ডা. সেলিনা সুলতানা
Advertisement
চার বা পাঁচ বছর বয়সী একটি ছেলে বা মেয়ের সবকিছুই একদম স্বাভাবিক, কোথাও কোনো ছন্দপতন নেই। সে স্কুলে যাচ্ছে, খেলছে, দুষ্টুমি করছে। তবে যখন তাকে কিছু লিখতে বলা হচ্ছে তখনই জড়তা এসে ঘিরে ধরছে।
পেনসিল ধরতে সমস্যা হয়, অক্ষরগুলো কেমন যেন উল্টোপাল্টা মনে হয়, বানানও ভুল হচ্ছে। অথচ সে কিন্তু অন্যান্য পড়া মুখস্থ বলতে পারছে। মা-বাবা ভাবছেন পড়াশোনায় অনীহা বা দুষ্টুমি করছে তার সন্তান।
চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় এই ধরনের সমস্যাকে বলা হয় ডিসগ্রাফিয়া, এটি একটি নিউরোলজিকাল ডিসঅর্ডার। ইনস্ট্রাকশন শুনে সেই আকৃতি ভেবে লিখতে গেলে সমস্যা হয় এমন রোগীদের।
Advertisement
ডিসগ্রাফিয়া হলো এক ধরনের শিক্ষণগত অক্ষমতা। যেখানে শিশুর হাতের লেখার মাধ্যমে মনের ভাব প্রকাশে ও হাতের সূক্ষ্ম কাজের ক্ষেত্রে সমস্যা হয়। শিশু আকৃতিগত পার্থক্য করতে পারে না। অক্ষর লেখার জায়গাটি কোথায় ও কতটুকু জায়গাজুড়ে হবে তা ঠিক করতে পারে না।
এমন শিশুর বাম থেকে ডানে শব্দগুলোকে লিখতে সমস্যা হয়। অক্ষরগুলো একদিকে না লিখে বিভিন্ন দিকে লেখে তারা। লাইন ও মার্জিন মেনে লিখতে সমস্যা হয়। দেখে দেখে লিখতে গেলেও সময় বেশি লাগে। অনেক শিশুই লিখতে গিয়ে b আর d, p আর q এর মধ্যে গুলিয়ে ফেলে। সহজ বানানও ভুল করে তারা। তার মানেই কি সে ডিসগ্রাফিয়ায় আক্রান্ত?
না, লক্ষণ দেখে এটি বুঝতে হবে। কোনো শিশুর মধ্যে যদি সব ক’টি বা অধিকাংশ লক্ষণ দেখা যায়, তাহলে বুঝতে হবে সে ডিসগ্রাফিয়ায় ভুগছে। এটি যে শুধু শিশুদের হয় তা নয়। পূর্ণবয়স্ক মানুষও এই রোগে আক্রান্ত হতে পারেন। কোনো দুর্ঘটনার কারণে মাথায় গুরুতর আঘাত লাগলে ও এই সমস্যা দেখা যেতে পারে।
সাধারণত ডিসগ্রাফিয়া দুই ধরনের হয়- ব্রেন ইনজুরির কারণে অ্যাকোয়ার্ড ডিসগ্রাফিয়া ও জন্মগত হলে তাকে বলা হয় ডেভেলপমেন্টাল ডিসগ্রাফিয়া। তবে আসল সমস্যা হলো, এই রোগ পুরোপুরি সারে না। বড়দের ক্ষেত্রে ব্রেন ইনজুরির মাত্রার উপরে নির্ভর করে সমস্যা কতটা জটিল। শিশুদেরকে ক্রমাগত থেরাপি দিতে হয়।
Advertisement
ডিসগ্রাফিয়ায় আক্রান্তদের ফাইন মোটর স্কিলের ক্ষেত্রেও সমস্যা থাকে। দু’ধরনের মোটর স্কিল হয়- ফাইন মোটর ও গ্রস মোটর। জিনিস ধরার জন্য যে বিগ মাসলের ব্যবহার হয়, তা হলো গ্রস মোটর স্কিল। যেমন বড় বল, বই, ব্যাগ ইত্যাদি।
ছোট ছোট সূক্ষ্ম জিনিস যেমন পেনসিল, পুঁতি, দানাশস্য- এগুলো ধরার জন্য স্মল মাসলের ব্যবহার হয়। জুতোর ফিতা বাঁধা, কাঁচি দিয়ে কিছু কাটা, লাইনের ভেতরে রং করা এগুলো ফাইন মোটর স্কিলের মধ্যে পড়ে।
