দেশ স্বাধীনের পর গত অর্ধশতাব্দী ধরে যশোর কেন্দ্রীয় কারাগারে ৩৬ আসামির মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হলো। সোমবার রাতে দুই ধর্ষক ও খুনির ফাঁসির মধ্য দিয়ে এ সংখ্যা ৩৬ এ দাঁড়ালো। ফাঁসি কার্যকর হওয়া এই ৩৬ জনের সবাই পুরুষ। এখনো এই কারাগারে কোনো নারী আসামির ফাঁসি কার্যকর হয়নি। সর্বশেষ সোমবার রাত ১০টা ৪৫ মিনিটে চুয়াডাঙ্গার অলোচিত ধর্ষক ও খুনি কালু ও আজিজুলের ফাঁসি কার্যকর করা হয়।
Advertisement
এছাড়া এই কারাগারের কনডেম সেলে রয়েছে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ৯৯ আসামি। এর মধ্যে নারী রয়েছে ৫ জন। আর ৯৪ জন পুরুষ। খুন ও রাষ্ট্রদ্রোহসহ গুরুতর অপরাধ প্রমাণিত হওয়ায় আদালত মৃত্যুদণ্ডের পর কারাগারের কনডেম সেলে রয়েছে এসব ফাঁসির আসামি। যশোর কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে এ তথ্য পাওয়া গেছে। যশোর কেন্দ্রীয় কারাগার সূত্রে জানা গেছে, দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে সবচেয়ে প্রাচীন কারাগার হচ্ছে যশোর কেন্দ্রীয় কারাগার। ১৮৭৫ সালে নির্মিত এই কারাগারে সব সময়ই বন্দি থাকে ধারণ ক্ষমতার বেশি। বর্তমানে সাজাপ্রাপ্ত বন্দি, ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্তদের পাশাপাশি শীর্ষ সন্ত্রাসীসহ ১ হাজার ২১৭ জন বন্দি রয়েছে এই কারাগারে। তাদের মধ্যে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ৯৯ জন আসামি রয়েছে কনডেম সেলে। স্বাধীনতার পর থেকে এই পর্যন্ত মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত বেনজীর আহম্মেদ শিপন নামে এক আসামির প্রাণভিক্ষার আবেদন রাষ্ট্রপতি মঞ্জুর করেছেন। যশোর কেন্দ্রীয় কারাগারের জেলার তুহিন কান্তি খান বলেন, মৃত্যুদণ্ডের ক্ষেত্রে আপিল বিভাগের রায় শেষে রাষ্ট্রপতির সাধারণ ক্ষমা নামঞ্জুর হলে সরকারের পক্ষ থেকে আসামির ফাঁসি কার্যকরের ব্যবস্থা নেওয়া হয়। কারো ফাঁসি কার্যকরে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের চিঠি পাওয়া গেলে কারা অধিদপ্তর ব্যবস্থা নিতে সংশ্লিষ্ট কারা কর্তৃপক্ষকে জানায়। এরপর কারাবিধি মেনে সব প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে ফাঁসির মঞ্চে রশিতে ঝুলিয়ে কার্যকর করা হয়। সূত্র জানায়, যশোর কারাগারে প্রথম ফাঁসি কার্যকর হয় ১৯৭৭ সালের ১৬ অক্টোবর। আর সর্বশেষ সোমবার রাতে ধর্ষক ও খুনি কালু ও আজিজুলের ফাঁসির মধ্য দিয়ে যশোর কেন্দ্রীয় কারাগারে এক-এক করে ৩৬ আসামির ফাঁসি কার্যকর হলো। এর আগে সর্বশেষ ২০১৭ সালের ১৬ নভেম্বর বৃহস্পতিবার রাত ১১টা ৪৫ মিনিটে জোড়া ফাঁসি কার্যকর হয়েছিলো এই কারাগারে।
সর্বশেষ চুয়াডাঙ্গা জেলার আলমডাঙ্গা উপজেলার দুর্লভপুর গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা মনোয়ার হোসেন ওরফে মনোয়ার মেম্বার হত্যাকাণ্ডের দায়ে দুই খুনির ফাঁসি কার্যকর করা হয়। দণ্ডপ্রাপ্ত দুজন ছিলেন, চুয়াডাঙ্গার আলমডাঙ্গা উপজেলার কুমারী ইউনিয়নের দুর্লভপুর গ্রামের মৃত মুরাদ আলীর ছেলে আব্দুল মোকিম (৬০) ও মৃত আকছেদ আলীর ছেলে গোলাম রসুল ঝড়ু (৬২)।
