প্যানডোরা পেপারসকে কেন্দ্র করে তোলপাড় শুরু হয়েছে বিশ্বে। পানামা পেপারসের পর এবার গোপন ও অনৈতিক লেনদেনের তথ্য ফাঁসের ঘটনায় চারদিক সরগরম করে তুলেছে প্যানডোরা পেপারস। এখন পর্যন্ত অন্যতম বৃহৎ আর্থিক দলিল ফাঁসের ঘটনা এটি। বিশ্বের একের পর এক নেতা, রাজনীতিবিদ, ধনকুবের, ব্যবসায়ী, অভিনেতা, খেলোয়াড় কারও নামই যেন বাদ যাচ্ছে না। তাদের গোপন সম্পদ ও লেনদেনের তথ্য বেরিয়ে আসতে শুরু করেছে।
Advertisement
জর্ডানের বাদশাহ আবদুল্লাহ, রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন, চেক প্রধানমন্ত্রী আন্দ্রেই বাবিস, আজারবাইজানের প্রেসিডেন্ট ইলহাম আলিয়েভ, কেনিয়ার প্রেসিডেন্ট উহুরু কেনিয়াত্তা, সাবেক ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ার, পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের মন্ত্রিসভার একাধিক সদস্য, সিনেটর, সাবেক সেনা কর্মকর্তা, মিডিয়া হাউজের মালিক, ব্যবসায়ী, ভারতের তিন শতাধিক প্রভাবশালী ব্যক্তি, ধনকুবের অনিল আম্বানি, সাবেক ক্রিকেটার শচীন টেন্ডুলকার, বলিউড অভিনেতা জ্যাকি শ্রফ, বেশ কয়েকজন প্রভাবশালী রাজনীতিক, ব্যবসায়ী, সরকারি কর্মকর্তাসহ বিশ্বের বহু নেতার গোপন সম্পদের তথ্য ফাঁস হয়েছে।
বিবিসি প্যানোরামা, ব্রিটিশ দৈনিক গার্ডিয়ান এবং আরও কিছু মিডিয়া অংশীদার মিলে বিশ্বের ১৪টি কোম্পানির ১ কোটি ২০ লাখ দলিলপত্র হাতে পেয়েছে। এই দলিলপত্র উদ্ঘাটন করেছে ওয়াশিংটনভিত্তিক ইন্টারন্যাশনাল কনসোর্টিয়াম অব ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিস্টস (আইসিআইজে)। ৬ শতাধিক সাংবাদিক এবং দেড় শতাধিক মিডিয়া আউটলেটের দুই বছরের প্রচেষ্টায় এসব গোপন নথি হাতে এসেছে।
সেখানে ২০০৩ সালের সেপ্টেম্বরে ইউরোপের দেশ মোনাকোতে একটি গোপন লেনদেনের কথা বলা হয়েছে। একটি বিলাবহুল ফ্ল্যাটের হাতবদল হয়। চুক্তিতে সই করেছিল একটি স্থানীয় নোটারি। এতে ৩৬ লাখ ইউরোর বিনিময়ে ক্রেতা পেয়েছিলেন মন্টে কার্লো স্টার কমপ্লেক্সের চতুর্থ তলায় ঝকঝকে একটি ফ্ল্যাট, দুটি পার্কিং স্পেস, একটি স্টোররুম ও সুইমিংপুল ব্যবহারের সুযোগ। ফ্ল্যাটের ক্রেতার পরিচয় গোপন ছিল। বাইরে থেকে দেখলে এ ঘটনায় রাশিয়ার যোগসূত্র খুঁজে পাওয়া মুশকিল, তবে আসল ক্রেতার পরিচয় লুকানো ছিল আরও গভীরে।
Advertisement
ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ান নথিপত্র ঘেঁটে দেখেছে, ওই ফ্ল্যাটের আসল মালিক একজন নারী। ২০০৩ সালে ফ্ল্যাটটি কেনার সময় তার পরিচয় প্রকাশ করা হয়নি। তখন তার বয়স ছিল ২৮ বছর। প্যানডোরা পেপারসের কল্যাণে অবশেষে জানা গেলো সেই নারীর নাম সভেৎলানা ক্রিভোনোগিখ। মাত্র কয়েক বছরেই আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়েছিল তার। নিজের আদিনিবাস সেন্ট পিটারসবার্গে অভিজাত এলাকায় ফ্ল্যাট, মস্কোয় সম্পত্তি, একটি ইয়টসহ আরও অনেক সম্পদ হয়েছিল ক্রিভোনোগিখের, যার আনুমানিক মূল্য ১০ কোটি ডলারের বেশি।
হঠাৎ কীভাবে এত সম্পদের মালিক হলেন তিনি? গণমাধ্যমের খবর, ক্রিভোনোগিখের অতীত একেবারে সাদামাটা। তিনি থাকতেন ঘনবসতিপূর্ণ একটি অ্যাপার্টমেন্টে। আর পাঁচটা পরিবারের সঙ্গে বাথরুম ও রান্নাঘর ভাগাভাগি করতে হতো তাকে। ক্রিভোনোগিখ পড়াশোনা করেছেন বাণিজ্য বিষয়ে। একসময় দোকানে পরিচ্ছন্নতাকর্মীর কাজও করেছেন। তবে নব্বই দশকের শেষের দিকে একজন শুভানুধ্যায়ী জোটে তার। সেই মানুষটি আর কেউ নন, স্বয়ং রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন।
২০২০ সালে প্রোয়েক্ট নামে রাশিয়ার একটি অনুসন্ধানী ওয়েবসাইট দাবি করে, সেন্ট পিটারসবার্গের মেয়র থাকার সময় পুতিনের সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়ে তোলেন ক্রিভোনোগিখ। একসময় পরিণত হন প্রেমিকায়। তাদের সম্পর্কটা কী ধরনের ছিল তা নিশ্চিত না হলেও পুতিন-ক্রিভোনোগিখ বেশ ঘনিষ্ঠ ছিলেন। বিভিন্ন সময়ে তারা একই প্লেনে সঙ্গী হওয়ার প্রমাণ রয়েছে। গোয়েন্দাপ্রধান থেকে রুশ প্রধানমন্ত্রী, এরপর প্রেসিডেন্ট হওয়ার পথে পুতিনকে সঙ্গ দিয়ে গেছেন ক্রিভোনোগিখ।
ব্রিটেনের সাবেক প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ার ও তার স্ত্রীর ব্যাপারে জানা গেছে যে, তারা লন্ডনে একটি অফিস কেনার সময় ৩ লাখ ১২ হাজার পাউণ্ড কর স্ট্যাম্প শুল্ক বাঁচিয়েছেন। ওই ভবনের মালিক একটি বিদেশি কোম্পানিও তারা কিনে নিয়েছেন।
Advertisement
এদিকে বিবিসির এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, জর্ডানের বাদশাহ দ্বিতীয় আবদুল্লাহ বিন আল হুসেইন ৭ কোটি পাউণ্ড (১০ কোটি ডলার) ব্যয় করে ব্রিটেন ও যুক্তরাষ্ট্রে বিরাট সাম্রাজ্যের মালিক হয়েছেন। তবে জর্ডানের বাদশাহ’র আইনজীবীরা জানিয়েছেন, তার জমি এবং বাড়িগুলো ব্যক্তিগত অর্থ ব্যয় করেই কেনা। নিরাপত্তা ও গোপনীয়তা রক্ষার স্বার্থেই এমন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের সম্পত্তি অফশোর কোম্পানির মাধ্যমে কেনা হয়। এটা অনৈতিক নয় বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
