মতামত

মঞ্চনাটক ‘মুজিবের মেয়ে’ এবং ‘মুজিবের মেয়ে’

 

কবি নান্টু রায়’কে পেলাম ‘মুজিবুরের মেয়ে’ কবিতায়। কী আছে কবিতাতে?

Advertisement

কলকাতায় এলে বন্ধুরা জিগ্যেস করেনকেমন আছে বাংলাদেশ?তাঁরা বাংলাদেশের কুশল জানতে চান।

দেশভাগের শিকার হয়ে বাস্তুচ্যুত বাঙালির হাহাকার মাখা প্রশ্ন- মজিবরের মেয়ে কেমন চালাচ্ছে দেশ?

কেনো এই প্রশ্ন? মজিবরের মেয়ে বাংলাদেশকে কেমন চালাচ্ছেন, তা জেনে কী হবে? এই প্রশ্নে তাদের মনে জেগে ওঠে পূর্ববঙ্গের স্মৃতি। পূর্ববঙ্গ মানে গোলাভরা ধান, পুকুরভরা মাছ। এদের কাছে মজিবরের মেয়ে যেন তাদের নিজেরই মেয়ে।

Advertisement

কেনো? কোনো এদের কাছে মজিবরের মেয়ে যেন তাদের নিজেরই মেয়ে?

কেননা, তারা জানেন, মজিবর কে! মজিবর মানে শেখ মুজিবুর রহমানের নামটা নিজের মতো করে ডাকা। যেমন চাচা-মামাদের মুখে শুনেছি শেখ সাহেব ডাক। মজিবর, মুজিবুর, মুজিব- বাঙালির আশা ভরসার প্রতীকবাচক শব্দ। কবিতাটি পড়তে পড়তে আমার চোখে ভেসে উঠেছিল মঞ্চ, হাতের লাঠিতে ভর দিয়ে অস্থির আবেগ নিয়ে এক প্রবীণ এগিয়ে এসে বলছেন, ‘মজিবরের মেয়ে কেমন চালাচ্ছে দেশ?’

মাথার ভেতরে মঞ্চসমেত সেই প্রবীণ আর এই প্রশ্নকে নিয়ে ঘুরছি। কেনো কেবল বাংলাদেশের মানুষ নয়, যে কোনো বাঙালির কাছে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বাংলাদেশের ভালো থাকা খুব জরুরি, আমাকে ভাবিয়ে তোলে। টের পাই, মঞ্চে হাজির হয়ে যাচ্ছে আরও অনেক চরিত্র। টের পাই, মুজিব না থেকেও আছেন, আছেন তাঁর সন্তানসম দেশের অস্তিত্বে এবং এই দেশের টিকে থাকা যে কোনো বাঙালি বলে নয়, শোষণ-অত্যাচারের বিরুদ্ধে লড়াইরত প্রত্যেকের জন্য সাহস জোগাতে মুজিব এখনো অপরিহার্য। ক্রমশঃ আমার বোধগম্যতায় মুজিবের মেয়ে ঠাঁই নিতে থাকেন, যিনি কেবলমাত্র মুজিবের রক্তের উত্তরাধিকারী নন, বাংলাদেশ নিজেও মুজিবের মেয়ে, মুজিবের আদর্শ চেতনায় ধারণ করেছেন যিনি, তিনিও এর বাইরে নন। এরা সবাই হাজির হয়ে যান মঞ্চে, যা এক সময় লিখিত হয়ে ওঠে।

মঞ্চের ত্রিমাত্রিক স্থানে কাল বা সময় নামক চতুর্থ মাত্রাকে টেনে আনার সুবিধা মঞ্চনাটক লিখতে উৎসাহিত করে আমাকে। বাংলার নিজস্ব নাট্যরীতিতে বহু আগে থেকেই নাটকের মঞ্চ এবং অভিনয় দেখতে উন্মুখ দর্শকদের মঞ্চের অত্যাবশ্যকীয় উপাদান বানিয়ে ফেলার সৌন্দর্য বর্তমান। ‘মুজিবের মেয়ে’ নাটকটি লিখতে গিয়ে মঞ্চ এবং দর্শকের উপস্থিতি জরুরি হয়ে পড়েছিল বলেই এটি মঞ্চনাটক হ’ল।

Advertisement

ঋত্বিক নাট্যপ্রাণ, গুণী অভিনেতা ও নির্দেশক এবং বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক লিয়াকত আলী লাকী শুভেচ্ছা বার্তায় লিখেছেন, বঙ্গবন্ধুকন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাত ধরে বাংলাদেশ যে সোনালী ভবিষ্যতের দিকে যাত্রা শুরু করেছে, সেই যাত্রায় বাংলাদেশের নাটকেরও অংশগ্রহণ জরুরি।