এ রোগের লক্ষণ বা উপসর্গ শিশুটির বাবা মা ও শিক্ষকের কাছে প্রথম পরিলক্ষিত হয়। ডিসগ্রাফিয়া আক্রান্তদের ছোটখাটো জিনিস যেমন পেনসিল ধরতে সমস্যা হয়। এরা হয়তো তা খুব জোরে ধরে বা অদ্ভুতভাবে ধরে। অক্ষর ও সংখ্যার আকার সঠিকভাবে দিতে সমস্যা হয়।
হাতে লেখার সময় বাক্য ও শব্দের মধ্যে সময় ব্যবধান রাখতে সমস্যা বোধ করে অনেক শিশু। ইংরেজি ভাষার ক্ষেত্রে বড় হাতের ও ছোট হাতের অক্ষর বুঝতে অসুবিধা হয়। পৃষ্ঠার লাইন ও মার্জিন মেনে লিখতে সমস্যা বোধ করে এধরনের শিশুরা। লিখতে গেলে ক্লান্ত হয়ে যায়। এ কারণে লিখতে চায় না তারা।
ডিসগ্রাফিয়া সম্পর্কে ধারণা না থাকলে অভিভাবক ও শিক্ষকরা শিশুকে অযথাই অলস বা দুষ্টু মনে করেন। ফলে শিশুর মধ্যে হতাশা তৈরি হয়। শিশু নিজেকে খারাপ ও অপদার্থ মনে করতে থাকে। ফলে তার লেখাপড়ায়, জীবনযাপনে ও সামাজিক কর্মকাণ্ডে। অথচ তার সমস্যাগুলো বুঝলে থেরাপির মাধ্যমে এ সমস্যা কমিয়ে আনা যায়।
শিক্ষাগ্রহণ সংক্রান্ত সমস্যা যেমন ডিসলেক্সিয়া বা ডিসক্যালকুলিয়ার তুলনায় ডিসগ্রাফিয়ার সম্পর্কে অনেকেরই সচেতনতা কম। এ কারণে ডিসগ্রাফিয়া সহজে ধরা পড়ে না। বাবা-মা এটিকে দুষ্টুমি মনে করেন ও খুব একটা গুরুত্ব দিতে চান না বলে সমস্যাটি ধরা পড়ে না।
ডিসগ্রাফিয়া হওয়ার সঠিক কারণ গবেষকরা এখনও জানতে পারেননি। তবে ধরে নেওয়া হয়, মস্তিষ্কের তথ্য বিশ্লেষণ ক্ষমতার সমস্যার জন্য ডিসগ্রাফিয়া হয়। তবে বড়দের ক্ষেত্রে দেখা যায় মস্তিষ্কের প্যারাইটাল লোবের সঙ্গে সম্পর্ক যুক্ত থাকে। অন্যান্য লার্নিং ডিজেবিলিটিস মতো ডিসগ্রফিয়া জেনেটিক। একটি পরিবারের এক সদস্য আক্রান্ত থাকলে এটি পরবর্তী বংশধর এর মধ্যে চলে যেতে পারে।
ডিসগ্রাফিয়ার কোন নির্দিষ্ট চিকিৎসা নেই। বিভিন্ন ধরনের ক্রিয়ার (অকুপেশনাল থেরাপি) সাহায্যে শিশুর লেখার উন্নতি করা হয়। এ রোগের কোনো চিরস্থায়ী সমাধান নেই। সারাজীবন থেরাপির মধ্য দিয়ে যেতে হবে। এমন শিশুদের হাতের লেখা খারাপ হলেও উৎসাহ দিন। কারণ ওইটুকু লিখতেই ওর অনেকটা কষ্ট হচ্ছে। আরও যা যা করবেন-
>> আজকাল পেনসিলের গ্রিপ কিনতে পাওয়া যায়, যাতে ওরা সহজে পেনসিল ধরতে পারে।
>> ফাইন মোটর স্কিল ডেভেলপ করার জন্য ওদের পুঁতি দিয়ে মালা করতে দেয়া যেতে পারে।
>> বিভিন্ন ধরনের পেনসিল আর কলম কিনে শিশুকে ব্যবহার করতে দিন, যাতে জানা যায় ও কোনটা দিয়ে সব থেকে বেশি ভালভাবে লিখতে পারছে।
>> এমন পৃষ্ঠা ব্যবহার করুন যাতে দুটো সারির মধ্যে ব্যবধান বেশি আছে। এতে শিশু অনায়াসে সারি ধরে লিখতে পারে।
>> ছবি, অলঙ্করণ ও ধ্বনিতত্বের সাহায্যে অক্ষর এবং শব্দের সঙ্গে শিশুর পরিচয় করানোর চেষ্টা করুন যাতে সে অক্ষর ও শব্দ চিনে লিখতে শেখে।
