প্রধানমন্ত্রী গত ২৪ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে ভাষণ দিয়েছেন। ১৯৭৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ জাতিসংঘের সদস্য হয়। জাতিসংঘে বাংলাদেশের বয়স এখন ৪৭ আর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ নিয়ে মোট ১৭ বার জাতিসংঘে বাংলাদেশের নেতৃত্ব দিয়েছেন। জাতিসংঘে প্রধানমন্ত্রীর এবারে ভাষণ আরও একটি কারণে তাৎপর্যপূর্ণ। সদস্য হওয়ার প্রথম বছরে জাতিসংঘে ভাষণ দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। বাংলাদেশের বয়স এখন ৫০। ৫০তম এ বছরে জাতিসংঘে বাংলাদেশকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা। একই সঙ্গে বাংলাদেশ পালন করছে মুজিব জন্মের শত বর্ষ-মুজিব বর্ষ। ঘটনাগুলো আপতদৃষ্টিতে কাকতালীয় মনে হলেও তাৎপর্যহীন নয়। কারণ এগুলো ইতিহাসের অংশ হয়েই থাকবে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে।
Advertisement
জাতিসংঘে প্রধানমন্ত্রীর প্রায় ৩০ মিনিটের বক্তব্যটি মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনলাম। এ মুহূর্তে বাংলাদেশের মানুষ যা নিয়ে ভাবছে, যা নিয়ে তার উদ্বিগ্নতা তা সবই আছে এ ভাষণে। আছে রাষ্ট্রীয় চাওয়া পাওয়ার খতিয়ান, আঞ্চলিক সম্পর্কের টানাপোড়েন ও বিশ্ব শান্তির আশা-নিরাশার বাণী। বিশ্বমারির প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ এক ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। এখানে কোভিড সেভাবে হানা দেয়নি সত্য, তবে তার বিরুদ্ধে লড়তে গিয়ে বাংলাদেশকেও সাধ্যমতো সব শক্তি নিয়োগ করতে হয়েছে। ফলে, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কর্মসংস্থান তথা অর্থনীতির ওপর এসেছে বড় আঘাত। সঙ্গত কারণেই প্রধানমন্ত্রী চলমান বিশ্বমারির প্রেক্ষাপটে বিশ্ব দরবারে বাংলাদেশকে উপস্থাপন করেছেন।
করোনার বড় আঘাত ছিল স্বাস্থ্য ও অর্থনীতির ওপর। তার বক্তব্যেও ছিল তারই রেশ। করোনার মধ্যেও অনেক চড়াই-উৎরাইয়ের পেরিয়ে বাংলাদেশ এগিয়েছে। বাংলাদেশ আজ দ্রুত বর্ধনশীল ৫টি অর্থনীতির মধ্যে অন্যতম। কিন্তু এগিয়ে যাওয়ার পথে চ্যালেঞ্জও কম নয়। আমাদের ভুলে গেলে চলবে না যে মানচিত্রের হিসেবে বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার একটি ছোট ব-দ্বীপ মাত্র। একই সঙ্গে একটি দ্রুত বর্ধনশীল জনসংখ্যার দেশও বটে। জনসংখ্যাকে জনসম্পদে রূপান্তরের কাজ চালিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। কিন্তু এটি একটি চলমান প্রক্রিয়া। এদিকে জনসংখ্যাতো বাড়ছে জ্যামিতিক হারে।
বিদ্যমান ১৭ কোটি মানুষের ওপর চেপে বসেছে আরও প্রায় ১১ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী-যার দায় প্রতিবেশি মিয়ানমারের কিন্তু দায়িত্ব নিতে হচ্ছে বাাংলাদেশকে। ২০১৭ সালে মিয়ানমার জাতিগত নিধনযজ্ঞ (Genocide) শুরু করলে এ পর্যন্ত ৭ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। আগে থেকে আশ্রয় নেয়া সহ মোট ১১ লাখ রোহিঙ্গার বোঝা এখন বাংলাদেশের ওপর।
