আমি বাসার কাছে একটা নির্দিষ্ট সেলুনে চুল কাটাই। যতবার গেছি, প্রায়ই দেখেছি একজন মানুষ খাতা কলম নিয়ে সেলুনের মালিক ও কর্মচারীদের কাছ থেকে টাকা সংগ্রহ করছে আর একটা পাস বইয়ে স্বাক্ষর নিচ্ছে। বাজারের অনেক দোকানেই এটা আমি দেখে আসছি অনেকদিন ধরে। ঢাকাসহ সারা দেশে এরকম অনেক সংগঠন কাজ করছে, যারা চড়া সুদের আকর্ষণ দেখিয়ে ছোট ছোট আমানত সংগ্রহ করে। এই ব্যবসার পিছনে কোন ধরনের অর্থনীতি কাজ করে সেটা আমরা জানিনা, কিন্তু সত্যিটা হল যে, মানুষ এভাবে টাকা রাখে এবং এক সময় হায় হায় করে।
Advertisement
পিরোজপুরের এহসান গ্রুপ, কিংবা রাজধানীর ইভ্যালি, ই-অরেঞ্জ, ধামাকা, ডেসটিনি, যুবক, ইউনিপে যাদের কথাই বলি না কেন, এরা সবাই সঙ্কট সৃষ্টিকারী এবং এদের ব্যবসার উপাদানগুলির মধ্যে একটি মৌলিক সাদৃশ্য খুঁজে পাওয়া যায় আর তাহলো মানুষকে অত্যধিক মুনাফার লোভে ফেলে প্রতারণা করা। আমার এক অর্থনীতিবিদ বন্ধু বলছে, ‘এই যে এত ই-অরেঞ্জ বা ইভ্যালি মার্কা সংস্থায় বিনিয়োগ করে সর্বস্ব হারানোর খবর তোমরা দিচ্ছ, কাল নতুন করে কেউ এসে অফার দিলে আবার মানুষ ঝাঁপিয়ে পড়বে’। ব্যাংকে জমার ওপর সুদের হার তলানীতে এসে ঠেকেছে, অবস্থাটা এমন যে টাকা রাখলে উল্টো কমতে থাকে, শেয়ার বাজার এই চাঙ্গা, এই মন্দা। কোন বন্ড নাই, সঞ্চয়পত্র ছাড়া আকর্ষণীয় কোন বিনিয়োগ স্কিম নাই। ফলে দেশের বাজারে নানা ধরনের আমানত সংগ্রাহক সংস্থার ক্ষিপ্র গতিতে আগমন ও নিষ্ক্রমণ ঘটছে। ছোট্ট একটা দেশ, কিন্তু বিশাল মানুষের বাজার। এবং এই মানুষকে ভোলানো যায়। কেউ ধর্ম দিয়ে ভোলায়, কেউ প্রলোভন দিয়ে ভোলায়। শুধু এমএলএম বা ই-কমার্স প্রতারণার কথাই বা বলি কেন। শিক্ষিত মানুষ, বড় প্রতিষ্ঠান কোটি কোটি টাকা পি কে হালদারের ইন্টারন্যাশনাল লিজিং বা পিপল’স লিজিং-এ বিনিয়োগ করেছে। যারা বিনিয়োগ করছেন, বিশেষ করে ক্ষুদ্র আমানতকারীরা, বিনিয়োগের গতিবিধি এবং গন্তব্যস্থল সম্পর্কে খোঁজখবর নেওয়ার ব্যাপারে তাদের চরম অনীহা। যত দিন আমানত থেকে ঠিক ঠিক আয় ঘরে আসে, তত দিন দেশের মানুষ জানতে পারে না। এক দিন হঠাৎ শোনা যায়, আমানত ঠিক মতো বিনিয়োগ হয়নি, কিংবা এমন খাতে বিনিয়োগ করা হয়েছে যা আইনসম্মত নয়। তখন আর কিছু করার থাকে না। শোনা যায় উদ্যোক্তাদের কেউ পালিয়েছে, কিংবা কাউকে আটক করা হয়েছে।
অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বলেছেন, ই-কমার্সের প্রতারণার জন্য বাণিজ্য মন্ত্রণালয় দায় এড়াতে পারে না। প্রাথমিকভাবে তাদের দায়িত্ব নিতে হবে। অপরদিকে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বলেছেন,‘টাকা গেছে বাংলাদেশ ব্যাংকের মাধ্যমে। টাকা লেনদেনের বিষয়টি বাংলাদেশ ব্যাংক মনিটরিং করবে। এই ধাক্কাধাক্কিটাও অনভিপ্রেত।