চীনের রাষ্ট্রায়ত্ত তিনটি ব্যাংকের সঙ্গে ঝামেলার জেরে ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে লন্ডনের একটি আদালতে নিজেকে দেউলিয়া ঘোষণা করেন ভারতীয় ধনকুবের অনিল আম্বানি। এর তিন মাস পর ব্যাংগুলোকে ৭১ কোটি ৬০ লাখ ডলার পরিশোধের নির্দেশ দেওয়া হয় তাকে। কিন্তু আদালতে আম্বানি জানান, তার সেই সক্ষমতা নেই। বিশ্বের কোথাও কোনো সম্পত্তি নেই বলেও এসময় দাবি করেন রিলায়েন্স এডিএ গ্রুপের চেয়ারম্যান।
কিন্তু এবার সেই আম্বানিরই বিপুল গোপন সম্পত্তির তথ্য ফাঁস করেছে প্যানডোরা পেপারস। তাদের দাবি, ব্রিটিশ ভার্জিন আইল্যান্ড, জার্সি ও সাইপ্রাসে মোট ১৮টি অফশোর কোম্পানির মালিকানা রয়েছে ভারতীয় এ ব্যবসায়ীর। ২০০৭ থেকে ২০১০ সালের মধ্যে চালু করা এসব কোম্পানি ১৩০ কোটি ডলারের বেশি ঋণ নিয়েছে বা বিনিয়োগ করেছে।
প্যানডোরা পেপারসে নাম এসেছে পলাতক হীরা ব্যবসায়ী নীরব মোদীর, কোটিপতি উদ্যোক্তা কিরণ মজুমদার শয়ের স্বামী জন ম্যাককালাম মার্শাল শয় এবং বলিউড অভিনেতা জ্যাকি শ্রফের। তবে তালিকায় যে নামটি সবচেয়ে বেশি অবাক করেছে তা হচ্ছে ভারতীয়দের ‘ক্রিকেট ঈশ্বর’ শচীন টেন্ডুলকার ও তার স্ত্রী অঞ্জলি। প্যানডোরা পেপারসের তালিকায় আরও রয়েছেন ভারতের কিছু রাজনীতিবিদ, যাদের মধ্যে কয়েকজন সাবেক সংসদ সদস্য। বর্তমানে তারা ভারতীয় তদন্ত সংস্থার নজরদারিতে রয়েছেন।
পাকিস্তানের প্রভাবশালীদের মধ্যে নাম রয়েছে অর্থমন্ত্রী শওকত তারিন, পানিসম্পদমন্ত্রী মুনিস এলাহি, সিনেটর ফয়সাল ভাওদা, মুসলিম লিগ (এন) নেতা ইশহাক দারের ছেলে আলি দার, পিপিপি নেতা শারজিল মেমন, শিল্পমন্ত্রী খুসরো বখতিয়ারের পরিবার, পিটিআই নেতা আব্দুল আলিম খান প্রমুখের। এদের মধ্যে অনেকেই ইমরান খানের ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত।
পাকিস্তানের ক্ষমতাসীন দলের একাধিক নেতার নাম প্যানডোরা পেপারসে আসার জেরে প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগ দাবি করেছে বিরোধী দল মুসলিম লিগ (নওয়াজ)। রোববার (৪ অক্টোবর) এক সংবাদ সম্মেলনে দলটির মহাসচিব আহসান ইকবাল বলেছেন, প্যানডোরা পেপারসে ইমরান খানের নাম ছড়ানোয় আর প্রধানমন্ত্রী পদে থাকার নৈতিক অধিকার নেই।
এছাড়া কেনিয়ার প্রেসিডেন্ট উহুরু কেনিয়াত্তার পরিবারের নামও উঠে এসেছে প্যানডোরা পেপারসে। কেনিয়াত্তা এবং তার পরিবারের ছয় সদস্যের সঙ্গে ১৩টি অফশোর কোম্পানির সত্যতা খুঁজে পাওয়া গেছে। এ বিষয়ে তাদের কাছ থেকে কোনো মন্তব্য পাওয়া যায়নি। সামনের দিনগুলো আরও দেশের নেতা, রাজনীতিবিদ এবং ধনকুবেরের নাম দেখেও হয়তো চমকে উঠবে মানুষ।
টিটিএন/এএসএম