শিক্ষা

বন্ধ স্কুল ফিডিং কার্যক্রম, ৩ মাস বেতন বন্ধ সহস্রাধিক কর্মচারীর

সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বিস্কুট বিতরণ কার্যক্রম বন্ধ থাকায় তিন মাস ধরে বেতন বন্ধ স্কুল ফিডিং প্রকল্পের সহস্রাধিক কর্মচারীর। তারা মানবেতর জীবনযাপন করছেন। প্রকল্প কর্মকর্তাদের সঙ্গে বারবার যোগাযোগ করেও বেতন পাচ্ছেন না তারা।

Advertisement

অর্থকষ্টের যন্ত্রণা সইতে না পেরে কেউ কেউ চাকরি ছেড়ে দিনমজুরের কাজ নিয়েছেন। এ কারণে বর্ধিত ছয় মাস এ প্রকল্পের কাজ চালিয়ে নেওয়া অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

প্রকল্প সূত্রে জানা যায়, দারিদ্র্যপীড়িত এলাকায় স্কুল ফিডিং প্রকল্পের মেয়াদ ছয় মাস বাড়ানো হয়েছিল। বর্ধিত সময়ের তিন মাস পার হয়ে গেলেও এখন পর্যন্ত আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় আটকে আছে প্রকল্পের অর্থ। ফলে প্রাথমিকের ৩০ লাখ শিক্ষার্থী উচ্চ পুষ্টিমানসম্পন্ন বিস্কুট না পেয়ে অপুষ্টির শিকার হচ্ছে। অন্যদিকে বিস্কুট বিতরণ কার্যক্রম বন্ধ থাকায় দারিদ্র্যপীড়িত এলাকার শিক্ষার্থীরা ক্লাসে আসতে দেখাচ্ছে অনীহা। এমন পরিস্থিতিতে উপস্থিতি বাড়াতে দ্রুত বিস্কুট বিতরণ কার্যক্রম শুরু করার তাগিদ দিচ্ছেন শিক্ষকরা।

অভিযোগ রয়েছে, প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একজন শীর্ষ কর্মকর্তার কারণে প্রকল্পের কার্যক্রম শুরু হচ্ছে না। তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ায় কার্যক্রম শুরু করতে তিনি সময়ক্ষেপণ করছেন। এমনকী মন্ত্রণালয়ের একজন অতিরিক্ত সচিবকে দিয়ে ফোন করিয়ে প্রকল্পে কর্মরত প্রশাসন ক্যাডারের দুই শীর্ষ কর্মকর্তাকে তিনি সরে যেতে বলেছেন।

Advertisement

প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা জানান, দেশের দারিদ্র্যপীড়িত ও দুর্গম জেলার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের উচ্চমান সম্পন্ন পুষ্টিকর বিস্কুট বিতরণ করতে ২৩ এনজিওর মাধ্যমে বিভিন্ন জেলার ৪৩টি স্থানে এক হাজার ৪৩ জনকে নিয়োগ দেওয়া হয়। বিশ্ব খাদ্য সংস্থার অনুমোদিত ও পরীক্ষিত বিস্কুটগুলো বিভিন্ন জেলার ৪৩টি ভাণ্ডার বা গুদাম ঘরে জমা রাখা হয়। প্রকল্প সমন্বয়কের মাধ্যমে সেখান থেকে কর্মচারীরা এসব বিস্কুট নির্ধারিত বিদ্যালয়ে পৌঁছে দেন। প্রকল্পের প্রধান অফিসে প্রকল্প পরিচালকসহ ১০ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী কাজ করেন। তারা সবাই গত তিনমাস ধরে বেতন পাচ্ছেন না।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জামালপুর জেলায় স্কুল ফিডিং প্রকল্পের একাধিক কর্মচারী বলেন, তিন মাস ধরে বেতন বন্ধ থাকায় চরম কষ্টে দিন কাটছে আমাদের। কবে থেকে বেতন দেওয়া হবে তাও কেউ বলতে পারছেন না। এ কারণে আমাদের কেউ কেউ দিনমজুরের কাজ করে সংসার চালাচ্ছেন। অন্যরা অর্ধাহারে-অনাহারে দিনাতিপাত করছেন।

স্কুল ফিডিং কর্মসূচি সূত্রে জানা যায়, প্রকল্পের অধীনে ২০১০ সাল থেকে দেশের দারিদ্র্যপীড়িত ১০৪টি উপজেলায় প্রতিদিন ৩০ লাখ শিক্ষার্থীকে ৭৫ গ্রামের এক প্যাকেট বিস্কুট দেওয়া হচ্ছে। বিস্কুট থেকে একজন শিক্ষার্থী প্রতিদিন ৩৩৮ কিলো ক্যালরি শক্তি পায়।

