিয়ে আসছে। সম্প্রতি বিশ্বে তোলপাড় ফেলেছে প্যানডোরা পেপার্স নামের একটি অনুসন্ধানী রিপোর্ট। বিবিসি প্যানোরামা, ব্রিটিশ দৈনিক গার্ডিয়ান এবং আরও কিছু মিডিয়া অংশীদার মিলে বিশ্বের ১৪টি কোম্পানির ১ কোটি ২০ লাখ দলিলপত্র হাতে পেয়েছে।
Advertisement
এই দলিলপত্র উদঘাটন করেছে ওয়াশিংটনভিত্তিক ইন্টারন্যাশনাল কনসোর্টিয়াম অব ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিস্টস (আইসিআইজে)। ৬ শতাধিক সাংবাদিক এবং দেড় শতাধিক মিডিয়া আউটলেট দুই বছরের প্রচেষ্টায় এসব গোপন নথি ফাঁস করতে সক্ষম হয়েছে। এসব নথিতে দেখা গেছে, বিশ্বের অত্যন্ত ক্ষমতাধর লোকজন অবৈধভাবে অর্জিত ধন-সম্পদ, টাকা-পয়সা বিদেশে পাচার করছে এবং তা গোপন রাখছে। টাকা পাচারের এসব হোতার মধ্যে রয়েছেন ৯০টি দেশের ৩শ জনেরও বেশি রাজনীতিক।
যুক্তরাষ্ট্রের গবেষণা সংস্থা গ্লোবাল ফাইন্যান্সের লাক্সমি কুমার বলেন, ক্ষমতাধর মানুষেরা বিশ্বের বেশ কিছু দেশ এবং অঞ্চলে নিবন্ধিত নামসর্বস্ব বিভিন্ন কোম্পানির মাধ্যমে টাকা পয়সা পাচার করে লুকিয়ে রাখতে সক্ষম হচ্ছেন। এই কাজে তাদের সাহায্য করছেন আইনজীবী, অ্যাকাউনটেন্ট এবং কেতাদুরস্ত সব পরামর্শক ও দালাল।
অনুসন্ধানী সাংবাদিকদের জোট আইসিআইজির ওয়েবসাইটে প্রকাশিত এক রিপোর্টে বলা হয়েছে, পশ্চিমা বেশ কয়েকটি শক্তিধর দেশের সরকারও হাজার হাজার কোটি ডলারের সম্পদ পাচার এবং কর ফাঁকির এই মহোৎসবে পরোক্ষ ভূমিকা রাখছে।
Advertisement
আইসিআইজি বলছে, বিশ্ব অর্থনীতির ১০ শতাংশ পাচার হয়ে কয়েকডজন ট্যাক্স হেভেন অর্থাৎ প্রায় করবিহীন অঞ্চলে নিবন্ধিত হাজার হাজার কাগুজে কোম্পানির খাতায় জমা হচ্ছে। পরিণতিতে এসব দেশের সরকার বছরে কম বেশি ৮০ হাজার কোটি ডলার আয়কর থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।
কিন্তু কোথায় এসব ট্যাক্স হেভেন? কীভাবে গজায় হাজার হাজার এসব ‘শেল‘ অর্থাৎ খোলস-সর্বস্ব কোম্পানি? কীভাবেই বা গোপন থাকে বিনিয়োগের নামে পাচার করা অবৈধ টাকার পাহাড়?
