মতামত

ক্লিনফিডে ক্লিন হোক সম্প্রচার খাতের বঞ্চনা

দেখা হলেই লোকজন বলেন, আপনাদের তো রমরমা অবস্থা। টিভি খুললেই বিজ্ঞাপন আর বিজ্ঞাপন। আমরা আগে নাটক বা সংবাদের ফাঁকে বিজ্ঞাপন দেখতাম। এখন বিজ্ঞাপনের ফাঁকে নাটক বা সংবাদ দেখি। দর্শকদের অভিযোগ আংশিক সত্য। বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে অনেক বিজ্ঞাপন প্রচারিত হয়। বিশেষ করে ঈদ বা বিশেষ আয়োজনে বিজ্ঞাপন শুরু হলে আর শেষই হতে চায় না। বিজ্ঞাপন শেষ হতে হতে দর্শক নাটকের আগের অংশ ভুলে যান। বিজ্ঞাপন এড়াতে দর্শকরা এত বেশি ছোটাছুটি করেন, শেষ পর্যন্তু কোনোটাই ভালো করে দেখা হয় না।

Advertisement

বিজ্ঞাপনের এ আধিক্যের অভিযোগ মিথ্যা নয়। এটা অস্বীকার করার উপায়ও নেই। সবাই তো চোখের সামনেই দেখতে পাচ্ছেন। দর্শক হিসেবে আমার কাছেও বিজ্ঞাপন মানেই বিরক্তি। আমরা বিজ্ঞাপন ছাড়া অনুষ্ঠান, নাটক, গান, সংবাদ দেখতে চাই। কিন্তু যখন অফিসের চেয়ারে বসি, তখন চাই আরও বেশি বিজ্ঞাপন আসুক। বিজ্ঞাপন না এলে আমাদের বেতন হবে কোত্থেকে? তবে টিভির পর্দাজুড়ে বিজ্ঞাপনের আধিক্য থাকলেও সম্প্রচার শিল্পের অবস্থা কিন্তু কোনোভাবেই রমরমা নয়। বরং বাংলাদেশের স্যাটেলাইট টিভি দারুণ এক সংকটের সময় পার করছে।

বিজ্ঞাপনের রমরমা হলেও স্যাটেলাইট টেলিভিশনের সংকট কেন? এই চক্রটা বুঝতে একটু টেলিভিশন শিল্পের ভেতরে যেতে হব। একসময় বাংলাদেশে স্যাটেলাইট টেলিভিশন ছিল ৫টি। তখন বিজ্ঞাপনের রমরমা না হলেও টেলিভিশন ব্যবসার রমরমা ছিল। কারণ তখন বিজ্ঞাপন দিতে হতো চড়া দামে। এখন যেমন টেলিভিশন বিজ্ঞাপন বিভাগের কর্তারা বিজ্ঞাপনদাতাদের দ্বারে দ্বারে যান, তখন বিজ্ঞাপনদাতারা টেলিভিশন স্টেশনে ভালো সময়ে বিজ্ঞাপন চালানোর জন্য ধরনা দিতেন। ধীরে ধীরে টেলিভিশনের সংখ্যা যত বাড়তে থাকলো, অবস্থাও তত পাল্টাতে থাকলো। বিজ্ঞাপনের রেট কমতে থাকলো দ্রুতগতিতে। কে কার চেয়ে কম রেটে বিজ্ঞাপন চালাবে, তার প্রতিযোগিতা চলে যেন।

বিজ্ঞাপন এখন পানির দর। আগে ১০ মিনিট বিজ্ঞাপন চালিয়ে যা আয় হতো, এখন ৫০ মিনিট চালিয়েও তা হয় না। তাই আপনারা স্ক্রিনে যত বিজ্ঞাপন দেখেন, টেলিভিশনগুলোর আয় কিন্তু তার সমান্তরাল নয়। সমান্তরাল হওয়া সম্ভবও নয়। স্যাটেলাইট টেলিভিশন ৫টি থেকে এখন ৩৪টি হয়েছে। তার মানে সংখ্যা বেড়েছে ৭ গুণ। কিন্তু বিজ্ঞাপনের বাজার তো আর টেলিভিশনের সংখ্যার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়েনি। বিজ্ঞাপনের বাজার হয়তো সাধারণ প্রবণতায় বেড়েছে। কোনো বিজ্ঞাপনদাতা নিশ্চয়ই, বাজারে একটা নতুন টিভি এসেছে, তাদের জন্য একটু বাজেট রাখতে হবে; এমনটা ভাবে না। বরং নতুন নতুন টিভি আসলে প্রতিযোগিতা আরও বাড়বে, রেট আরও কমবে বলে অপেক্ষায় থাকেন বিজ্ঞাপনদাতারা।