১৯৯৪ সালের ২৮ জুন নিজগ্রাম চুয়াডাঙ্গার আলমডাঙ্গা উপজেলার কুমারী ইউনিয়নের দুর্লভপুর গ্রামে চরমপন্থী ক্যাডারদের হাতে খুন হন মুক্তিযোদ্ধা ও তৎকালীন ইউনিয়ন পরিষদ সদস্য মনোয়ার হোসেন। তিনি স্থানীয় কুমারী ইউনিয়ন পরিষদের দুই মেয়াদের সদস্য ও কৃতি খেলোয়াড় ছিলেন। তার খুনের ঘটনায় তার ভাই মুক্তিযোদ্ধা অহিম উদ্দীন বাদী হয়ে আলমডাঙ্গা থানায় ২১ জনকে আসামি করে হত্যা মামলা দায়ের করেন।
Advertisement
এই হত্যা মামলার একযুগ পর ২০০৮ সালের ১৭ এপ্রিল রায় ঘোষিত হয়। রায়ে ঝড়ু ও মোকিমসহ তিনজনকে ফাঁসি ও দুই জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডাদেশ দেওয়া হয়। পরে উচ্চ আদালত ঝড়ু ও মোকিমের ফাঁসি বহাল রেখে বাকি সবাইকে খালাস দেন। এর আগে, ২০১৬ সালের ৭ জানুয়ারি জাসদ নেতা কাজী আরেফ আহমেদসহ দলটির পাঁচজন নেতাকর্মীকে হত্যা মামলায় অভিযুক্ত তিন আসামির ফাঁসি কার্যকর করা হয় যশোর কেন্দ্রীয় কারাগারে। দণ্ডপ্রাপ্তরা হলেন কুষ্টিয়ার মিরপুরের রাজনগর গ্রামের হাবিবুর রহমান, কুর্শা গ্রামের আনোয়ার হোসেন ও রাশেদুল ইসলাম। ১৯৯৯ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি কুষ্টিয়ার দৌলতপুরে কালিদাসপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় মাঠে একটি সভা চলার সময় ব্রাশ ফায়ারে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদের পাঁচজন নেতা নিহত হন। দলটির প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি কাজী আরেফ আহমেদ ছাড়াও নিহত হন তৎকালীন কুষ্টিয়া জেলা জাসদের সভাপতি লোকমান হোসেন, সাধারণ সম্পাদক ইয়াকুব আলী, স্থানীয় জাসদ নেতা ইসরায়েল হোসেন এবং শমসের মণ্ডল।
ওই হত্যাকাণ্ডের পাঁচ বছর পর ২০০৪ সালের ৩০ আগস্ট ১০ জনের ফাঁসি এবং ১২ জনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন কুষ্টিয়া জেলা জজ। তবে ওই রায়ের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে আপিল করা হলে, ২০০৮ সালের ৫ আগস্ট হাইকোর্ট নয়জনের ফাঁসির আদেশ বহাল রাখেন, একজনকে খালাস দেন ও ১২ জনের সাজা মওকুফ করেন। ওই হত্যাকাণ্ডের প্রায় ১৭ বছর পর অভিযুক্ত তিন আসামির ফাঁসি কার্যকর হয় দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সবচেয়ে বড় কেন্দ্রীয় কারাগার যশোরে।
আর সর্বশেষ সোমবার রাত ১০টা ৪৫ মিনিটে চুয়াডাঙ্গার আলমডাঙ্গা উপজেলায় দুই বান্ধবীকে দলবদ্ধভাবে ধর্ষণের পর খুনের মামলায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত দুই আসামির ফাঁসির আদেশ কার্যকর হয়েছে। রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষার আবেদন নাকচ হওয়ার পর চুয়াডাঙ্গার অলোচিত ধর্ষক ও খুনি কালু ও আজিজুলের ফাঁসি কার্যকরের সব প্রস্তুতি নেয় যশোর কারা কর্তৃপক্ষ।
শনিবার যশোর কেন্দ্রীয় কারাগারে গিয়ে শেষবারের মতো তাদের দুই জনের স্বজনেরা তাদের সঙ্গে দেখা করেছেন। বিচারিক ও আইনি প্রক্রিয়া শেষে এই ফাঁসি কার্যকরের মধ্য দিয়ে দেড় যুগ পর ন্যায়বিচার পেল ভুক্তভোগী দুই পরিবারের। মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত দুই আসামি হলেন চুয়াডাঙ্গার আলমডাঙ্গা উপজেলার খাসকররা ইউনিয়নের রায় লক্ষ্মীপুর গ্রামের মিন্টু ওরফে কালু ও একই গ্রামের আজিজ ওরফে আজিজুল। আজিজুল ওরফে আজিদ ওরফে আজিজ এবং মিন্টু ওরফে কালু আলমডাঙ্গার রায় রায়লক্ষ্মীপুর গ্রামের দুই বান্ধবীকে ধর্ষণের পর হত্যা করে।
Advertisement
মিলন রহমান/এমআরএম