ট্যাক্স হেভেনের পরিধি
পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে কর ফাঁকির সব নিরাপদ আস্তানা। এর ভেতর রয়েছে স্বাধীন সার্বভৌম কিছু দেশ যেমন-পানামা, নেদারল্যান্ডস, মাল্টা, মরিশাস। সেই সঙ্গে রয়েছে কয়েকটি দেশের অভ্যন্তরের কিছু অঞ্চল যেমন- যুক্তরাষ্ট্রের ডেলাওয়ার বা ওয়াইয়োমিঙ অঙ্গরাজ্য।
Advertisement
আবার কোনো কোনো দেশ তাদের মূল ভূখণ্ডের বাইরে কিছু অঞ্চলকে এমন ট্যাক্স হেভেন করে রেখেছে যেমন-ব্রিটিশ শাসিত ক্যারিবীয় দ্বীপ ব্রিটিশ ভার্জিন দ্বীপপুঞ্জ বা কেইম্যান দ্বীপপুঞ্জ।
এখন থেকে পাঁচ বছর আগে পানামা পেপারস নামে কর ফাঁকি নিয়ে ফাঁস হওয়া নথিপত্রে দেখা গিয়েছিল যে পানামাভিত্তিক একটি আইন প্রতিষ্ঠান ব্রিটিশ ভার্জিন দ্বীপপুঞ্জে হাজার হাজার শেল কোম্পানি নিবন্ধনের ব্যবস্থা করে দিয়েছিল।
এক হিসাব অনুযায়ী, বিশ্বের ৬০টির মতো দেশ এবং অঞ্চল রয়েছে যেখানে এসব খোলস কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব। এসব জায়গায় কোম্পানি করের হার খুবই কম। অনেক জায়গায় কর একবারেই দিতে হয় না।
অবৈধ সম্পদ গোপন রাখতে বা কর ফাঁকির জন্য লাখ লাখ মানুষ যখন এসব খোলস কোম্পানি খোলেন, তখন তাদের কাছ থেকে ওই সব দেশ বা অঞ্চলের সরকার অনেক ফি পায়। প্রচুর আইনজীবী, অ্যাকাউনটেন্ট বা পরামর্শকের কাজের সুযোগ তৈরি হয়।
কারা ট্যাক্স হেভেন ব্যবহার করেন? এক কথায় এর উত্তর হলো, বিশ্বের ধনী লোকজন। কিন্তু একইসাথে অনেক মানুষ যারা ব্যাংকের ঋণ ফেরত দিতে বা কারো পাওয়া শোধ করতে চান না, তারাও তাদের টাকা-পয়সা ট্যাক্স হেভেনগুলোতে নেয়ার চেষ্টা করেন।
সেই সঙ্গে রয়েছে ঘুষখোর, মাদক ব্যবসায়ী বা অস্ত্র চোরাচালানে জড়িত লোকজন-যারা তাদের অবৈধ আয় গোপন রাখতে উন্মুখ।
তবে বড় বড় অনেক বহুজাতিক কোম্পানি যারা বিশ্বজুড়ে লেনদেন করে, তারাও কর ফাঁকির জন্য ট্যাক্স হেভেনে ভিন্ন নামে সহযোগী বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান খোলে বলে বহু প্রমাণ পাওয়া গেছে। কাগজে-কলমে ভাগ হয়ে যায় ব্যবসার লেনদেন ও মুনাফা, এবং তাতে করে মূল কোম্পানির করের পরিমাণ কমে যায়। নাইকি বা অ্যাপলের মত কোম্পানির বিরুদ্ধেও ট্যাক্স হেভেন ব্যবহারের অভিযোগ রয়েছে এবং এ সংক্রান্ত তথ্য-প্রমাণও ফাঁস হয়েছে।
বিভিন্ন ট্যাক্স হেভেনে নিবন্ধিত এসব নাম-সর্বস্ব কাগুজে কোম্পানি আদতে কোনও ব্যবসা না করলেও আইনের চোখে এগুলো বৈধ। এসব কোম্পানিতে সার্বক্ষণিক কোন কর্মী নেই। এমনকি অধিকাংশ কোম্পানির কোন অফিসও নেই। যেমন, আইসিআইজির গত বছরের এক রিপোর্টে বলা হয় যে কেইম্যান দ্বীপপুঞ্জে একটি ভবনেই ছিল ১৯ হাজার কাগুজে কোম্পানির ঠিকানা।