Advertisement
মিয়ানমার নিধনযজ্ঞ শুরু করে রোহিঙ্গারা জান বাঁচাতে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। মানবিক ও বাস্তব কারণেই প্রধানমন্ত্রীকে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিতে হয়েছিল। কিন্তু বাংলাদেশ কখনোই রোহিঙ্গাদের এখানে স্থায়ীভাবে আশ্রয় দেওয়ার কথা বলেনি। ২০১৭ সাল থেকেই বাংলাদেশ বিশ্বের বিভিন্ন ফোরামে রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে প্রত্যাবাসনের জন্যে জোর দাবি জানিয়ে আসছে। রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে ২০১৭ সালে প্রধানমন্ত্রী জাতিসংঘে পাঁচ দফা দাবিও উত্থাপন করেন-অনতিবিলম্বে এবং চিরতরে মিয়ানমারে সহিংসতা ও 'জাতিগত নিধন' নিঃশর্তে বন্ধ করা; অনতিবিলম্বে মিয়ানমারে জাতিসংঘের মহাসচিবের নিজস্ব একটি অনুসন্ধানী দল প্রেরণ করা; জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সব সাধারণ নাগরিকের নিরাপত্তা বিধান করা এবং এ লক্ষ্যে মিয়ানমারের অভ্যন্তরে জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে সুরক্ষাবলয় গড়ে তোলা; রাখাইন রাজ্য থেকে জোরপূর্বক বিতাড়িত সব রোহিঙ্গাকে মিয়ানমারে তাদের নিজ ঘরবাড়িতে প্রত্যাবর্তন ও পুনর্বাসন নিশ্চিত করা এবং কফি আনান কমিশনের সুপারিশমালার নিঃশর্ত, পূর্ণ এবং দ্রুত বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা।
উল্লেখ্য, প্রধানমন্ত্রীর ওই পাঁচ দফাই রোহিঙ্গা সংকট নিরসনে জাতিসংঘ ও বৈশ্বিক উদ্যোগের মূলনীতি হিসেবে গৃহীত হয়েছে। কিন্তু দুঃখের বিষয় হচ্ছে প্রধানমন্ত্রীর পাঁচ দফা দাবি আজও পূরণ হয়নি। গত (৭৫তম) সম্মেলনেও তিনি বিশ্ববাসী যে রোহিঙ্গা সংকট মোকাবিলায় এগিয়ে আসেনি সেটি বলেছেন। এবারও তিনি বিশ্ব নেতাদের প্রতি একরকম হতাশাই ব্যক্ত করেছেন। তিনি বলেন, ৫ বছরে ১ জন রোহিঙ্গাকেও মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো যায়নি।
তাই, রোহিঙ্গা প্রশ্নে বাংলাদেশ তার অবস্থান সুস্পষ্টভাবে তুলে ধরেছে এবং এ ব্যাপারে কোনো রাখঢাক রাখেনি। রোহিঙ্গারা যে বাংলাদেশের পরিবেশ, স্বাস্থ্য, নিরাপত্তা ও অর্থনীতির ওপর ঝুঁকি তা তিনি পরিষ্কার বলেছেন। সেই সঙ্গে এটা এ অঞ্চলের টেকসই নিরাপত্তার (Sustainable Security) জন্যও হুমকি। এ সমস্যার জন্য যে মিয়ানমার দায়ী তা দ্ব্যর্থহীনভাবে বলেছেন। এর মাধ্যমে তিনি স্পষ্ট করেই রোহিঙ্গা সংকটের পেক্ষাপট বর্ণনা করেছেন। সেই সঙ্গে যারা রোহিঙ্গাদের মানবাধিকার লঙ্ঘন করেছে তাদের বিচারের দাবিও জানিয়েছেন তিনি। পাশাপাশি সংকট নিরশনে আঞ্চলিক সংগঠন আশিয়ান বা অন্যান্যদেরও এগিয়ে আসার আহ্ববান জানিয়েছেন।
