এজমল হোসেন পাইলট। ছাত্রদলের সাবেক কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি। কোন্দলের জেরে বহিষ্কার হলেও সরব আছেন দলীয় কর্মসূচিতে। নেত্রকোনার এ রাজনীতিক আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মনোনয়নপ্রত্যাশী। সেজন্য নিজের এলাকা নেত্রকোনা-১ (কলমাকান্দা এবং দুর্গাপুর) আসনে চালিয়ে যাচ্ছেন সাংগঠনিক প্রচারণাও।
Advertisement
২০২৩ সালের শেষ দিকে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন হওয়ার কথা রয়েছে। এ আসন নিয়ে নিজের পরিকল্পনার কথা জানিয়েছেন জাগো নিউজকে। পাশাপাশি বিএনপির বর্তমান সাংগঠনিক অবস্থা, বিগত দুই জাতীয় নির্বাচনসহ নানা বিষয়ে কথা বলেছেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক খালিদ হোসেন।
জাগো নিউজ: রাজনীতিতে কেন এলেন? শুরুটা কেমন ছিল?
এজমল হোসেন পাইলট: আমি ক্লাস ক্যাপ্টেন ছিলাম। স্কুল জীবন থেকেই স্কাউট করতাম। স্কুলের স্কাউট ক্যাপ্টেনও ছিলাম। পরে আমার উপজেলার সব স্কুলের ক্যাপ্টেন নির্বাচিত হই। বলতে পারেন নেতৃত্বের প্রতি এক ধরনের সহজাত টান অনুভব করি বলেই জীবনের সব কিছু হাতে রেখে বেছে নিয়েছি জটিল রহস্যে ঘেরা, অমসৃণ, বন্ধুর পথ—এই রাজনীতি।
Advertisement
হাইস্কুল জীবন থেকেই ছাত্রদলের মিছিল-মিটিং করি। স্লোগান দেই। কলেজ জীবনেও রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়েছিলাম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে পুরোদস্তুর ছাত্ররাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে যাই। তখন আওয়ামী লীগ ক্ষমতায়। হল থেকে বের করে দেওয়া হলো। এখানে ওখানে এই হলে ওই হলে থাকতে হয়েছে টানা দুই বছরের মতো। এক ধরনের বাউন্ডুলে জীবন ছিল তখন আমাদের। বিএনপি ২০০১ সালে ক্ষমতায় আসার পর স্বাভাবিক ছাত্রজীবনে ফিরে আসি। সে অনেক কথা।
জাগো নিউজ: আপনার রাজনৈতিক ক্যারিয়ারে অনুপ্রেরণা এবং চ্যালেঞ্জ কী?
এজমল হোসেন পাইলট: শহীদ জিয়াকেই (বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান) রাজনৈতিক প্রেরণার জায়গা মনে করি সব সময়। তার তৎক্ষণাৎ বুদ্ধিমত্তা, দেশপ্রেম, রাষ্ট্র পরিচালনা বিমোহিত করে আমাকে। তারপর দেশনেত্রী (বিএনপি চেয়ারপারসন) খালেদা জিয়া, আমার নেত্রী, সরাসরি কাজ করার সুযোগ হয়েছে তার সঙ্গে। তিনি আমাকে ব্যক্তিগতভাবে পছন্দ করতেন, আদর স্নেহ করতেন। অনেকের মাঝে আমাকে নাম ধরে ডাকতেন, জিজ্ঞেস করতেন—এগুলো একজন নগণ্য কর্মীর জন্য অনেক বড় অনুপ্রেরণা। আর আমি লিও টলস্টয়, মহাত্মা গান্ধী, মার্টিন লুথার কিং, মওলানা ভাসানী—এদের জীবনধারার কিছুটা অনুসারী বলতে পারেন। সিম্পল লিভিং হাই থিংকিং।
চলমান সময়ে রাজনীতির চ্যালেঞ্জটা হচ্ছে, খুব স্পষ্টভাবে দেশে বিরাজনীতিকরণ করা হচ্ছে। গণতান্ত্রিক চর্চা না থাকলে নেতৃত্বের বিকাশ হয় না।
Advertisement
জাগো নিউজ: ১২ বছর ধরে ক্ষমতার বাইরে বিএনপি, সাংগঠনিকভাবে কতটুকু শক্ত অবস্থানে আছে দল? সাংগঠনিক অবস্থান শক্ত করতে আপনার ভূমিকা কী?
