মতামত

ব্যবসার নামে প্রতারণার নানান ফাঁদ

আমরা লক্ষ্য করছি ব্যবসার নামে নতুন নতুন প্রতারণা শুরু হয়েছে। সর্বস্ব হারিয়ে হাজার হাজার মানুষের আর্তনাদ আমাদের ভাবিয়ে তুলেছে। এভাবেই কি সাধারণ মানুষ তার সর্বস্ব হারাবে? এর শেষ কোথায়?

Advertisement

দেখা যায় যে যেভাবে পারছে সাধারণ মানুষকে নিঃস্ব করে ছাড়ছে। কেউ করছে ধর্মের নামে সুদবিহীন হালাল বিনিয়োগের কথা বলে আর অন্য কেউ করছেন অতি লোভ দেখিয়ে অথবা চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে। এক কথায় যে যেভাবে পারছে সাধারণ মানুষের অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে।

আমাদের দেশে গত কয়েক বছর ধরে মাল্টি লেভেল মার্কেটিং ব্যবসা নিয়ে অনেক লেখালেখি হয়েছে এবং এখনও হচ্ছে। এসব এমএলএম ব্যবসা সম্পর্কে ইসলামের শিক্ষা কি, তা নিয়ে কিছু লেখার জন্য বেশ ক’জন আমাকে অনুরোধ করেন। বিষয়টি নিয়ে বিভিন্ন ইসলামি চিন্তাবিদ এবং আলেম উলামাদের কাছে জানতে চাইলে তারা সবাই এই মন্তব্যই প্রকাশ করেছেন, ইসলামের দৃষ্টিতে মাল্টি লেভেল মার্কেটিং ব্যবসা সম্পূর্ণরূপে একটি অবৈধ এবং হারাম ব্যবসা। এই ব্যবসাটির সম্পর্ক সম্পূর্ণভাবে সুদের সাথে। মাল্টি লেভেল মার্কেটিং ব্যবসা স্পষ্টভাবে প্রতারণামূলক একটি ভয়ঙ্কর স্কিম। প্রত্যেক মুসলমানকে এ ধরনের ব্যবসা থেকে বিরত থাকা উচিত, কারণ ইসলাম ধর্মে বায়বীয় বা অবাস্তব কোন ক্রয়-বিক্রয়ের অনুমতি নেই।

মহানবী (সা.) আমাদের জন্য সর্বোত্তম আদর্শ। তিনি (সা.) এ ধরনের ব্যবসা না করার জন্য আমাদেরকে নসিহত করেছেন। এ ধরনের ব্যবসা সম্পর্কে স্পষ্টভাবে হাদিসে উল্লেখ আছে, হজরত হাকিম বিন হিযাম (রা.) বর্ণনা করেন, ‘মহানবী (সা.) আমাকে এমন কোন কিছু বিক্রি করতে নিষেধ করেছেন যা আমার কাছে নেই’ (তিরমিজি)। তিনি (সা.) আরো বলেন, ‘যে ব্যক্তি খাদ্যশস্য বিক্রি করে তার উচিত, যতক্ষণ পর্যন্ত সে তা নিজের দখলে না নেয় ততক্ষণ পর্যন্ত সে যেন তা বিক্রি না করে’ (বোখারি, কিতাবুল বুয়ু’, বাব বায়ইত তা’মে ক্বাবলা আই ইয়াকবিযা)। মাল্টি লেভের মার্কেটিং ব্যবসার যে পদ্ধতি তা হজরত রাসুল করিম (সা.)-এর শিক্ষা পরিপন্থি। যে শিক্ষা মহানবীর (সা.) শিক্ষার বিপরীত তা কখনো ইসলামে বৈধ হতে পারে না।

Advertisement

মাল্টি লেভেল মার্কেটিং ব্যবসার স্কিমটি গত শতাব্দীর বিশের দশকে আমেরিকায় প্রচলিত প্রতারণামূলক স্কিমগুলো থেকে ভিন্নতর কোন স্কিম নয়। সে সময় এসব স্কিমের উদ্দেশ্য ছিল মানুষের কাছ থেকে তাদের টাকা পয়সা হাতিয়ে নেয়া আর আজো ঠিক তাই করা হচ্ছে। আমাদের দেশে এই ব্যবসায় বিনিয়োগকারীদেরকে এমন সব প্রোগ্রাম/প্রজেক্টের দিকে আমন্ত্রণ জানানো হয় যেগুলোতে বিপদ বা ক্ষতিগ্রস্ত হবার সমূহ সম্ভাবনা বিদ্যমান। কেননা প্রস্তুতকৃত দ্রব্যসামগ্রী সম্পর্কে কারও সঠিক জ্ঞান থাকে না। আর যেহেতু এর কোনো উল্লেখযোগ্য চাহিদা বা বাজার নেই তাই এসবের বেশি দামও পাওয়া যায় না। এছাড়া এর কোনো বিশেষ উপকারিতা বা কার্যকারিতাও আছে বলে মনে হয় না।

