আমার চারপাশে অসুখী মানুষের ভিড়। অসুখী কোন মুখ দেখতে ইচ্ছে করে না। আমি সবাইকে সুখী দেখতে চাই। সুখী করতে চাই। কিন্তু চাইলেই কি মানুষের সব আকাক্সক্ষা পূরণ হয়? নদীর দুই তীর যেমন চাইলেই এক হতে পারে না, তেমনি প্রবল ইচ্ছা থাকা সত্তে¡ও সবাইকে সুখী করার আশা এ জনমে আমার অপূর্ণই থেকে গেল। অপূর্ণতার যন্ত্রণা ভয়াবহ। আমি ভয়াবহ এ যন্ত্রণা সহ্য করে বেঁচে আছি। আজকাল নানা কিসিমের দ্রব্যসামগ্রী অদল-বদল করার বিজ্ঞাপন চোখে পড়ে। জীবনটা যদি অদল-বদল করা যেত, তবে আমি অবশ্যই ফুলের সঙ্গে আমার জীবনটা বদলে নিতাম। ফুলের জীবন ক্ষণস্থায়ী। স্বল্পকালের জীবন হলেও সবাইকে সুখী করার ক্ষমতা তার আছে। একটা কচ্ছপ নাকি তিনশ’ বছর বাঁচে। আমি কচ্ছপের আয়ু নিয়ে কী করব- যদি সে জীবনের চারপাশে অসুখী মানুষের ভিড় লেগে থাকে? কাজেই ফুলই ভালো।
Advertisement
কোন মানুষের পক্ষে সবাইকে সুখী করা আসলেই দুরূহ ব্যাপার। নবী করিম (সাঃ) এর ওফাতের পর শুরু হয় খোলাফায়ে রাশেদীনের যুগ। খোলাফায়ে রাশেদীনের প্রথম খলিফা হজরত আবু বকর (রাঃ) ৬৩৪ খ্রিস্টাব্দে অসুস্থ হয়ে পড়লে হজরত উমর (রাঃ) দ্বিতীয় খলিফা রূপে মনোনয়ন লাভ করেন। হজরত উমর (রাঃ) অত্যন্ত সহজ সরল ও অনাড়ম্বর জীবন যাপন করতেন। অসাধারণ ব্যক্তিত্ব, অসামান্য পাণ্ডিত্য, চারিত্রিক দৃঢ়তা, আত্মত্যাগ, উদ্যম, কর্মস্পৃহা, ন্যায়পরায়ণতা ও সু² বিচার-বুদ্ধি সম্পন্ন হজরত উমর (রাঃ) খুবই প্রজাবৎসল ছিলেন। তিনি প্রজাদের অবস্থা নিজ চোখে অবলোকন করার জন্য রাত্রিবেলা লোকালয়ে ঘুরে বেড়াতেন। হজরত উমরের (রাঃ) খিলাফতের মেয়াদ ছিল দশ বছর দুই মাস। এ সময়কালে তিনি মনেপ্রাণে সবাইকে সুখী করতে চাইতেন। কিন্তু ইতিহাস বলে, তিনি তা পারেননি। বর্তমান সরকারও এ দেশকে সুখী-সমৃদ্ধ সোনার বাংলায় পরিণত করতে চায়। সরকার প্রধান অবশ্যই প্রজাবৎসল। তিনি মনেপ্রাণে চান- প্রজারা সুখে থাকুক। শান্তিতে থাকুক। কিন্তু তার এ চাওয়া দিনদিন অলীক বাসনায় পরিণত হচ্ছে। দেশজুড়ে অসুখী মানুষের সংখ্যা ক্রমাগত বাড়ছে।
আমার সামনে একজন ট্রাফিক পুলিশ। রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে সে তার দায়িত্ব পালন করছে। আমার সহজ সরল বুদ্ধি দিয়ে আমি ট্রাফিক পুলিশের মধ্যে সরকারের প্রতিরূপ আবিষ্কার করলাম। আহ, বেচারা! মাথার উপরে তালু গরম করা কড়া রোদ। এই রোদের মধ্যেও তার গায়ে আনুষ্ঠানিক ভারি পোশাক। সারা শরীরে ঘামের অবিরল ধারা নিয়ে সে চারপাশের পথচারীদের সুখী করার আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছে। কিন্তু পারছে না। বিভিন্ন যানবাহনের আরোহী অধিকাংশ পথচারীই তার ওপর বেজার মনোভাব প্রদর্শন করছে। দূর থেকে কেউ কেউ তুই-তুকারিও করছে। আমি লোকটার জন্য অসম্ভব বেদনা অনুভব করলাম। ঘন্টার পর ঘন্টা রোদে পুড়ে কিংবা বৃষ্টিতে ভিজে যে মানুষটা