প্রকল্পটি প্রথম দফায় ২০১০ সালের ১ জুলাই থেকে ২০১৪ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত বাস্তবায়ন করা হয়। পরবর্তীসময়ে প্রকল্প সংশোধন করে গত বছরের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত বাড়ানো হয়। প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয় এক হাজার ১৪২ কোটি ৭৯ লাখ ৯১ হাজার টাকা। এর মধ্যে জিওবি ৫৯৭ কোটি ৭০ লাখ ৫৭ হাজার টাকা ও প্রকল্প সাহায্য ৫৪৫ কোটি ৯ লাখ ৩৪ হাজার টাকা। বর্তমানে এ প্রকল্পের ৪৬৯ কোটি টাকা অব্যয়িত রয়েছে। ছয় মাসের প্রকল্প কার্যক্রম পরিচালনায় ব্যয় ধরা হয়েছে ৩০১ কোটি টাকা।

Advertisement

সংশ্লিষ্টরা জানান, গত ১৭ আগস্ট শর্তসাপেক্ষে জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ছয় মাস প্রকল্পের মেয়াদ বাড়িয়ে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়কে চিঠি দেয় পরিকল্পনা কমিশন। এর এক সপ্তাহ পর প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানোর সিদ্ধান্তের কথা প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরকে (ডিপিই) জানায় মন্ত্রণালয়। ওই চিঠি পেয়ে ডিপিই প্রকল্পের কার্যক্রম শুরু করার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠানো হয়। কিন্তু মন্ত্রণালয়ের উদাসীনতার কারণে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন বন্ধ হয়ে গেছে।

প্রকল্প পরিচালক (অতিরিক্ত সচিব) রুহুল আমিন খানের কাছে জানতে চাইলে তিনি জাগো নিউজকে বলেন, প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানো হবে কি না তা নিয়ে এক ধরনের সংশয় থাকায় ব্যয়ের অর্থ বরাদ্দ দেওয়া হয়নি। এ কারণে তিন মাস আগে প্রকল্পের মেয়াদ বাড়লেও এখনো বিদ্যালয়ে বিস্কুট বিতরণ কার্যক্রম শুরু করা সম্ভব হয়নি। তার সঙ্গে কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ আমাদের সবার তিন মাস ধরে বেতন বন্ধ রয়েছে।

তিনি বলেন, অর্থ ছাড়ের প্রাথমিক কাজ শেষ হয়েছে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন পেলে আর কোনো জটিলতা থাকবে না। আগামী ১৭ অক্টোবর থেকে বর্ধিত মেয়াদ ধরে পরের ছয় মাস বিস্কুট বিতরণ কার্যক্রম পরিচালনা করা হবে। আগামী ১০ থেকে ১২ দিনের মধ্যে অর্থ ছাড়ের সম্ভাবনা রয়েছে। সেটি হলে সব কিছু স্বাভাবিক হয়ে যাবে।

মন্ত্রণালয় ও প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা বলেন, কোনো প্রকল্পের মেয়াদ বাড়াতে প্রধানমন্ত্রীর সম্মতির জন্য ফাইল পাঠাতে হয় না। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় পরিকল্পনা কমিশনে প্রস্তাব পাঠালে তা পর্যালোচনা করে অনুমোদন দেয়। এর আগে দারিদ্র্যপীড়িত এলাকায় স্কুল ফিডিং প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানোর জন্য প্রধানমন্ত্রীর মতামতের জন্য প্রস্তাব পাঠানো হয়নি। চলতি বছরের ১ জুন একনেক সভায় প্রধানমন্ত্রী ‘প্রাইমারি স্কুল মিল প্রকল্প’ অনুমোদন না দিয়ে ডিপিপি সংশোধনের প্রস্তাব দেন। নতুন প্রকল্প অনুমোদন না হওয়ায় বিস্কুট বিতরণ প্রকল্পের মেয়াদ গত ৩০ জুন শেষ হয়ে যায়।

জানতে চাইলে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব গোলাম মো. হাসিবুল আলম জাগো নিউজকে বলেন, প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানোর অনুমোদন হলেও অর্থ মন্ত্রণালয় অর্থ ছাড় না করলে কার্যক্রম শুরু করা যাচ্ছে না। প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ায় অর্থ ফ্রিজ হয়ে আছে। এটি ছাড় করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

তবে মন্ত্রণালয়ের কী ধরনের আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় প্রকল্পের কাজ শুরু করা যাচ্ছে না- এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।

এমএইচএম/এআরএ/এএ/এমএস