>> বিশেষ ধরনের প্রযুক্তি ও শব্দের দ্বারা সক্রিয় হওয়া সফ্টওয়ার (শব্দ আর অক্ষর বিশ্লেষণ প্রক্রিয়া) ব্যবহার করুন, যা লেখার ক্ষমতার বিকাশে সাহায্য করে। >> শিশুটিকে স্কুলে পরীক্ষার সময় সাধারণের চেয়ে বেশি সময় দিতে হবে।
>> টেপ রেকর্ডারের সাহায্যে স্কুলের পড়া রেকর্ড করে রাখুন। বাড়িতে সেটি চালিয়ে শুনে শুনে লেখার অভ্যাস করতে বলুন শিশুকে।
>> কম্পিউটার দেওয়া যেতে পারে। কারণ টাইপ করতে সমস্যা তাদের সমস্যা হয় না। সঙ্গে থাকতে হবে অডিও ইনস্ট্রাকশনের ব্যবস্থা।
>> লেখার বদলে মৌখিক পরীক্ষা নেওয়া যেতে পারে।
>> কোনো জিনিস শেখানোর জন্য অন্যান্য ইন্দ্রিয়ের সাহায্য নিতে অভ্যস্ত করান। স্পর্শ, গন্ধ, দৃষ্টি, শ্রবণ এগুলো কাজে লাগাতে হবে।
আমরা সাধারণত যে কাজটা পারি না, সেটা এড়িয়ে যাই। ডিসগ্রাফিয়া আক্রান্তদের ক্ষেত্রেও তাই। ওদের মানসিক চাপ কাটাতে হবে। বুঝিয়ে বা নানা কৌশলে লেখাতে হবে। কারণ লেখার প্রসঙ্গ এলেই তারা ভীত হয়ে যায়। মা-বাবাকে তো বোঝাতে হবেই সঙ্গে কাউন্সেলিংও জরুরি।
অটিজম স্পেকট্রাম ডিজঅর্ডারের সঙ্গে ডিসগ্রফিয়ার একটি যোগাযোগ আছে। ডিসগ্রফিয়া একটি কোমরবিড ডিজঅর্ডার যা অটিজম এর সঙ্গে যুক্ত। ডিসগ্রাফিয়ার সঙ্গে অন্যান্য শিক্ষাগত অক্ষমতাও থাকতে পারে। প্রয়োজনে সেগুলোও পরীক্ষা করাতে হবে। শিশুকে ভালো করে পর্যবেক্ষণ করতে হবে ও তার সমস্যাগুলো তার মতো করে বোঝার চেষ্টা করতে হবে।
মস্তিষ্কে আঘাতপ্রাপ্ত হয়ে ডিসগ্রফিয়া আক্রান্ত বড়দের ক্ষেত্রেও মানসিক সমস্যা কম নয়। একজন সুস্থ স্বাভাবিক মানুষ যিনি সব পারতেন হঠাৎ একদিন আর লিখতে পারছেন না। বাকি সব স্বাভাবিক। তাদেরও কাউন্সেলিং জরুরি।
যারা স্কুল-কলেজে পড়ছেন তারা অবশ্য কম্পিউটার ব্যবহার করতে পারেন, পরীক্ষার হলে রাইটার নিতে পারেন। সঙ্গে চালু রাখতে হবে থেরাপি। যারা অফিসে কাজ করেন তারাও হাতে লেখালেখির বদলে কম্পিউটারের সাহায্যে কাজ চালাতে পারেন।
ডিসগ্রাফিয়ার সন্দেহ হলে অভিজ্ঞ এডুকেশনাল বা ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্টের কাছে গিয়ে পরামর্শ নিতে হবে। যেহেতু এই রোগের কোনো স্থায়ী সমাধান নেই, তাই নানা কৌশলের মাধ্যমে যতটা সম্ভব এই সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে উঠতে হয়। এজন্য দরকার বাবা-মা ও শিক্ষকদের ধৈর্য ও শিশুটির যত্ন।
লেখক: কনসালটেন্ট, চাইল্ড ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড পেডিয়াট্রিক; স্পেশালিস্ট ইন নিউরোডেভেলপমেন্টাল ডিজঅর্ডার অ্যান্ড অটিজম, বেটার লাইফ হসপিটাল।
জেএমএস/জিকেএস