সেবা প্রদান করে, তার প্রতি কেউ কৃতজ্ঞ হওয়ার প্রয়োজন তো মনে করছেই না, বরং গালিগালাজ করছে- এ কেমন কথা? মানুষের এ ধরনের আচরণে আমি খুবই লজ্জা পেলাম। এ লজ্জার হাত থেকে মুক্তি পাওয়ার একটা উপায় হতে পারে ক্ষমা চাওয়া। আমি নগরবাসীর পক্ষ থেকে তার কাছে ক্ষমা চাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম। ক্ষমা চাওয়ার প্রস্তুতি নিয়ে ট্রাফিক পুলিশের কাছকাছি গিয়ে দেখলাম, তার জামার বুকপকেটের ওপরে লাগানো নামফলকে মালেক লেখা।
ফেরেশতা মালেক হচ্ছেন দোজখের দারোয়ান। অনেক বছর আগে বাংলাদেশ সম্পর্কে বলতে গিয়ে দিল্লীর মুগলরা উচ্চরণ করত, ‘দুজখ পুর আজ্ নান’- রুটি (অর্থাৎ খাদ্য সম্ভারে) পরিপূর্ণ একটি নরক। মুগলদের এ উক্তির প্রেক্ষাপট ছিল ভিন্ন। কিন্তু আজ বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার দিকে তাকালে কী দেখি? কী পাকা বাজার- কী কাঁচা বাজার, ঢাকার কোথাও কোন খাদ্যদ্রব্যের অভাব নেই।
Advertisement
ফুটপাত থেকে শুরু করে আধুনিক সুপার শপ- থরে থরে সাজানো খাদ্য সম্ভারের বিপুল সমারোহ। কিন্তু তারপরও দাম নিয়ে সর্বত্র হাহাকার। শুধু কী জিনিসপত্রের দাম? মানবিকতা, মূল্যবোধ, ন্যায়-নীতি, আদর্শ, পরিবেশ ও পরিস্থিতিসহ সুন্দরভাবে বাঁচার জন্য যা যা প্রয়োজন- এ নগরীর সবকিছুর ক্ষেত্রেই আজ নরকের ছাপ পরিলক্ষিত হচ্ছে। নরকরূপী এ নগরের একজন ট্রাফিক পুলিশ, যাকে এক অর্থে এ নগরের দ্বারবান বলা যায়, তার নামও মালেক। অবশ্যই সার্থক নাম। সার্থক নামের এ মানুষটির দিকে আমি হাসিমুখে তাকালাম। তারপর তার পাশের সড়কদ্বীপে দাঁড়িয়ে বিনয়ের সঙ্গে বললাম,: ভালো আছেন, মালেক ভাই।আমার কথা শুনে মালেক ভাইয়ের চোখ দুটো সরু হয়ে গেল। সে দ্রুত চারপাশে একবার নজর বুলিয়ে বলল,: ভালো আছি। আপনি কে!আমি আমার মুখে হাসিটা ঝুলিয়ে রেখেছিলাম। সেই হাসি আরেকটু স্ফীত করে বললাম,: আমি একজন পথচারী। মালেক ভাই কপাল কুঁচকাল। তেরছা চোখ আমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল,: পথচারী- আমার কাছে কী?: আপনি পথের রাজা। আমি পথের প্রজা। দুজনের মধ্যে রাজা-প্রজার সম্পর্ক। প্রজা রাজার কাছে আসতে পারে না? এ সড়কে রিকশা চলাচল নিষেধ। এক রিকশাওয়ালা নিষেধ অমান্য করার দুঃসাহস দেখাতেই মালেক ভাই সেদিকে ছুটে গেল। তারপর পকেট থেকে একটা স্ক্রু-ড্রাইভার বের করে গরুর পশ্চাদদেশে যেভাবে ইঞ্জেকশন দেয়া হয়, ঠিক সেভাবে সেটি রিকশার চাকায় ঢুকিয়ে দিল। পুঁ-উঁচু করে হাওয়া বের হওয়ার শব্দে রিকশাওয়ালা সচকিত হয়ে পেছনে ফিরে দেখে এই কারবার। সে যে পথে আগমন করেছিল, রিকশা নিয়ে দ্রুত সে পথে নির্গমন করল। অপারেশন সফল হওয়ায় মালেক ভাইয়ের মুখে আনন্দের রোদ ঝিলিক দিয়ে ওঠে। সে তার অস্ত্র পকেটে রেখে হাত ঝাড়তে ঝাড়তে আগের জায়গায় এসে দাঁড়ায়। আমি নরম সুরে তাকে বলি,: মালেক ভাই, আমার কথার কোন উত্তর পাইলাম না! মালেক ভাইয়ের মুখের ভাব দেখে মনে হল, সে আমার কথা ভুলে গিয়েছিল। মেমোরি রি-কল করার পর তার কপাল আগের চেয়ে আরও কয়েকগুণ বেশি কুঁচকে গেল। সে নিচের ঠোঁট কামড়ে আমার আপাদমস্তক নিরীক্ষণ করার পর বলল,: আপনি কি আমার সঙ্গে ইয়ার্কি মারতে আসছেন?