ঐতিহ্যবাহী জাঁতা। এখন আর কোথাও চোখে পড়ে না। ফরিদপুরে বিলুপ্তির শেষ প্রান্তে জাঁতাশিল্প। জেলা সদরসহ ৯টি উপজেলার কোথাও এর দেখা মেলে না।
Advertisement
একসময়ের গ্রাম বাংলার ঐতিহ্য জাঁতাশিল্প এখন বিলুপ্তির শেষ প্রান্তে। ফরিদপুরের গ্রামগঞ্জের কয়েকশ গ্রাম ঘুরেও এর দেখা মেলে না। অথচ এক সময় প্রায় বাড়িতেই এই জাঁতা পাওয়া যেতো।
প্রযুক্তির দ্রুত সম্প্রসারণ, জীবনযাত্রার মান উন্নত ও ব্যস্ততার কারণে হারাতে বসেছে গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যবাহী জাঁতাশিল্প। একসময় উপজেলাগুলোর অধিকাংশ গ্রামের মানুষ জাঁতা দিয়ে ছোলা, মসুরি, খেসারি ও মুগসহ বিভিন্ন শস্যদানা ভেঙে ডাল তৈরি করতো।
বর্তমানে এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রামান্তরে ঘুরলেও আর জাঁতা দিয়ে ডাল ভাঙার দৃশ্য চোখে পড়ে না। গ্রামের মানুষেরা এখন বিদ্যুৎচালিত মেশিনে ডাল ভাঙানোর কাজ করেন। এতে করে প্রায় বিলুপ্তির শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়েছে গ্রামগঞ্জের ডাল ভাঙার বহুল ব্যবহৃত জাঁতাশিল্প।
Advertisement
জানা যায়, জাঁতা তৈরির মূল উপাদান চিকটা মাটি, অইলোন, ধানের গুঁড়া, পাথর মসৃণ দুই খণ্ড। পাথর কেটে গোল করে জাতা তৈরি করা হতো। একটি জাতা প্রায় ১৪-১৫ বছর ব্যবহার করা যায়।
পাথরের তৈরি জাঁতা দিয়ে যখন কাজ হয় তখন এক ধরনের শব্দ হয়। এখন আর সে শব্দ শোনা যায় না। জাঁতার পরিবর্তে উন্নত মেশিন তৈরি হওয়ার এখন আর কষ্ট করে কেউ জাঁতা চালান না।
ফরিদপুর সদরের কৃষ্ণপুর ইউনিয়নের সদরদি গ্রামের করিম শেখের বাড়িতে দেখা মেলে একটি জাঁতার। করিম শেখের স্ত্রী চম্পা বেগমকে (৫৬) দেখা যায় জাঁতা দিয়ে খেঁসারি-কলাইয়ের ডাল ভাঙছেন।
তার এই জাঁতার বয়স প্রায় ২০ বছর। যত্ন করে ব্যবহার করেন। বিভিন্ন প্রকারের ডাল ভাঙতে ব্যবহার করেন জাঁতা। চম্পা বেগম জানান, ‘আদিকাল থেকেই পারিবারিকভাবে আমরা এই জাঁতার ব্যবহার করে আসছি। বিয়ের পর থেকেই শাশুড়িকেও দেখেছি জাঁতা দিয়ে ডাল ভাঙতে।’
Advertisement
তিনি জানান, ‘অসময়ে এই জাঁতা বন্ধু হয়ে পাশে দাঁড়ায়। বাড়িতে যদি আটা বা ছাতু না থাকে তাহলে খুব সহজেই জাঁতা থেকে আটা তৈরি করে রুটি তৈরি করা যায়।’