প্রতারকরা গ্রেফতার হলে মানুষের কিছু যায় আসে না। তারা চায় তাদের টাকা ফেরত আসুক। এবং সেটাই আর হয় না। এমএলএম ব্যবসাটা অনেকটা এমন– আমানত সংগ্রহকারী একজনের কাছে একশো টাকা নিয়ে কুড়ি টাকা সুদ দিল। ব্যাঙ্কের সুদের চেয়ে এটা দ্বিগুণেরও বেশি। সে টাকাটা কোথাও বিনিয়োগ না করে আরও দু’জনের কাছে দুশো টাকা জোগাড় করে প্রথমজনকে একশো কুড়ি টাকা ফেরত দিল। এতেই আপ্লুত হয়ে সেই মানুষটা পাঁচশো টাকা দিল, তা দিয়ে ওই দু’জনের টাকাটা আমানত সংগ্রকারী মিটিয়ে দিল। এই গোটা প্রক্রিয়ায় আমানতকারীদের টাকা ঠিকই মিটিয়ে দিয়ে আস্থা অর্জন করা হল, আবার সেই বিশ্বাসকে মূলধন করে আরও আমানত জোগাড় করে একজনের টাকায় আরেকজনকে খুশি করা গেল। কালক্রমে এই আমানতসংগ্রকারীর প্রতি বিশ্বাসের স্তম্ভ আরও মজবুত হল। এর টাকা ওকে দেওয়ার ব্যবসা ফুলে ফেঁপে উঠল। একটি টাকাও কোথাও বিনিয়োগ করতে হল না, কোনও সম্পদ সৃষ্টি করতে হল না।
Advertisement
ই-কমার্সও পরিণত হয়েছে ই-এমএলএম এ। ১৩০ থেকে ১৫০ শতাংশ পর্যন্ত ক্যাশ ব্যাক কিংবা অর্ধেক মূল্যে পণ্য সরবরাহের প্রতিশ্রুতি- সবই করা হয় মানুষকে একটা ফাঁদে ফেলার জন্য। কোনও ভাবে লোকের আস্থা অর্জন করে যদি আমানতের ধারা বহমান রাখতে পারা যায় বা পণ্য বেঁচাকেনার প্রবাহে আনা যায়, তা হলে স্বল্প সময়ে এই সব কোম্পানির নামডাক হবে, এত লোক আমানত সংগ্রহের টাকায় বিলাসী জীবিকানির্বাহ করবে এবং তারা রাজনীতি, প্রশাসন ও সুশীল সমাজের কাছের মনুষ হয়ে উঠবে। এক সময় সেই কোম্পানি বিক্রি করে তারা সুখে শান্তিতে বসবাস করবে। যারা লোভে পড়ে, সেইসব মানুষ একবারও ভেবে দেখে না যে যথাযথ বিনিয়োগ ছাড়া সুদ দেওয়া বা ক্যাশব্যাক করা কিংবা অর্ধেক দামে পণ্য দেওয়া এমনই এক কারবার যা ভয়ঙ্কর ঝুঁকির অবস্থা তৈরি করে।
তাই ভেবেচিন্তে বিনিয়োগ করতে হবে। একদিকে করোনা সারা বিশ্বের সব নিয়ম পাল্টে দিয়েছে। আয় কমছে সর্বত্র। মানুষকে নতুন করে ছকতে হচ্ছে বিনিয়োগের পরিকল্পনা। সরকারি বেশিরভাগ প্রকল্পেই আয় এখন নিম্নগামী। সম্প্রতি সঞ্চয়পত্রের সুদের হার আরেকদফা কমিয়েছে সরকার। এরই মধ্যে বেছে নিতে হবে মন্দের ভালকে এবং সেটা অবশ্যই হতে হবে কোন নিবন্ধিত স্বনামখ্যাত আর্থিক প্রতিষ্ঠান।
শেষ করব কিছু কথা বলে। টাকা রাখার জন্য প্রকল্প খুঁজতে গিয়ে কেউ দেখল একটি সংস্থা অনেক বেশি সুদ বা মুনাফা দিচ্ছে, তাহলে তাকে এই হার আকর্ষণ করতেই পারে। কিন্তু একই সঙ্গে এই প্রশ্নটাও মনে আসা উচিত যে, বাজারের অন্যান্য সংস্থার তুলনায় তারা কেন বেশি মুনাফা দিচ্ছে? কীভাবে এটা সম্ভব? বেশি সুদ বা মুনাফার হাতছানি যে আসলে চোরাবালি, সেটা মাথায় আসা দরকার। অন্তত ডেসটিনির মতো সংগঠন সেটা যে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। ডেসটিনিতে টাকা রেখে সর্বস্ব খুইয়েছে লক্ষ মানুষ। আর এখানে দাঁড়িয়েই হিসাব করতে হবে ই-কমার্সকে। যারা স্বল্প বিনিয়োগকারী, যাদের আয়ের পথ সীমিত, তাদের পায়ের তলার মাটি নরম। তাই বাজারের বাস্তবতা বুঝেই এগোতে হবে। সেটাই তাদের বিনিয়োগ বাঁচানোর অন্যতম ঢাল।
লেখক : প্রধান সম্পাদক, জিটিভি।
Advertisement
এইচআর/এমএস