রাজনীতি

‘ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ’ করেছেন মেয়র জাহাঙ্গীর!

# বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে ‘কটূক্তি’# ‘বহিষ্কার’ দাবি গাজীপুর আ’লীগের# শোকজের জবাবের অপেক্ষায় কেন্দ্রীয় আ’লীগ

Advertisement

নির্বাচন, ইশতেহারসহ নানা কিছু ছাপিয়ে এখন ক্ষমতাসীন শিবিরের আলোচনার কেন্দ্রে গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সিটি মেয়র জাহাঙ্গীর আলম। এরই মধ্যে বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তার ‘কটূক্তি’র ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। তাকে শোকজও করেছে কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ। এ ইস্যুতে দুই গ্রুপ হয়ে গেছে গাজীপুর ও কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগে। অনেকে বিব্রতকর এ বিষয়ে চুপ থাকার নীতিতে আছেন। আবার কেউ কেউ তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জোর দাবি তুলেছেন।

গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতিসহ অনেকে এটিকে ‘ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ’ বলে উল্লেখ করেছেন। মেয়র জাহাঙ্গীরকে দল থেকে বহিষ্কার দাবি করে সড়ক অবরোধ করে গত কয়েক দিন মিছিল-সমাবেশও করেছেন নেতাকর্মীরা। তারা জাহাঙ্গীরের শাস্তি হিসেবে বহিষ্কার ছাড়া কিছু ভাবতে নারাজ।

এতদিন গাজীপুরে দলের নেতাকর্মীরা তার বিরুদ্ধে নামলেও এবার তাকে শোকজ করেছে কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ। শোকজের জবাব সন্তোষজনক না হলেই শাস্তির মুখে পড়তে হবে মেয়র জাহাঙ্গীরকে। রোববার (৩ অক্টোবর) ‘দলের স্বার্থপরিপন্থী কর্মকাণ্ড ও সাংগঠনিক শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে’ তাকে শোকজ চিঠি পাঠিয়েছে কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ।

Advertisement

মেয়র জাহাঙ্গীরের বহিষ্কারের দাবিতে মিছিল

এর আগে শনিবার (২ অক্টোবর) সন্ধ্যায় আওয়ামী লীগ সভাপতির কার্যালয়ের দলীয় আড্ডায় এ নিয়ে বাগবিতণ্ডা হয়। এসময় আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য মতিয়া চৌধুরী, সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক সম্পাদক মৃণাল কান্তি দাস, কার্যনির্বাহী সদস্য ইকবাল হোসেন অপু ও আব্দুল আউয়াল শামীম উপস্থিত ছিলেন। এছাড়া দলের পদে না থাকা তিনজন কর্মী সেখানে উপস্থিত ছিলেন।

জানা গেছে, দলীয় এ আড্ডায় একজন সদস্য বিষয়টি উত্থাপন করেন। তিনি বলেন, ‘জাহাঙ্গীর যা বলছে, এগুলো তো ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ।’ তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য তিনি সাধারণ সম্পাদকের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। এসময় ওই সদস্যকে আক্রমণ করে কথা বলেন ওবায়দুল কাদের। উভয়ের বেশ বাগবিতণ্ডা হয়। পরে উপস্থিত যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক কথা বলে পরিস্থিতি শান্ত করেন।

দলীয় সূত্র বলছে, এ ঘটনায় দলের সভাপতি পর্যন্ত গড়ায়। যার পরিপ্রেক্ষিতে রোববার গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর আলমকে শোকজ করা হয়। পাশাপাশি দলীেয় কার্যালয়ে ওই সময়ের সিসিটিভি ফুটেজ তলব করেছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি।

Advertisement

টঙ্গীতে মেয়র জাহাঙ্গীরের বিরুদ্ধে ঝাড়ুমিছিল

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সম্প্রতি বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে ‘কটূক্তি’র ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়। এ নিয়ে তীব্র সমালোচনা শুরু হয়। ফেসবুকে ভাইরাল হওয়া ১১ মিনিট ২৩ সেকেন্ডের ভিডিওতে দেখা যায়, বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধ ছাড়াও মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি আজমত উল্লাহ খান, যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী জাহিদ আহসান রাসেল, হেফাজতের প্রয়াত নেতা জুনায়েদ বাবুনগরীর সঙ্গে তার সখ্য ও রাষ্ট্রীয় দুটি সংস্থা নিয়ে নানা আপত্তিকর মন্তব্য করেছেন মেয়র জাহাঙ্গীর।

সেই ভিডিওতে মেয়র বলেন, ‘আমি যদি ছবি দিয়েই থাকি, আমি শেখ হাসিনা ও বঙ্গবন্ধুর নিচে কারও ছবি দেইনি। আমি কোনো দিনই রাসেল সাহেবের ছবি দেই নাই, মোজাম্মেল হকের ছবিও দেই নাই। আমার নেত্রী শেখ হাসিনা।’ ওই সময় অন্যজন বলেন, ‘টার্গেট ঠিক’।