‘এক কেজি চালের আটা তৈরি করতে প্রায় ১৫-২০ মিনিট সময় লাগে। শুধু আটা, ছাতু, ডাল নয় মরিচ, ধনিয়া, গোলমরিচ, গরম মসলাও পিষে খাওয়া যায় এই জাঁতার মাধ্যমে’, বলে জানান তিনি।
জাঁতাশিল্প সম্পর্কে বোয়ালমারী উপজেলার টোংরাইল গ্রামের সুনিল বিশ্বাসের স্ত্রী করুনা বিশ্বাস বলেন, ‘মেশিনের চেয়ে বাড়িতে জাঁতা দিয়ে ডাল ভাঙলে ডালগুলোতে পুষ্টিকর খাদ্য উপাদান বেশি থাকে। এ কারণে এই ডালের স্বাদও ভালো লাগে খেতে।’
তিনি আরও বলেন, ‘বর্তমানে কেউই আর পরিশ্রম করতে চায় না। এ কারণে এখন আর জাঁতা দিয়ে ডাল ভাঙে না কেউই। আধুনিক আর উন্নয়নের যুগে আদিকালের জাঁতাশিল্প একেবারে হারিয়ে যাওয়ার শেষের দিকে।’
বোয়ালমারী পৌরসভার সোতাশি গ্রামের সাদিয়া জামান বলেন, ‘আধুনিক এই যুগে আমাদের ছেলে-মেয়েরা জাঁতা কী, তা ই জানে না। আমরা ছোটকাল থেকে মা-দাদি-চাচিদের দেখে আসছি জাঁতা দিয়ে বিভিন্ন ধরনের ডাল ভাঙতেন। তবে এখন আর সেই প্রচলন নেই।’
মধুখালী উপজেলা সদরের বাসিন্দা মির্জা প্রিন্স জানান, ‘আধুনিক যন্ত্রপাতি ও প্রযুক্তির অবাধ প্রবাহের কারণে মানুষের জীবনযাত্রা দিন দিন বদলে যাচ্ছে। সেইসঙ্গে হারিয়ে যাচ্ছে গ্রাম বাংলার ঐতিহ্য। এই হারিয়ে যাওয়া ঐতিহ্যের একটি হচ্ছে জাঁতা। ’
আগে গ্রাম বাংলার প্রায় প্রতিটি বাড়িতে দেখা যেত এই জাঁতা। একসময় জাঁতা নারীদের কাছে খুব প্রয়োজনীয় একটি গৃহস্থালি উপকরণ ছিলো। তবে সময়ের কাছে ও আধুনিক যন্ত্র আসায় হারিয়ে যেতে বসেছে জাঁতা।
আলফাডাঙ্গার বাকাইল গ্রামের গৃহবধূ শিখা মন্ডল (৪৬) বলেন,‘ বিয়ের আগে ছোটকাল থেকে আমাদের পরিবারে জাঁতার ব্যবহার ছিল। মা-দিদি, বৌদি, কাকিদের দেখেছি বিভিন্ন কাজে জাঁতা ব্যবহার করতেন।’
আমার বিয়ে হয়েছে প্রায় ২৫-৩০ বছর। সেই থেকে জাঁতার ব্যবহার শুরু করেছি। তার আগে আমার শাশুড়ি ব্যবহার করতেন। জাঁতাতে চালের আটা, ছাতু ইত্যাদি তৈরি করা যায়।’
‘এই জাঁতা দিয়ে আমাদের গ্রামের হিন্দু ও মুসলিম পরিবারের নারীরা চাল, গম, আটা-ময়দা তৈরি করে ব্যবহার করতো। এছাড়াও জাঁতা দিয়ে ভাঙানো হতো খেসারি, মটর, মসুর, মাসকলাই প্রভৃতি ডাল’, বলে জানান শিখা।
মধুখালী পৌরসভার মেয়র মোরশেদ রহমান লিমন জানান, ‘গ্রামঞ্চলের কিছু পরিবার জাঁতাকে ঐতিহ্য হিসেবে ধরে রেখেছে। পরিবেশবান্ধব এই গৃহস্থ উপকরণ কেবল আমাদের ঐতিহ্য নয়, বরং নিজেদের প্রয়োজনেই এর ব্যবহার বাড়াতে হবে।’
জেএমএস/এএসএম