মঞ্চনাটকের মাধ্যমে মানুষের মনোজগতে এ বার্তা দেয়া দরকার যে, বাঙালি সকল প্রকার শোষণকে চ্যালেঞ্জ জানাতে পেরেছিল জাতির পিতা আমাদের সাহস জুগিয়েছেন বলে। ১৯৭৫ এর ১৫ আগস্টের নির্মম হত্যাকাণ্ড পরবর্তী সময়ে দেশে যে বাংলাদেশবিমুখ যাত্রা শুরু হয়েছিল, তা থেকে আমাদের উদ্ধার মিলেছে ‘মুজিবের মেয়ে’ আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জীবনবাজি রেখে দেশ গড়ার সংগ্রাম করেছিলেন বলেই। ষড়যন্ত্র এখনো চলছে। বাংলাদেশের পথচলা আর যেন ব্যাহত না হয়, তার জন্য আমাদের ‘মুজিবের মেয়ে’র পাশে থাকা অত্যাবশ্যক।

মুজিবের মেয়ে’ নাটকের মাধ্যমে মঞ্চে উচ্চারিত হবে- জয় বাঙালির জয়। বাঙালি জাতি, হাজার বছর ধরে যার গোলাভরা ধান নদী ভরা মাছ ফলে ভরা গাছ মাঠে মাঠে সোনা লুটে নিতে পাহাড়-পর্বত-সাগর-নদী পাড়ি দিয়ে এসেছিল ভিনদেশি বেনিয়ার দল। হাজার বছরের লড়াই শেষে সত্যিই জয় হয় বাঙালির। বাংলা মায়ের ভাগ্য খোলে। অবশেষে বাংলা মা হয়ে উঠলেন ভাগ্যবতী। তার বুকে জন্ম নেয় তার সন্তান। নাম যার শেখ মুজিবুর রহমান। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। যার তর্জনী আকাশ ছুঁয়েছিল। বাঙালিকে করেছিল এক, এক সাথে এক।

তারপর? কী হয় তারপর? আমরা জানি কি হয়। বীর মুক্তিযোদ্ধা, মহান মুক্তিযুদ্ধের একমাত্র নারী কমান্ডার আশালতা বৈদ্য জানিয়েছেন, ১৯৭১ সালে জীবন বাজি রেখে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলাম বঙ্গবন্ধুর আহবানে। আমাদেরকে দাবায়ে রাখতে পারবে নাÑ এই আশ্বাস তখনো যেমন শক্তি জুগিয়েছে, এখনো এই সময়ে একই সাহস খুঁজে পাই। বাংলাদেশকে দাবায়ে রাখতে পারবে না কেউ, এই বিশ্বাস আমার পরম প্রাপ্তি। ‘মুজিবের মেয়ে’ নাটকের মূল ভাবনার সাথে আমি তাই একাত্মতা বোধ করেছি। গর্ব অনুভব করছি আমাদের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বের জন্য। তিনি সোনার বাংলার আলো ছড়িয়ে দিচ্ছেন সারা বিশ্বে।

খ্যাতিমান কবি, প্রাবন্ধিক এবং জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের পরিচালক মিনার মনসুর ‘মুজিবের মেয়ে’ নাটকের পাঠ প্রতিক্রিয়ায় এভাবে মূল্যায়ন করেছেন-“খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি কাজ”।

কেনো খুবই গুরুত্বপূর্ণ কাজ হয়ে উঠেছে ‘মুজিবের মেয়ে’ মঞ্চনাটকটি? এর উত্তর পেয়েছি মিনার মনসুরের পাঠানো লিখিত শুভেচ্ছা বার্তায়-“‘মুজিবের মেয়ে’ যাঁর কাঁধে এখন পিতার অসমাপ্ত স্বপ্ন বাস্তবায়নের গুরুভার তাঁকে সারা পৃথিবী চেনে। কিন্তু আমরা তাঁকে কতটুকু জানি? সবাই সমস্বরে বলবেন, তিনি চারবারের সফল প্রধানমন্ত্রী।

তিনি আমাদের জাতির পিতার কন্যা। তাঁর নেতৃত্বে বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে দুর্বার গতিতে। তাঁকে আমরা যথেষ্টই জানি। কিন্তু প্রকৃত বাস্তবতা ভিন্ন। আমরা হয়ত বাইরের মানুষটিকে জানি। কিন্তু যে-রক্তসমুদ্র পাড়ি দিয়ে ঘাতকদের বুলেটকে উপেক্ষা করে তিনি দৃপ্ত পায়ে বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন তার ভেতরের খবর আমরা অতি অল্পই জানি।”

একুশে পদক ও স্বাধীনতা পুরস্কারপ্রাপ্ত মঞ্চসারথী আতাউর রহমান বাংলাদেশের বলে নয়, বিশ্ব মঞ্চনাটকের অন্যতম এক প্রতিষ্ঠান হয়ে উঠেছেন। তিনি ‘মুজিবের মেয়ে’ পাঠে মূল্যায়ন করতে গিয়ে লিখেছেন, এ নাটকটি পড়ে আমার মনে হয়েছে আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর জ্যেষ্ঠ্য কন্যা, আমাদের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনাকে নাট্য দর্শকদের যথার্থভাবে চিনতে সাহায্য করবে।

মুজিবের মেয়ে’ কি তবে কেবল মাত্র বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা? ‘মুজিবের মেয়ে’ নাটকে বাংলা মায়ের সংলাপ থেকে বলি- আমি বাংলা মা, মুজিব আমার সন্তান। সেরা সন্তান। সন্তানের মতো সন্তান। আবার মুজিবই আমার পিতা।