Advertisement

তারপরও ধরে নিলাম বিজ্ঞাপনের বাজার দ্বিগুণ হয়েছে। তাতেও তো খুব একটা লাভ হয় না। ধরুন আগে বিজ্ঞাপনের বাজার ছিল এক লাখ টাকা। তাতে ৫টি টিভি চ্যানেল গড়ে ২০ হাজার টাকা করে বিজ্ঞাপন পেতো। এখন সেটা দ্বিগুণ বেড়ে হয়েছে ২ লাখ টাকা। সেই টাকা ৩৪টি টিভি চ্যানেলে ভাগ সবার ভাগে পরে ৫ হাজার ৮৮৩ টাকা। এটা তো গড় হিসাব। টিআরপিতে সামনে থাকা টিভি চ্যানেলগুলো কিছুটা ভালো রেটে বিজ্ঞাপন পেলেও নিচের সারির টেলিভিশনগুলোর দশা সত্যিই করুণ।

নিজেদের মধ্যেই যখন এত কামড়াকামড়ি, তখন বাংলাদেশের বিজ্ঞাপনের বড় একটা বাজার দখল করে নিয়েছিল ভারতের বিভিন্ন টেলিভিশন চ্যানেল। বিজ্ঞাপনদাতাদের দোষ দিয়ে লাভ নেই। তারা যেখানে দর্শক বেশি, সেখানেই পণ্যের বিজ্ঞাপন দেবে। বাংলাদেশে ভারতের বিভিন্ন টিভি চ্যানেলের একটা বড় দর্শক শ্রেণি আছে। এখানে দায়িত্ব হলো সরকারের। সরকার দেশীয় টিভি চ্যানেলগুলোর স্বার্থ সুরক্ষায় নীতি সহায়তা দেবে, এটাই প্রত্যাশিত। উন্মুক্ত আকাশ, মুক্তবাজার অর্থনীতি ইত্যাদি অজুহাতে বরাবরই বঞ্চিত হচ্ছিল দেশীয় টিভি স্টেশনগুলো। বাংলাদেশের স্যাটেলাইট টিভিগুলো জিম্মি হয়েছিল ক্যাবল অপারেটরদের কাছে। কোনো কারণে বনিবনা না হলেই অপারেটররা কোনো একটি স্টেশনকে পেছনে ফেলে রাখতো, যাতে দর্শকরা দেখতে না পায়।

বর্তমান সরকার এ বিশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে এনেছে। এখন বাংলাদেশী চ্যানেলগুলো তাদের প্রতিষ্ঠার তারিখ অনুযায়ী সম্প্রচারিত হয়। পত্রিকাগুলোর তবু বিক্রি করে কিছু টাকা আসে। কিন্তু টেলিভিশনগুলোর আয়ের একমাত্র উৎস বিজ্ঞাপন। ক্যাবল অপারেটররা দর্শকদের কাছ থেকে মাসিকভিত্তিতে টাকা নিলেও তার কোনো ভাগ টিভি চ্যানেলগুলো পায় না। তার ওপর দেশের বিজ্ঞাপনের বড় একটা বাজার পাশের দেশের বিভিন্ন চ্যানেলে চলে যাওয়ায় দেশের চ্যানেলগুলো অস্তিত্বের সংকটে পড়েছিল। এই সমস্যা সমাধানে সরকার ২০১৬ সালে সম্প্রচার আইনে বিদেশি চ্যানেলগুলোর ক্লিনফিড মানে বিজ্ঞাপনমুক্ত সম্প্রচারের বিধান করে। কিন্তু এতদিন সে বিধান কার্যকর ছিল না। ১ অক্টোবর থেকে ক্লিনফিড সম্প্রচারের বিধানটি কার্যকর করে।