মেয়র জাহাঙ্গীর বলেন, ‘তোমার টার্গেট হচ্ছে মামুন পর্যন্ত। তুমি উঠলে কুদ্দুর (কতটুকু) উঠবা। তুমি তো স্বপ্নই দেখ না। মানুষ স্বপ্ন দেখে না? মানুষ ছোট থাকতে জিগায় ডাক্তার হমু, ইঞ্জিনিয়ার হমু, চেয়ারম্যান, মন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রী হমু, বলে না বাচ্চারা? তোমার টার্গেট হয়েছে তুমি মামুনের মতো হবা। যদি পিতারে অস্বীকার করে সে জারজ সন্তান হবে। মামুন প্রথমেই একজন মেয়রকে অস্বীকার করে, সে জারজ সন্তান তো। আমরা চাই এটা করতে, আমাদের চার-পাঁচজন কাউন্সিলর চায় উল্টো। হিসেবে এগুলোরে মেরে ফেলা উচিত। পৃথিবীর অন্য দেশ হলে মেরে ফেলা হতো। চায়না হলে সঙ্গে সঙ্গে মেরে ফেলতো। তুমি যদি ডেভেলপের অ্যান্টিতে থাকো, যেমন- চায়নায় ছাত্ররা যখন আন্দোলন করেছে, তখন হেলিকপ্টারে করে বোম দিয়ে মাইরালাইছে। চায়নার জাতির পিতা এ কাজ করেছে।’

বিরোধীদের হটিয়ে পাল্টা সমাবেশ করেন মেয়র জাহাঙ্গীর 

এরপর তিনি বঙ্গবন্ধু এবং মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বেশকিছু কথা বলেন। এরপর তাকে আরও বলতে শোনা যায়, ‘আমরা যদি ব্রিটিশদের সঙ্গে থাকতাম, পৃথিবীর লেটেস্ট জাতি থাকতাম। ভারতবর্ষ হিন্দুদের দিতো না, আমাদের দিতো। তারপর ভারতবর্ষ, পাকিস্তান ও বাংলাদেশ হয়েছে। ব্রিটিশরা ভারত-পাকিস্তানে ভাগ করে দেয়। তারপর মুসলমানরা আবার আলাদা চায়। তারপর আবার পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তানে ভাগ হয়ে যায়। যার যার স্বার্থের জন্য এ ভাগ করা হয়।’

গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি আজমত উল্লাহ খানের প্রসঙ্গে ভিডিওতে বলতে শোনা যায়, ‘আজমত উল্লাহ আমারে জীবনে মারার লাইগা লোক কন্টাক্ট (ঠিক) করছে, সব করছে। এখন সে আমার কর্মী হইছে। নেত্রী আমারে জিগায় কী করছো? আমারে কয়দিন জিগাইছে কী করো, কেমনে সম্ভব? হেও সব জানে না! আমি তো খেলা জিতছি। আমার নেত্রী তারে ছোট করে দিয়েছে।’

ভিডিওতে জাহাঙ্গীর আরও বলেন, ‘আজকে পর্যন্ত তার (মামুন) কোনো ক্ষতি করিনি। আমি মন্ত্রীরে নিয়া মাথা ঘামাই না। জাহিদ আহসান রাসেল আছে না? তারে নিয়া আমি এক মিনিটও চিন্তা করি না। খালি জাস্ট শুইনা রাখো, বিশ্বাস করার দরকার নাই।’

মেয়র জাহাঙ্গীরের বহিষ্কারের দাবিতে সড়ক অবরোধ

তিনি বলেন, ‘আমি জামায়াতের সাথে চলি না? বিএনপির সাথে চলি না? অন্য পার্টি আছে না, সবার সাথেই তো কথা বলি। এই যে আমার সাথে ঘণ্টা তিনেক আগেও বাবুনগরী (হেফাজতের প্রয়াত আমির বাবুনগরী) প্রায় ৪৭ মিনিট কথা বলছে। সে আসতে চায়। আমি কথা বলছি না? ধীরাশ্রম, ঝাঝর, চান্দরা আছে ৮/১০ বিঘা, দিঘিরচালা আছে ১৬ বিঘা, তেলিপাড়াও আছে। আমার এখানে সাড়ে তিনশ বিঘা জমি আছে। এ নির্বাচনের সময়েও ১০ হাজার কোটি টাকা আনছি।’

এদিকে, ওই ভিডিও ভাইরাল হওয়ায় ক্ষোভে ফেটে পড়েন আওয়ামী লীগ ও অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীরা। মেয়র জাহাঙ্গীর আলমকে গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের পদ থেকে বহিষ্কারের দাবি জানানো হয়।

ভিডিও ভাইরালের পর গত ২১ সেপ্টেম্বর থেকে গাজীপুরের বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভ ও প্রতিবাদ সভা করছে জেলা আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। এরই মধ্যে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের কোথাও ঝাড়ুমিছিল, কোথাও বিক্ষোভ মিছিলসহ সড়কে টায়ার জ্বালিয়ে প্রতিবাদ করেন তারা।