এই ব্যবসায় বিনিয়োগকারীদের নিজেদের প্রাপ্য কমিশন থেকে লাভবান হতে হয় আর এ প্রক্রিয়ায় তারা নিজেদের পুঁজি খাঁটিয়ে এজেন্টে পরিণত হন। এই বিষয়টি বড়ই ভয়ঙ্কর সাব্যস্ত হয়। এভাবে বিনিয়োগকারীরা নিজেদের অপ্রয়োজনীয় দ্রব্য সামগ্রী বেশি বেশি পরিমাণে অতি দ্রুততার সাথে বিক্রি করে নিজেদের মূলধন তুলে আনতে প্রলুব্ধ হন। এতে বিনিয়োগকারীদের বহুমুখী কমিশন বা লভ্যাংশ প্রদানের প্রলোভন দেয়া হয়। কিন্তু নির্ধারিত সময়ের মাঝে যদি বিক্রি করতে না পারে সেক্ষেত্রে বিনিয়োগকারীদেরকে অর্থাৎ এজেন্টকে বাধ্য করা হয় তারা এসব অপ্রয়োজনীয় বা অনুপকারী পণ্য সামগ্রীকে কোন নিকটাত্মীয়ের কাছে বিক্রি করতে যার কোন প্রয়োজন এই আত্মীয়ের বা স্বজনের মোটেও ছিল না। অর্থাৎ এক্ষেত্রে একটি ভুঁয়া চাহিদা বা বাজার সৃষ্টি করা হয়।

মাল্টি লেভেল মার্কেটিং ব্যবসাটিকে যদি জুয়া খেলার সাথে তুলনা করা হয় তা মনে সামান্য পরিমাণও ভুল হবে না বরং এটি জুয়া খেলা থেকেও জঘন্য একটি বিষয়। মাল্টি লেভেল মার্কেটিং ব্যবসা ইসলামী আর্থিক নিয়ম-নীতির পরিপন্থী একটি অবৈধ ব্যবসা। কেননা এতে সর্বোচ্চ শৃঙ্গে অবস্থিত ব্যক্তি কোন ধরনের ঝুঁকি না নিয়েই সবচেয়ে বেশি লাভবান হয়। বিনিয়োগকারীদের শৃঙ্খলের সবচেয়ে নিম্নপর্যায়ে অবস্থিত ব্যক্তি সবচেয়ে বেশি ঝুঁকি নেয়া স্বত্ত্বেও ক্ষতির মাঝেই থাকে। মাল্টি লেভেল মার্কেটিং ব্যবসা একটি প্রতারণামূলক কাজ এবং একই সাথে অনৈতিকও বটে তার পরেও বিভিন্ন প্রলোভনে ইতোমধ্যে আমাদের দেশের লাখ লাখ মানুষ এ ব্যবসার সাথে জড়িত হয়েছে।

প্রতারণা ইসলামের দৃষ্টিতে এটি খুবই জঘন্য কাজ। এছাড়া প্রতারণাকারীদের বিষয়ে মহানবী (সা.) কঠোর হুশিয়ারী প্রদান করেছেন। যারা ধোঁকা ও প্রতারণায় লিপ্ত হবে মহানবী (সা.) তাদের উম্মতের তালিকা থেকে বহিষ্কার করার ঘোষণা দিয়েছেন। হজরত রাসুল (সা.) বলেন, ‘যে প্রতারণা করে, সে আমার দলভুক্ত নয়।’ (মুসলিম)