এসব কোম্পানির নথিপত্রে মূল মালিকদের কোন নাম ঠিকানা নেই। কিন্তু পর্দার আড়াল থেকে তারাই এগুলোতে বিনিয়োগ করা অর্থ লেনদেন করেন। তারাই কোম্পানির নামে নানা দেশে জমি-জমা ঘরবাড়ি কেনেন, শেয়ার বাজারে বিনিয়োগ করেন।
তাদের সাহায্যের জন্য রয়েছে বহু আইনজীবী বা অ্যাকাউনটেন্ট। মোটা ফি দেওয়ার বিনিময়ে তারাই এসব ক্ষেত্রে বুদ্ধি জোগান, কাজ করে দেন। অনেক ক্ষেত্রে কোম্পানির খোলার খরচ অবিশ্বাস্যরকম কম এবং জটিলতা নেই বললেই চলে।
আইসিআইজির এক রিপোর্ট অনুযায়ী, কোম্পানি খোলা এতই সহজ যে একটি ইমেল বা একটি ফোনকলেই কাজ হয়ে যায়।খরচ এবং কাগজপত্রের সংখ্যা নির্ভর করে কোথায় কোম্পানি খোলা হচ্ছে এবং কোন আইনজীবী এই কাজটি করে দিচ্ছেন তার ওপর।
পানামা পেপারস কেলেঙ্কারি ফাঁসের জেরে বন্ধ হয়ে যাওয়া পানামাভিত্তিক আইনজীবী প্রতিষ্ঠান মোসাক ফনসেকা কোম্পানি প্রতি ফি নিতো ৩৫০ ডলার। তবে আইনজীবীদের এই ফি দু’হাজার ডলার পর্যন্ত হতে পারে। টাকা পাচার নিয়ে লেখা বই সিক্রেসি ওয়ার্ল্ডের লেখক জেক বার্নস্টেইন এক সাক্ষাৎকারে মার্কিন দৈনিক বিজনেস ইনসাইডারকে বলেন, অনেক ট্যাক্স হেভেনে এমন আইনও রয়েছে যে কোম্পানি মালিকের নাম পরিচয় প্রকাশ করা যায় না।
তিনি বলেন, আপনি ভুয়া পরিচালকও রাখতে পারেন, যারা কিছু পয়সার বিনিময়ে মানুষের কাছে আপনার কোম্পানির মালিক হয়ে প্রতিনিধিত্ব করবে।
কেন বন্ধ হচ্ছে না এই প্রতারণা?
আইসিআইজির বেন হলম্যান লিখেছেন, বিশ্বের প্রভাবশালী কিছু দেশ এ ব্যাপারে চোখ বন্ধ করে থাকছে। এমনকি প্রবণতা টিকিয়ে রাখতে সহযোগিতাও করছে। ব্রিটিশ শাসিত একাধিক ক্যারিবীয় দ্বীপ বিশ্বের প্রধান সব ট্যাক্স হেভেন। সেসব জায়গায় নিবন্ধিত কোম্পানির নামে লন্ডনে জমি-বাড়ি কেনাবেচা হচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্রের কয়েকটি অঙ্গরাজ্য যেমন ডেলাওয়ার, ওয়াইয়োমিঙ, নেভাডা, সাউথ ডাকোটাও ট্যাক্স হেভেন হিসেবে পরিচিত। কোম্পানি করের হার এসব রাজ্যে খুবই কম। বিদেশ থেকে কে এখানে টাকা এনে কোম্পানি খুললো এবং কোথায় তা খাটালো, তা নিয়ে এসব রাজ্যের তেমন মাথাব্যথা নেই। মার্কিন অর্থ মন্ত্রণালয়ের এক হিসাব বলছে, বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে বছরে কমবেশি ৩০ হাজার কোটি ডলার যুক্তরাষ্ট্রে পাচার হয়ে আসছে।
টিটিএন/জেআইএম