এ বড় মধুর ধাঁধা। বাংলা মুজিবের মা, মুজিব বাংলা মায়ের সন্তান। আবার বাংলা মুজিবের মেয়ে, মুজিব বাংলার পিতা। কেননা এই দেশটার জন্মের আগেই পিতা মুজিব স্বপ্ন দেখেছিলেন, যেমন স্বপ্ন দেখেন সব পিতা তার সন্তান পৃথিবীতে আসার আগে।

মুদ্রার অপর পিঠে আছে গাঢ় অন্ধকার। বাংলাদেশ চেয়েছিলেন বলে মুজিব কারো কারোর আজন্ম শত্রু। এরা সুযোগ খুঁজেছে মুজিবকে চরম শাস্তি দেওয়ার। তাঁকে হত্যা করে ভেবেছে মুজিবের মৃত্যু হবে। হয়েছে কি? গভীর খাদে পড়ে যাওয়া বাংলাদেশকে টেনে তুলতে এসেছিলেন মুজিবের মেয়ে শেখ হাসিনা। কেবলি কন্যা পরিচয় তাঁর। পরিবারের প্রায় সব আপনজনকে হারানোর তীব্র বেদনা সহ্য করে তিনি কাজ করছেন, পিতার স্বপ্ন বাস্তবায়ন করাই তাঁর জীবনের একমাত্র লক্ষ্য। তিনি নিজেই বলেছেন, ‘আমি ব্যক্তিগত লাভের জন্য রাজনীতি করি না। আমি দেশের মানুষের জন্য নিজেকে উৎসর্গ করেছি’।

মুজিবের মেয়ে নাটকে উঠে এসেছে ‘মুজিবের মেয়ে’র লড়াই এবং এখনো চলমান দেশীয়-বৈশ্বিক ষড়যন্ত্রের বিশ্লেষণ। বাংলাদেশের অগ্রগতি নিয়ে প্রশংসা করা সহজ, যে প্রতিক‚লতা ঠেকিয়ে এগুতে হয় দেশটিকে, তার বর্ণনা দেওয়া সহজ নয়। কিন্তু এ কাজ খুব জরুরি। দেশের মানুষকে বুঝতে হবে, আমাদের লড়াইটা আসলে কি। এই যে আমি, আপনি, আপনারা, আমাদের মঙ্গল কোন্ সুতোয় বাঁধা আছে বাংলাদেশের মঙ্গলের সাথে, তা ভেবে দেখতেই হবে।

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উদ্যাপন জাতীয় বাস্তবায়ন কমিটির প্রধান সমন্বয়ক ড. কামাল আবদুল নাসের প্রধান অতিথি হিসেবে থাকছেন ২৮ সেপ্টেম্বরের মঞ্চায়নে। তাঁর শুভেচ্ছা বার্তায় তিনি বলেছেন, বাংলাদেশ ও বঙ্গবন্ধু অভিন্ন সত্তা। দীর্ঘকালের আন্দোলন সংগ্রামের মধ্য দিয়ে অর্জিত বাংলাদেশের স্বাধীনতার মহানায়ক সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের রূপায়ণে বঙ্গবন্ধুকন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সফল নেতৃত্বে বাংলাদেশ আজ সারা পৃথিবীতে উন্নয়ন ও অগ্রযাত্রার রোল মডেল। মঞ্চনাটক ‘মুজিবের মেয়ে’ বঙ্গবন্ধু ও বঙ্গবন্ধুকন্যার প্রতি বাংলাদেশের মানুষের কৃতজ্ঞতা প্রকাশের অনন্য প্রয়াস।

সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মাননীয় প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ, এমপি প্রধান অতিথি হিসেবে ‘মুজিবের মেয়ে’মঞ্চায়নের শুভারম্ভ ঘোষণা করবেন ২৭ সেপ্টেম্বর । বাংলাদেশের আপামর জনসাধারণের মাঝে জাগরণের আহ্বান ছড়িয়ে দেওয়াই ‘মুজিবের মেয়ে’ নাটকের মূল লক্ষ্য বলে তিনি তাঁর শুভেচ্ছা বার্তায় উল্লেখ করেছেন।

মঞ্চায়ন না হলে নাট্যকারের সকল ভাবনা আঁধারে ঢাকা থাকে বলে ‘মুজিবের মেয়ে’ নাটককে দর্শকদের সামনে হাজির করার জন্য কাঁচখেলা রেপার্টরি থিয়েটারকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাই। গুণী নির্দেশক ড. আইরিন পারভীন লোপার নির্দেশনায় তাদের প্রথম প্রযোজনা হিসেবে ২৭ ও ২৮শে সেপ্টেম্বর সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টায় মহিলা সমিতির ড. নীলিমা ইব্রাহীম মিলনায়তনে ‘মুজিবের মেয়ে’র উদ্বোধনী মঞ্চায়ন শতভাগ সফল হোক।

লেখক : নাট্যকার, কথাসাহিত্যিক, কলামিস্ট।

এইচআর/এমএস