মতামত

স্বাস্থ্য বিভাগে আর কোনো মালেক নেই?

সাম্প্রতিক সময়ে মাঝপথে থেমে যাওয়া দুর্নীতিবিরোধী শুদ্ধি অভিযান আরো কিছুদিন যদি চলতো- সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা ঠিক এরকমই। অভিযান যদি চলমান রাখা যেতো তাহলে পরে অনেকের থলের বিড়াল বেরিয়ে আসত। সবাই খুশি হতো। আন্তর্জাতিক মহলে বাংলাদেশ আরো বেশি প্রশংসিত পেত।

Advertisement

রাজনৈতিক সরকারের আমলে যতোটুকু হয়েছে ততোটুকুইতো বেশি! না। অন্য সরকারগুলোর চেয়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের কাছে মানুষের প্রত্যাশা অনেক। মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দেয়া অসাম্প্রদায়িক চেতনায় বিশ্বাসী ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ কোন অশুভ শক্তির কাছে মাথানত করবে না, এরকম আশা করা অমূলক কিছু নয়।

স্বাস্থ্য খাত নিয়ে এত আলোচনা সমালোচনার পরও মাত্র একজন গাড়ি চালককে দুর্নীতিবাজ হিসেবে সামনে হাজির করা হয়েছে। এই ড্রাইভার মালেক ছাড়া কি গোটা স্বাস্থ্য বিভাগে আর কোন অপরাধী নেই? নাকি সবাই গঙ্গার জলে শুদ্ধ হয়ে নতুন করে পথ চলতে শুরু করেছেন? আসলে রাষ্ট্রের মূলনীতির জায়গা থেকে যখন রাজনৈতিক সরকারগুলো আপোসকামিতা শুরু করে তখন নানা নৈরাজ্য সহ্য করা ছাড়া কোন উপায় থাকে না। একারণে সমাজের অনেক প্রতিবাদী ভালো মানুষ নিজেদের গুটিয়ে নিয়েছেন।

অনেকে হয়ত প্রশ্ন করবেন? হেফাজত তো এখন আর আগের মতো নেই। তাদের অনেক নেতাই কারাগারে। অনেকের ব্যাংক হিসাব তলব করা হয়েছে। দ্বিখণ্ডিত করা হয়েছে এই সাম্প্রদায়িক সংগঠনকে। এখন সরকারের প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী নতুন মোড়কে সংগঠনটি পরিচালিত হচ্ছে। তাহলে পরে সরকারের দোষ কোথায়? অনেক বিলম্বে হলেও তো হেফাজতের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছে আওয়ামী লীগ। এমন প্রশ্ন ওঠা স্বাভবিক।

Advertisement

উত্তর হলো, আওয়ামী লীগ সময়ের কারণে হয়ত হেফাজত পরিচালনা করছে। কিন্তু স্বাধীনতাবিরোধী গোষ্ঠির উদর থেকে জন্ম নেয়া এই সংগঠনের কর্মীদের আদর্শ ও দর্শন তো কোন ভাবেই পরিবর্তন করতে পারবে না। নাকি পারবে? এটা মোটেও সম্ভব নয়। তারা কি কখনই মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, বাংলাদেশ, জাতীয় পতাকাকে বিশ্বাস বা সম্মান করবে। পাকিস্তান প্রীতি থেকে বেরিয়ে আসতে পারবে? গণতন্ত্রের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হবে। অসাম্প্রদায়িক চেতনাকে লালন করতে পারবে? সর্বোপরি হেফাজত বাহিনী কি কখনই আওয়ামী লীগকে ভোট দেবে। মোটেও না। একথা দেশের সব মানুষ বোঝেন। তাহলে আওয়ামী লীগকে একথা বোঝতে এত সময় লাগলো কেন? যদি আগেই হেফাজতের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হত তাহলে আজ জামায়াতকে নিয়ে সারাদেশে তারা সংগঠন বিস্তার ঘটাতে পারত না। এত বেশি সাম্প্রদায়িকতা, ধর্মান্ধতা, প্রতিহিংসা, মৌলবাদী চিন্তার বীজ সাধারণ মানুষের মধ্যে ঢুকাতে পারত না। দেশের শান্তিপ্রিয় অঞ্চল গুলোতে হেফাজতকে নেতৃত্বে পরিকল্পিত সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হতো না।