এছাড়া ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের টঙ্গী স্টেশন রোড, মিলগেট, চেরাগ আলী, কলেজগেট ও হোসেন মার্কেট এলাকায় স্থানীয় আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগসহ বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীরা ঝাড়ু নিয়ে বিক্ষোভ মিছিল করেন। ওই এলাকায় সড়ক অবরোধ করে টায়ারে আগুন দিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন দলের নেতাকর্মীরা।

সাতদিনের জন্য ভারত গেলেও এ ঘটনার তিনদিনের মধ্যে দেশে ফেরেন মেয়র। দেশে এসে অনুসারীদের নিয়ে প্রতিবাদ সমাবেশও করেছেন। তবে বেশ কিছুদিন ধরে এলাকায় গেলেও সন্ধ্যা নামতেই ঢাকায় চলে আসছেন তিনি। ছুটছেন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতাদের বাসায় ও অফিসে। নেতাদের বিভিন্নভাবে বুঝানোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।

জাহাঙ্গীরকে শোকজের চিঠি

অন্যদিকে গাজীপুরের গাছা থানায় মেয়র জাহাঙ্গীর আলমসহ চারজনের বিরুদ্ধে সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেছেন মহানগর তাঁতী লীগের সিনিয়র সহ-সভাপতি মো. জামাল খান। তিনি তার ফেসবুক আইডি থেকে ভাইরাল হওয়া সেই ভিডিওটি শেয়ার করেছেন বলেও জিডিতে উল্লেখ করেছেন। এ নিয়ে তিনি নিজের এবং পরিবারের নিরাপত্তা শঙ্কার কথা জানান।

জামাল খান বলেন, ‘আমি থানায় জিডি করেছি। নিরাপত্তার স্বার্থে বর্তমানে বাইরে আছি। থানার ওসির সঙ্গে যোগাযোগ করলে জিডির নম্বর দিয়ে দেবে।’

তবে গাছা থানার ওসি মো. ইসমাইল হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, ‘আমরা এমন কোনো অভিযোগ বা জিডি পাইনি।’

মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি আজমত উল্লাহ খান জাগো নিউজকে বলেন, ‘বক্তব্য যেটা আসছে, এটা তো একেবারেই ক্ষমার অযোগ্য। বঙ্গবন্ধু ও মহান মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কটূক্তি ও মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের একটা গাণিতিক হিসাব দিয়ে ৩০ লাখকে দুই লাখ বলে প্রমাণের অপচেষ্টা করেছেন তিনি। এ বক্তব্য অবশ্যই প্রত্যেকটি নেতাকর্মীর মনে ক্ষত সৃষ্টি করেছে। সেজন্য তারা এটার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে যাচ্ছে।’

তিনি বলেন, ‘প্রাথমিকভাবে তিনি বলেছেন, এ বক্তব্য তার না। তিনি যদি প্রমাণ করতে পারেন, সেটা তার বক্তব্য না। তাহলে দেখতে হবে, এটা কে করেছে? তবে আমি তার কণ্ঠ শুনি, জানি। আমি মোটামুটি নিশ্চিত যে, এটা তার বক্তব্য।’

নিরাপত্তা চেয়ে তাঁতী লীগ নেতা জামাল খানের জিডি

আজমত উল্লাহ খান বলেন, ‘আমাদের বক্তব্য স্পষ্ট, নেতাকর্মীরা কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের কাছে তাদের বক্তব্য তুলে ধরেছেন। দলের হাইকমান্ড তার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবে। কেন্দ্রীয় নেতারা বিভিন্নভাবে আমাদের বক্তব্য শুনতে চেয়েছেন। আমরাও বক্তব্য জানিয়েছি। আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্র আছে, সে মোতাবেক নিশ্চয় দলের হাইকমান্ড সিদ্ধান্ত নেবেন।’

সার্বিক বিষয়ে জানতে মেয়র জাহাঙ্গীর আলমের মুঠোফোনে গত কয়েক দিনে বারবার কল দিয়ে ও এসএমএস পাঠিয়েও সাড়া পাওয়া যায়নি। তবে তিনি ভিডিওটির বক্তব্য তার নয় বলে নানা মাধ্যমে দাবি করে আসছেন।

জাহাঙ্গীর আলমের একাধিক অনুসারীও জাগো নিউজকে বলেছেন, ‘সামনে গাজীপুর মহানগর আওয়ামী লীগের সম্মেলন ও সিটি নির্বাচন। যার কারণে একটি পক্ষ মেয়রকে ঘায়েল করতে এ পথ বেছে নিয়েছে।’

জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও ঢাকা বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতা মির্জা আজম জাগো নিউজকে বলেন, ‘দলের পক্ষ থেকে এরইমধ্যে তাকে কারণ দর্শানোর জন্য বলা হয়েছে। ১৫ দিনের সময়ও দেওয়া হয়েছে। এখন বল তার কোর্টে দেওয়া হয়েছে। এখন সে কি ভুল করছে নাকি বক্তব্য তার নয় বলে অস্বীকার করে, না দুঃখ প্রকাশ করে, সেই অপেক্ষায়। তার বক্তব্যের প্রেক্ষিতে দল আলোচনা করে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেবে।’

এসইউজে/এমএইচআর/এএএইচ/এসএইচএস/জিকেএস