Advertisement

কোন প্রকৃত মুসলমান এধরনের অবৈধ ব্যবসার সাথে জড়িত থাকতে পারে না। মহানবী (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘যার মধ্যে চারটি স্বভাব আছে, সে প্রকৃত মুনাফিক। আর যার মধ্যে এ চারটি থেকে কোনো একটি স্বভাব আছে, সেটি ত্যাগ করা পর্যন্ত তার মধ্যে কপটতার একটি স্বভাব বিদ্যমান। ওই চার স্বভাব হলো, যখন তার কাছে আমানত রাখা হয়, তখন সে তা খেয়ানত করে; যখন সে কথা বলে মিথ্যা বলে; যখন সে অঙ্গীকার করে, প্রতারণা করে, আর যখন সে বিবাদে জড়ায়, গালাগাল করে।’ (বোখারি ও মুসলিম) এসব ব্যবসার মূল উদ্দেশ্যই থাকে মানুষের সাথে প্রতারণা করা। তাই মহানবীর (সা.) দৃষ্টিতে এরা মুনাফিক।

অপরদিকে সত্যবাদী ও আমানতদার ব্যবসায়ীরা কিয়ামতের দিন মহা পুরস্কারে ভূষিত হবে। আর যারা প্রতারণার পথ অবলম্বন করে, তাদের জন্য পরকালে রয়েছে ভয়ংকর শাস্তি। মহানবী (সা.) ইরশাদ করেন, ‘কিয়ামতের দিন ব্যবসায়ীরা মহাঅপরাধী হিসেবে উত্থিত হবে, তবে যারা আল্লাহকে ভয় করে এবং সততা ও ন্যায়নিষ্ঠার সঙ্গে ব্যবসা করে তারা ছাড়া।’ (ইবনে মাজাহ) বিভিন্ন ধরনের অফার দিয়ে বা ধর্মের নামে সুদবিহীন বিনিয়োগের কথা বলে সাধারণ মানুষকে আকৃষ্ট করে এবং শেষে প্রতারণা করে তারা অবশ্যই আল্লাহর কাছে ধৃত হবেন।

আমরা সাধারণ দেখতে পাই, এসব ব্যবসায় যেসব পণ্য-সামগ্রী ক্রয় বা বিক্রয় করা হয় সেগুলো নিত্য প্রয়োজনীয় ও দৈনন্দিন ব্যবহার্য জিনিস নয় বরং বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এগুলো অতি অপ্রয়োজনীয় কোন পণ্য হয়ে থাকে। ক্রেতা বা বিক্রেতা কারো প্রকৃত উদ্দেশ্য ক্রয়কৃত দ্রব্য বা পণ্যকে ব্যবহার করে উপকৃত হওয়া নয় বরং কমিশন প্রাপ্তির উদ্দেশ্যে এসব করা হয়ে থাকে। এছাড়া এসবের দ্রব্যের মূল্য এত বেশি স্ফীত করে নির্ধারণ করা হয় যার ফলশ্রুতিতে একটি বড় অঙ্কের টাকা পকেটে চলে আসে আবার যতটুকু ধারাবাহিকতা বজায় রেখে কমিশন দেয়া সম্ভব তা দেয়াও সম্ভবপর হয়। তুলনামূলকভাবে দরিদ্র দেশগুলোতে সাধারণত এসব খেলা আরম্ভ করা হয়। অনেক দেশে এটা আরম্ভ করে ইতোমধ্যে শেষও করে ফেলা হয়েছে।

মাল্টি লেভেল মার্কেটিং ব্যবসা আসলে প্রতারণা বা লোক ঠকানোর একটি কৌশল মাত্র। কেননা এই ব্যবসাটির বিস্তৃতি প্রদান করার জন্য নিরীহ মানুষদের নানান ধরনের ছলে বলে কৌশলে প্রলুব্ধ করা হয় এবং ভুল পদ্ধতি অবলম্বন করা হয়। তাই আমাদের উচিত হবে এ ধরনের কোন ব্যবসার সাথে সম্পর্ক না রাখা।

সেই সাথে যথাযথ কর্তৃপক্ষের প্রতি আমাদের দাবি থাকবে এ ধরনের এমএলএম ব্যবসা পরিচালনাকারী সব প্রতিষ্ঠানের বিষয়ে নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠু তদন্ত করে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া এবং ক্ষতিগ্রস্ত সাধারণ মানুষের পাশে দাঁড়ানো। যেন তারা আবার সুন্দরভাবে বাঁচার স্বপ্ন দেখতে পারে। একই সাথে এসব ব্যবসার প্রতি কঠোর নজরদারি করা, যেন নতুন করে সাধারণ মানুষ আর কারো ফাঁদে পড়তে না হয়।

এইচআর/জেআইএম