তাই বলছি একদিকে দুর্নীতিবিরোধী অভিযান যেমন চালিয়ে যাওয়া খুবই প্রয়োজন ছিল অন্যদিকে জামায়াতের ছায়া ভাই হেফাজতকে আগে থেকেই নিয়ন্ত্রণ করা আরো বেশি জরুরি ছিল। তাহলে পরে তারা ধর্মের লেবাসে সাধারণ মানুষের কোন অবস্থাতেই মনজয় করতে পারতো না। এখন হেফাজতের কারণে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল গুলোর মানুষের চিন্তা, মননে মৌলবাদী চিন্তা প্রবেশ করেছে। শহর ছাপিয়ে গ্রামের সহজ সরল মেয়েরাও আফগান পোশাক আশাক পরে স্কুলে যায়। যা ২০০৮ সালেও এতেবেশি দেখা যায়নি।

সময় অনেক বয়ে গেছে। এখন কিন্তু সাধারণ মানুষকে প্রগতির ধারায় ফেরাতে সময় লাগবে। তাছাড়া হেফাজতবিরোধী কোন কর্মসূচিও আওয়ামী লীগ তথা ১৪ দল বা মহাজোটের পক্ষ থেকে নেয়া হয়নি। সারাদেশের মানুষকে বিশ্বাস করাতে হবে হেফাজত ভুল পথে চলছে। তাদের চিন্তা, আদর্শ, দর্শন ভুল। যার সঙ্গে রাষ্ট্র, সমাজের কোন সম্পর্ক নেই। মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ অসাম্প্রদায়িক চেতনা নিয়ে এগিয়ে যাবে। ২০৪১ সাল হবে প্রযুক্তির বাংলাদেশ।

সাম্প্রতিক সময়ে সবচেয়ে বেশি আলোচনা হয়েছে দেশের স্বাস্থ্য খাতের দুর্নীতি, স্বেচ্ছাচারিতা, অনিয়মসহ নানা নৈরাজ্য নিয়ে। কিন্তু এসবের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিয়ে সরকার নাগরিক মন জয় করতে পারেনি। বিশেষ করে কোভিড-১৯ মহামারি শুরুর পর থেকে স্বাস্থ্য খাতের দুর্নীতি বেশি আলোচনায় আসে। মাস্ক কেলেঙ্কারীর পর একে একে অনেক বিষয় নিয়ে তোলপাড় শুরু হয়। সংসদ অধিবেশনে এ নিয়ে উত্তাপ ছড়ায়। অনেক সংসদ সদস্য প্রকাশ্যে বক্তব্য দিয়ে স্বাস্থ্য মন্ত্রীর পদত্যাগ পর্যন্ত চেয়েছেন। শেষ পর্যন্ত স্বাস্থ্য বিভাগে আমরা কি দেখলাম। একজন মালেককে আবিস্কার করা হয়েছে। তিনি একজন গাড়ি চালক। বহু টাকা পয়সা, প্লট, ফ্ল্যাটের মালিক। তার অবৈধ আরও সম্পদ রয়েছে। এ নিয়ে রীতিমতো হইচই। মালেককে আইনের আওতায় আনার পর দুর্নীতি বিরোধী অভিযানের মতো স্বাস্থ্য বিভাগের অভিযানও রাতারাতি বন্ধ হয়ে গেল। যেমন বন্ধ হয়ে গিয়েছিল ক্যাসিনো বিরোধী অভিযানও।

Advertisement

স্বাস্থ্য অধিদফতরের সাবেক গাড়িচালক আব্দুল মালেক ওরফে মালেক ড্রাইভারের বিরুদ্ধে দায়ের করা অস্ত্র আইনের মামলার দুই ধারায় ১৫ বছর করে ৩০ বছরের কারাদণ্ড হয়েছে। গত ২০ সেপ্টেম্বর আদালতের দেয়া রায়ে এই দুর্নীতিবাজ কর্মচারীর বিচার হলো। গত বছরের ২০ সেপ্টেম্বর রাজধানীর তুরাগ থানাধীন কামারপাড়াস্থ ৪২ নম্বর বামনেরটেক হাজী কমপ্লেক্সের তৃতীয় তলার বাসা থেকে আব্দুল মালেককে গ্রেফতার করা হয়। এ সময় তার কাছ থেকে একটি বিদেশি পিস্তল, একটি ম্যাগজিন, পাঁচ রাউন্ড গুলি, দেড় লাখ বাংলাদেশি জাল নোট, একটি ল্যাপটপ ও মোবাইল ফোন উদ্ধার করা হয়। এ ঘটনায় র‌্যাব-১ এর পুলিশ পরিদর্শক আলমগীর হোসেন বাদী হয়ে মামলা দুটি দায়ের করেন। মূলত তিনি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালকের গাড়ি চালক ছিলেন। এই প্রভাব নিয়েই তার এতকিছু।