আমি জিহ্বায় কামড় দিলাম। দু’হাত জোড় করে আমি বললাম,: মালেক ভাই, আপনি আমাকে ভুল বুঝবেন না। আমি আপনার সঙ্গে কোন প্রকার ইসকামি করতে আসি নাই। আমি আসছি ক্ষমা চাইতে।বিস্ময়ে মালেক ভাইয়ের মুখ হা হয়ে গেল। সে ঢোক গিলে বলল,: ক্ষমা! কিসের ক্ষমা?অকৃতজ্ঞ নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে আমি আপনার কাছে ক্ষমাপ্রার্থী মালেক ভাই। আপনি এবং আপনার সহকর্মীরা জনজীবনে স্বস্তি ও শান্তি বজায় রাখার জন্য নিরলসভাবে শ্রম দিচ্ছেন। ঠুলি পরা নাগরিক সমাজ এ শ্রমের মূল্যায়ন না করে শুধু আপনাদের দোষ-ক্রটি খুঁজে বেড়ায়। তারা আড়ালে- আবডালে আপনাদের সম্পর্কে নানা কটু কথা বলে। দুর্নীতিগ্রস্ত হওয়ার বদনাম দেয়। এটা ঠিক না। আমরা শুধু আপনাদের খারাপ দিকগুলোর দিকে আঙুল উঁচা করে সমালোচনা করব, ভালো দিকগুলোর দিকে ফিরেও তাকাব না- এটা চরম বে-ইনসাফি। এ ধরনের বে-ইনসাফির জন্য আমি লজ্জিত। দুঃখিত। এবং আবারও আন্তরিকভাবে ক্ষমাপ্রার্থী।
আমার কথায় মালেক ভাইয়ের মুখে হাসি ফুটে উঠল। ঢাকার রাস্তায় কোন ট্রাফিক পুলিশ শিশুর সরলতা গায়ে মেখে হাসছে- এই দৃশ্য বিরল। আমি এই প্রাণভরে এই বিরল দৃশ্য উপভোগ করছি- এসময় দূর থেকে বাঁশির শব্দ ভেসে আসতেই মালেক ভাই বকের মতো ঘাড় উঁচু করে সেদিকে তাকাল। তারপর ব্যস্ত হয়ে পড়ল। অনেকক্ষণ পর সে যখন দেখল- আমি একই জায়গায় দাঁড়িয়ে আছি, সে অবাক হয়ে চোখ পিটপিট করে জানতে চাইল,: আপনার মতলবটা কী- বলেন তো?আমি আত্মপক্ষ সমর্থন করে কিছু বলার জন্য ঠোঁট ফাঁক করতেই দেখি- কালো রোদ চশমা পরা এক ট্রাফিক সার্জেন্ট এগিয়ে আসছে। তার মুখে বাঁশি। হাতে লাঠি। সার্জেন্ট বাহাদুরের ভাবভঙ্গি আমার কাছে সুবিধার মনে হল না। আমি সড়কদ্বীপ ছেড়ে ফুটপাতে উঠে এলাম। আসার সময় শুনলাম- মালেক ভাইকে সার্জেন্ট বলছে,: এই লোক কে? তোমার পরিচিত কেউ?- না।: তাইলে এতক্ষণ যে তার সঙ্গে বকবক করলা?- বকবক আমি করি নাই। সেই আইসা শুরু করছে। মনে হয়, মেন্টাল। পাবনা কেইস। হায় কপাল! কী বুঝানোর চেষ্টা করলাম, আর কী বুঝল! মালেক ভাইয়ের কথা শুনে খুবই দুঃখ পেলাম। আমার সঙ্গে সহমর্মিতা প্রকাশ করে আষাঢ়ের আকাশ হঠাৎ কালো রূপ ধারণ করল। তারপর বৃষ্টি হয়ে অঝোর ধারায় মাটিতে নেমে এল। ফুটপাত দিয়ে হাঁটার সময় একটা দোকানের আয়নার দিকে চোখ পড়ল। দাঁড়িয়ে পড়লাম। দেখলাম- সামনে একটা দুঃখী মুখ। তার শরীরে দুঃখের বৃষ্টিধারা।
লেখক : সাংবাদিক।mokamia@hotmail.com
এইচআর/জিকেএস
Advertisement