৭২-৭৫তম অধিবেশনগুলোতে রোহিঙ্গা সমস্যা জাতিসংঘ অধিবেশনে গুরুত্ব পায়। প্রতিবারই প্রধানমন্ত্রী বিষয়টির গুরুত্ব তুলে ধরেন। তার বক্তব্যের ওপর ভিত্তি করে ২০১৮ সালে নিরাপত্তা কাউন্সিল কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্প ও পরে মিয়ানমার সফর করে। জাতিসংঘ মহাসচিব বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট ও জাতিসংঘ শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশনারের সঙ্গে কক্সবাজারও সফর করেন। এমনকি বিষয়টি আন্তর্জাতিক আদালত ও আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত পর্যন্ত গড়ায়। সব ফোরামেই সমস্যার জন্য মিয়ানমারকেই দায়ী করা হয়। এবারের অধিবেশনেও তিনি বিশ্ব নেতৃত্বকে সংকট সমাধানে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান।
Advertisement
বিশ্ব এক মহাসংকটময় সময় পার করছে। বিশ্বের সব দেশেই করোনা আঘাত হেনেছে। করোনায় বিশ্বের অপরাপর দেশের মতো আমাদের অর্থনীতির চাকাও কিছুটা স্থবির হয়েছে। করোনা মোকাবেলায় দীর্ঘদিন পরে হলেও টিকা আবিষ্কার হয়েছে। কিন্তু টিকায় ন্যায্য হিস্যা এখনও প্রতিষ্ঠা হয়নি। বিশ্বমারি মোকাবেলায় তিনি নতুন, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও বৈশ্বিক (New, Inclusive and Global) পরিকল্পনার ওপর জোর দিয়েছেন। যথার্থই তিনি স্থ্যক্ষেত্রে একটি টেকসই পুনরুদ্ধার কার্যক্রমের ওপর জোর দিয়েছেন।
তবে করোনা যে শুধু স্বাস্থ্য ও অর্থনীতিরই ক্ষতি করেছে তা নয়। শিক্ষা ও কর্মসংস্থানের ওপরও হেনেছে প্রচণ্ড আঘাত। বাংলাদেশের উঠতি অর্থনীতির জন্য এর প্রভাব আরও বেশি। সম্পদ ও সুযোগের সীমাবদ্ধতা থাকায় আমাদের শিক্ষার্থীরা অনেক বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ফলে প্রধানমন্ত্রী শিক্ষার্থীদের ডিজিটাল সক্ষমতা অর্জনে বিশ্ব সংস্থার সহযোগিতা চেয়েছেন। করোনাযুদ্ধে ঘুড়ে দাঁড়াতে তিনি প্রণোদনা ভিত্তিক উত্তরণ কাঠামোর ওপর জোর দেন। করোনা যদি না যায়, তবে শিক্ষা ক্ষেত্রে এর বিরুদ্ধে লড়তে হলে প্রণোদনা লাগবেই।
করোনায় অভ্যন্তরীণ কর্মসংস্থান হ্রাস পেয়েছে। পাশাপাশি আন্তর্জাতিক শ্রম বাজারেও ধ্বস নেমেছে। অনেক দেশই প্রবাসী শ্রমিকদের নিজ দেশে ফেরত পাঠিয়ে দিচ্ছে অথবা তাদের প্রবাস জীবনকে কঠিন করে তুলছে। বিশ্ব সংস্থায় তিনি বিশ্ব নেতৃত্বের কাছে প্রবাসী শ্রমিকদের জন্য একটি মানবিক শ্রমবাজার বজায় রাখার দাবি জানান। এটি শুধু বাংলাদেশের জন্যই জরুরি নয়, বিশ্বের অপরাপর শ্রম সরবরাহকারী দেশের জন্যও জরুরি।
বাংলাদেশের জন্য স্থায়ী আরেকটি বৈশ্বিক সংকট হচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তন।এতে ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকায় বাংলাদেশ শীর্ষে। প্রধানমন্ত্রী বরাবরই জলবায়ু নিয়ে কথা বলেছেন। এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। জলবায়ু সংকট মোকাবিলায় তিনি একটি ‘সার্বিক বৈশ্বিক’ উদ্যোগের ওপর গুরুত্বারোপ করেন। জলবায়ু নিয়ে জাতিসংঘে কথা বলার আগে তিনি গত ২০ সেপ্টেম্বর নিউইয়র্কেই জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক এক বৈঠকে ছয়টি সুপারিশ পেশ করেছেন। সেখানে তিনি বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে রাখতে প্যারিস চুক্তির বাস্তবায়ন চেয়েছেন। উন্নত দেশগুলোর কাছ থেকে বার্ষিক ১০০ বিলিয়ন ডলার জলবায়ু তহবিল আদায়ের ওপরও জোর দেন প্রধানমন্ত্রী। আর গতকালের (২৪ সেপ্টেম্বর) জাতিসংঘ অধিবেশনে তিনি মোটাদাগে কার্বন নিঃসরণ ক্ষতিপূরণবাবদ ও অভিযোজনের জন্য উন্নত দেশগুলোর কাছে অর্থ বরাদ্দের ন্যায়সঙ্গত দাবি জানিয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী তার সাধারণ পরিষদের ভাষণে আরও দুটি আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক প্রসঙ্গের অবতারণা করেছেন। সাম্প্রতিক আফগানিস্তান পরিস্থিতির ওপর তিনি কথা বলেছেন। আফগানিস্তান নিয়ে তিনি বাংলাদেশের অবস্থান সুস্পষ্টভাবেই ব্যক্ত করেছেন। এর মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশে সম্প্রতি যারা আফগানিস্তান পরিস্থিতি নিয়ে অতি উদ্বিগ্ন তাদের জন্যও একটি বার্তা দিয়েছেন। তিনি বিশ্ববাসীকে দ্ব্যর্থহীনভাবেই বলেছেন যে আফগানিস্তানের জনগণই আফগানিস্তানের ভবিষ্যৎ ঠিক করুক। বিশ্বসভায় বিশ্ব মোড়লদের উপস্থিতিতে বর্তমান বিশ্বরাজনীতির আলোচিত বিষয়বস্তু ‘আফগানিস্তান’ নিয়ে নিজের অবস্থান পরিষ্কার করা একজন সাহসী নেতৃত্বের পক্ষেই সম্ভব। একইভাবে ফিলিস্তিন প্রশ্নেও তিনি বাংলাদেশের আগের অবস্থানই তুলে ধরেছেন।
প্রধানমন্ত্রী বিদেশের মাটি থেকে খালি হাতে ফেরেন না। কূটনৈতিক ও কৌশলগত অর্জনের পাশাপাশি তিনি দেশের জন্য নিয়ে আসেন বিশেষ বিশেষ পুরস্কারও। এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। উন্নয়নে বিশেষ অবদান রাখার জন্য ‘এসডিজি প্রগ্রেস অ্যাওয়ার্ড’ পেয়েছেন তিনি। এছাড়া তাকে ‘ক্রাউন জুয়েল’ বা ‘মুকুট মণি’ আখ্যায়িত করেছে আর্থ ইনস্টিটিউট, কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়, গ্লোবাল মাস্টার্স অব ডেভেলপমেন্টস প্র্যাকটিস এবং ইউএন সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট সলিউশনস নেটওয়ার্ক। এসবই বাংলাদেশের অর্জন।
বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির মূল কথা শান্তি। জাতিসংঘ শান্তিরক্ষায় বাংলাদেশ শীর্ষস্থানীয়। বিশ্বের অপরাপর দেশের সঙ্গে সম্পর্কেও আমরা শান্তি প্রয়াসী। সন্ত্রাস মোকাবেলায় বাংলাদেশ অগ্রগামী। এছাড়া পারমাণবিক চুক্তিতে অনুসাক্ষর করে বাংলাদেশ শান্তির সপক্ষে তার অবস্থান পরিষ্কার করেছে। প্রধানমন্ত্রী ‘শান্তির পক্ষে বাংলাদেশ’- একথাই বলে এসেছেন।
সবশেষে বাংলাদেশেকে নিয়ে তিনি তার লালিত স্বপ্নের কথা অকপটে জানান দিয়েছেন বিশ্ববাসীকে, জেনেছি আমরাও। ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে তিনি দেখতে চান একটি জ্ঞানভিত্তিক উন্নত দেশ হিসেবে, আর এ শতাব্দীর শেষ নাগাদ (২১০০) একটি সমৃদ্ধ ও টেকসই বদ্বীপ হিসেবে। আমরা তখন বেঁচে থাকি বা না থাকি-স্বপ্ন বেঁচে থাকে প্রজন্মান্তরে।
লেখক : কলাম লেখক।
এইচআর/এমএম