টেলিভিশন মালিকদের সংগঠন অ্যাটকোসহ সাংবাদিকদের বিভিন্ন সংগঠনও সরকারের এ সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছে। ১ অক্টোবর থেকে বাংলাদেশে বিদেশি চ্যানেল সম্প্রচার বন্ধ রেখেছে। কারণ তাদের হাতে ক্লিনফিড নেই। তাতে সাধারণের ধারণা হয়েছে, সরকার বুঝি বিদেশি চ্যানেল বন্ধ করে দিয়েছে। কিন্তু আদতে সরকার তেমন কিছু করেনি। সরকার শুধু বিদেশি চ্যানেলের ক্লিনফিড সম্প্রচার বাধ্যতামূলক করেছে। ক্লিনফিডের ধারণা কিন্তু নতুন নয়। ইউরোপ-আমেরিকায় কিন্তু বাংলাদেশের টিভি চ্যানেলগুলোর ক্লিনফিডই সম্প্রচারিত হয়। এমনকি দক্ষিণ এশিয়ার ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, নেপালেও বিদেশি চ্যানেলের ক্লিনফিড সম্প্রচারিত হয়। বাংলাদেশ বরং অনেক দেরিতে এ বিধান কার্যকর করছে। তবে ক্যাবল অপারেটরা বিদেশি চ্যানেল বন্ধ রেখে সরকারের ওপর একধরনের চাপ সৃষ্টি করতে চাইছে। একদম সাধারণ দর্শকরাও বিদেশি টিভি চ্যানেল দেখতে না পেয়ে বঞ্চিত হচ্ছে।

Advertisement

এখন প্রশ্ন হলো, বিদেশি চ্যানেলের ক্লিনফিড নিশ্চিত করার দায়িত্ব কার? চাইলে বিদেশি চ্যানেলগুলো বাংলাদেশের অপারেটরদের ক্লিনফিড সরবরাহ করতে পারে। তারা যদি না দেয়, তাহলে বাংলাদেশের অপারেটরদের দায়িত্ব বিদেশি চ্যানেলের অনুষ্ঠান ডাউনলোড করে বিজ্ঞাপনমুক্ত করে তা সম্প্রচার করা। এজন্য বাড়তি ব্যয় হবে, এ অজুহাতে ক্যাবল অপারেটররা তা করতে রাজি নয়। তারা বরং বিদেশি চ্যানেল বন্ধ রেখে সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে চায়। যদিও তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ স্পষ্ট করে বলে দিয়েছেন, কোনো চাপের কাছেই নতি স্বীকার করবে না সরকার। বাংলাদেশের ক্যাবল অপারেটররা এতদিন প্রায় মুফতে ব্যবসা করছিল। এখন ব্যবসা করতে হলে কিছু বিনিয়োগও করতে হবে। সেটা নিয়ে তারা সরকারের সাথে কথা বলতে পারে, প্রণোদনা চাইতে পারে। কিন্তু বিদেশি চ্যানেল বন্ধ রাখা কোনো সমাধান নয়।

তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রী জানিয়েছেন, বিজ্ঞাপনসহ বিদেশি চ্যানেল সম্প্রচারের ফলে এ খাতে সরকার ২ হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। টেলিভিশন মালিকদের সংগঠন অ্যাটকো দাবি করেছে, বিজ্ঞাপনসহ বিদেশি চ্যানেলের সম্প্রচারের ফলে বাংলাদেশের টিভি স্টেশনগুলো ১২০০ কোটি টাকার বিজ্ঞাপন থেকে বঞ্চিত হয়। বিজ্ঞাপন পাচার বন্ধ হলে দেশি স্টেশনগুলো নতুন নতুন বিনিয়োগ করতে পারবে, তাদের আয় বাড়বে, কনটেন্টের কোয়ালিটি বাড়বে। সরকার বা টিভি স্টেশন নয়, শেষ বিচারে লাভবান হবে দর্শকরাই।

সম্প্রচারকর্মী হিসেবে আমাদের দাবি, ক্লিনফিড সম্প্রচারের সিদ্ধান্তে যেন সরকার অটল থাকে। এখন ক্যাবল অপারেটরদেরই ক্লিনফিড নিশ্চিত করতে হবে। এ ক্লিনফিডেই যেন ক্লিন হয়ে যায় বাংলাদেশের স্যাটেলাইট চ্যানেলের সব বঞ্চনা।

৩ অক্টোবর, ২০২১

লেখক : বার্তাপ্রধান, এটিএন নিউজ।

এইচআর/জিকেএস