‘যেখানেই থাকি সদা মনে রাখি জন্মদাত্রী নদী তোর বুক-চরে মরি যেন আমি প্রার্থনা নিরবধি।’নদীর নাম যমুনা-রাশেদ রেহমান রচিত চরাঞ্চলের মানুষের সুখ-দুঃখের জীবনচিত্র। উপরের লাইন দুটির লেখক তার জীবনের সব ইচ্ছার প্রতিফলন ব্যক্ত করেছেন। জন্মদাত্রী নদীর বুক চিরে শেষ অবস্থানের ইচ্ছাও পোষণ করেছেন।
Advertisement
বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ। এ দেশে অসংখ্য ছোট-বড় নদী জালের মতো থাকলেও বড় তিনটি নদী বাঙালি মানস পটে উদ্ভাসিত। পদ্মা-মেঘনা-যমুনা সব বাঙালির ঠিকানা। এসব নদীর সঙ্গে কবি-লেখকের জীবন ঘনিষ্ঠতার ছাপ আছে। ‘পদ্মা নদীর মাঝি’ উপন্যাসে মানিক বন্দোপাধ্যায়, ‘মেঘনার ঢল’ কবিতায় হুমায়ুন কবির আর খরস্রোতা যমুনা নদী এবং নদীপাড়ের মানুষের জীবন চিত্রায়ণে লেখক রাশেদ রেহমান ‘নদীর নাম যমুনা’য় অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে মুন্সিয়ানার ছাপ রেখেছেন।
রাশেদ রেহমান উপন্যাসে খরস্রোতা যমুনা নদীর ভাঙন, চরাঞ্চলের মানুষের সুখ-দুঃখ, জীবনযাত্রার অপ্রতুলতা, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা, অধিকারের কথা সুন্দরভাবে তুলে ধরেছেন। নদীভাঙনে শত শত বিঘার ভূ-মালিকের করুণ জীবনের কথা সুন্দরভাবে তুলে এনেছেন। চরাঞ্চলের মানুষের লড়াকু জীবন, দুর্বিসহ জীবনানুভূতি, বাঁধভাঙা চোখের জলে জীবনের আর্তি নিখুঁতভাবে তুলে ধরতে আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন।
অভাবের তাড়নায় জীবন বোধ পাল্টে যায়। পোড় খাওয়া মানুষ ভুলে যায় ঐতিহ্যের কথা। গল্পে আবুল মাঝি চরাঞ্চলের মানুষের জীবন্ত প্রতীক। সে জীবন বাজী রেখে বাঁচতে চায়। চর ভাঙে, ঘর ভাঙে, আবুল মাঝি মন শক্ত করে নতুন স্বপ্নে ছুটে চলে এক চর ফেলে অন্য চরে। বাড়ি ভাঙে, নদী ভাঙে, ভেসে যায় জলের সঙ্গে জীবন্ত মানুষ। অপলক চোখে চেয়ে থাকে স্বজন হারানোর বেদনায়। বাকিটা থেকে যায় ইতিহাস হয়ে।
Advertisement
বর্ষা নেমে যায়, জেগে ওঠে বালুচর। রোদের তাপে ঝাঁঝালো বালু তেঁতে থাকে অগ্নিধারায়। কৃষক স্বপ্ন দেখে সোনালি ফসলের। হারভাঙা পরিশ্রমে ঘরে তোলে সোনালি ফসল। যমুনা অববাহিকায় জেগে ওঠা মানুষের প্রেম-ভালোবাসা, একে অপরের প্রতি সৌহার্দ্য, নিজের স্বার্থের কথা না ভেবে অন্যের স্বার্থ রক্ষায় অনন্য মেলবন্ধন যেন। হাসি, দুঃখ, কান্না জীবনের পরতে পরতে অনুভূত হয়।
চরাঞ্চলের মানুষের মুখে মুখে শোনা যায় জরিনা, শাহজাহান, ফুলমালা, কালুগাজির ঐতিহ্যবাহী লোক সংগীত। সবার মুখে মুখে ঐতিহ্য ধরে রাখার এক প্রাণান্ত প্রচেষ্টা।
এ অঞ্চলের মানুষের বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন হলো শিক্ষা। শিক্ষাই একমাত্র সম্পদ। সব প্রতিকূল অবস্থা মারিয়ে জীবনকে সাজাতে চায়। শিক্ষার আনন্দে সব দুঃখ ভুলে যায়। যখন দেখে শিক্ষিত সন্তানরা মাথা উঁচু করে সমাজে, রাষ্ট্রে বেঁচে থাকে গর্বের সঙ্গে। নদীগর্ভে বিলীন হওয়া জোত-জমি ভাঙন দর্শনে ফিরে আসে মাটি ও মানুষের টানে। জরাজীর্ণ বাস্তুভিটা স্বজন আঁকড়ে থাকে গভীর মমতায়।
বইটিতে কিছু মুদ্রণজনিত ভুল পরিলক্ষিত হয়েছে। নিয়াজ চৌধুরী তুলির অসাধারণ শৈল্পিক প্রচ্ছদে বইটি পাঠকমনে আকর্ষণ সৃষ্টি করেছে। সর্বোপরি লেখক রাশেদ রেহমান ভাষা প্রয়োগেও মুন্সিয়ানা দেখিয়েছেন। ‘নদীর নাম যমুনা’ বইটি বাঙালি হৃদয়ে বেঁচে থাকবে আজীবন।
Advertisement
এসইউ/জিকেএস