এর আগে স্বাস্থ্য মন্ত্রীসহ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের একাধিকবার বলেছেন, স্বাস্থ্য বিভাগে শুদ্ধি অভিযান চলমান রাখার কথা। কিন্তু স্বাস্থ্য মন্ত্রী জাহিদ মালেকের এপিএসের বিরুদ্ধে স্বাস্থ্য খাতের অনিয়ম দুর্নীতির সঙ্গে সরাসরি যুক্ত থাকার অভিযোগ উঠে। যার প্রেক্ষিতে এপিএসকে পদ হারাতে হয়। কিন্তু এই খাতের দুর্নীতি রোধে বা জাবাবদিহি প্রতিষ্ঠায় জোড়ালো কোন অভিযান চোখে পড়েনি। রিজেন্ট সাহেদ স্বাস্থ্য খাতের নানা অনিয়ম দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত থাকার ঘটনা ফাঁস হওয়ার পর বিষয়টি সবার নজরে আসে। দাবি ওঠে এই সেক্টরে শুদ্ধি অভিযান পরিচালনার।

এক পর্যায়ে বদল করা হয় স্বাস্থ্যের ডিজি আবুল কালাম আজাদকে। ব্যর্থতার অভিযোগ এনে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সেবা বিভাগের সচিব আসাদুল ইসলামকেও সরিয়ে দেয়া হয়েছিল। অসুধ প্রশাসন অনুবিভাগের অতিরিক্ত সচিব ইসমাইল হোসেনকে বদলী করা হয়। এর বাইরে মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের কিছু কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের দায়িত্ব থেকে সরিয়ে অন্যত্র পাঠাতে দেখা যায়। হাতেগোনা কয়েকটি বিষয় উল্লেখ করা ছাড়া স্বাস্থ্য বিভাগে আর বিশেষ কি শুদ্ধি অভিযান হয়েছে?

কথা হলো কেউ আইনের ঊর্ধ্বে নয়। তবে যদি স্বাস্থ্য খাতকে পরিচ্ছন্ন করতে হয় একজন মালেকেই শেষ হয়। এই সেক্টরে আর কোন মালেক কি নেই? আরো হয়তো অনেক মালেক প্রকাশ্যে অপ্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে। সরকারের উচিত তাদের বিষয়ে নজর দেয়া। রাজনীতির ঊর্ধ্বে ওঠে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া। কারণ কিছু দুষ্ট চক্রের জন্য সমাজে যেমন শান্তি বিঘ্নিত হচ্ছে তেমনি চুরির কারণে মানুষ স্বাস্থ্য খাতের মতো গুরুত্বপূর্ণ মৌলিক অধিকার প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।

প্রতি বছর কত কোটি টাকা এই সেক্টরে লোপাট হচ্ছে কেউ জানে না। তবে যেটা মানুষ জানে তা হলো- হাসপাতালে ওষুধ থাকে না, যন্ত্রপাতি বিকল, আসন সংকট, আইসিইউ সংকট, অক্সিজেন নেই, জনবল সংকটসহ হাজারো সমস্যা। এসব সমস্যার অনেক কিছুই মেটানো সম্ভব যদি আরো মালেককে ধরে আইনের আওতায় আনা যায়। লোপাট বন্ধ হলে মানুষের প্রয়োজনে পুরো অর্থ ব্যয় করা সম্ভব হবে। তা না হলে পরে সব অভিযান নিয়ে প্রশ্ন থেকে যাবে। মনে হবে অভিযান একেবারেই লোক দেখানো। তাই হেফাজত নিয়ন্ত্রণ যেমন জরুরি তেমনি সমাজে সকল সেক্টরে শুদ্ধি অভিযান চালিয়ে যাওয়া আরো বেশি জরুরি।

লেখক : সাবেক সিনিয়র রিপোর্টার ও ইউনিট চিফ দৈনিক জনকণ্ঠ।

এইচআর/জিকেএস