এজমল হোসেন পাইলট: এক যুগ যাবত টানা বিরোধী দলে রয়েছে বিএনপি। সরকারের দমন-পীড়ন, জেল-জুলুম, মামলা-হামলা, গুম-খুন আর গ্রেফতার অভিযান সত্ত্বেও একটি মজবুত ভিত্তির ওপর দলের সাংগঠনিক কাঠামো দাঁড় করানো আছে। দীর্ঘদিন ছাত্রদলের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলাম। একাধিকবার রাজপথ থেকে গ্রেফতার হয়েছি। চরম পুলিশি নির্যাতনের শিকার হয়েছি। তবু দমে যাইনি। বেশ কয়েকটি জেলার দায়িত্বপ্রাপ্ত থাকার সময়ে দলকে নির্মোহভাবে সাজানোর চেষ্টা করেছি। যে চেষ্টা এখনো অব্যাহত আছে। নিজ এলাকার নেতাকর্মীদের সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখি। ঘোষিত কর্মসূচিতে লোকজন নিয়ে উপস্থিত থাকি। সংগঠনের প্রশ্নে সর্বোচ্চ ঝুঁকি নেওয়ার চেষ্টা করি সবসময়।
জাগো নিউজ: দলীয় কোন্দল নিয়ে নানান আলোচনা আছে। বিএনপির আজকের এই অবস্থার জন্য কোন্দলকেও দায়ী করা হয়ে থাকে, কী বলবেন?
এজমল পাইলট: দল শব্দটির সঙ্গে কোন্দল শব্দটিও থাকে। দলাদলি না থাকলে কী রাজনৈতিক দল হয়? তবে বিএনপিতে প্রকাশ্য বা অপ্রকাশ্য কোনো কোন্দল বা দলাদলি নেই। বিএনপি এক ও ঐক্যবদ্ধ। টানা বিরোধী শিবিরে থেকেও বিএনপি এক আছে এটা একটা বড় প্রাপ্তি আজকের রাজনৈতিক বাস্তবতায়। দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া এবং দেশনায়ক তারেক রহমানের নেতৃত্বে দল সামগ্রিকভাবেই ঐক্যবদ্ধ। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তার প্রজ্ঞা ও নেতৃত্ব দিয়ে এই বিশাল দলকে একই পতাকার তলে দাঁড় করিয়ে রেখেছেন।
জাগো নিউজ: দল হিসেবে বিএনপি যতটা বৃহৎ, আন্দোলন-সংগ্রামে এখন তার প্রতিফলন দেখা যায় না, কেন?
এজমল হোসেন পাইলট: বিএনপি চলমান সময়ে শুধু একটি দল মাত্র নয়। এটি এখন সমগ্র দেশের নিপীড়িত, নির্যাতিত, বঞ্চিত মানুষের আশা জাগানোর জায়গা। এই দমবন্ধ অবস্থা থেকে উত্তরণের একমাত্র দল হচ্ছে এই বিএনপি।
আন্দোলনে দেখা যায় না অভিযোগটা সরলীকরণ কথা। ৩৫ লাখের বেশি নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে মামলা। বিএনপির নেতাকর্মীরা যে পরিমাণ দমন-পীড়ন ও নির্যাতনের শিকার, এটা বোধ হয় কোনো পরাধীন দেশেও হয় না। একটা নিরীহ কর্মসূচি মানববন্ধন, তাও করা যায় না। শহীদ জিয়ার মাজারে শ্রদ্ধা জানাতে গেলেও পুলিশের পক্ষ থেকে গুলি চালানো হচ্ছে। গুম খুনের কথা তো আছেই। আর আন্দোলন যে বললেন? এই দেশে আন্দোলনের গৌরবময় ইতিহাস বিএনপিরই আছে। গণমানুষের দল, মানুষের ভোটাধিকার বিএনপি আদায় করেই ছাড়বে।
জাগো নিউজ: বিএনপিতে ত্যাগীদের মূল্যায়ন নেই বলে বিভিন্ন সময় অভিযোগ ওঠে। এমনকি সেজন্য দলীয় কার্যালয়ে তালা দিতেও দেখা যায়। আসলেই কি ত্যাগীরা অবমূল্যায়নের শিকার?
এজমল হোসেন পাইলট: টানা ১২ বছরের বিরোধী দলে কমবেশ সব নেতাকর্মীই তো ত্যাগী। ঘরছাড়া, বাড়িছাড়া। ব্যবসা-বাণিজ্য বেদখল। জেল-গ্রেফতার। পঙ্গুত্ব। এই দলের নেতাকর্মীদের ত্যাগের কিন্তু শেষ নেই। এখন কমিটির প্রশ্ন যখন আসে তখন শীর্ষ পদে তো আর সবাইকে দেওয়া যায় না। চুলচেরা বিশ্লেষণ করে, তথ্য-উপাত্ত যাচাই-বাছাই করে শীর্ষ পদগুলো দেওয়া হয়। ত্যাগীদের মূল্যায়ন করা না হলে এই দল আজকে জনপ্রিয়তার শীর্ষে অবস্থান করছে কীভাবে? বিএনপি ত্যাগ, শ্রম, মেধার মূল্যায়ন করে বলেই এখনো মাথা উঁচু করে দেশের রাজনীতিতে শক্ত অবস্থান তৈরি করেছে।
তবে বৃহৎ দল, শাখা উপ-শাখা থাকাটা স্বাভাবিক, নেতৃত্বের প্রতিযোগিতা কখনো কখনো সাময়িক ক্ষোভের জন্ম দেয়। এগুলো পরে বসে আলোচনার মাধ্যমে শেষ করে সবাই একসঙ্গে কাজ চালিয়ে যায়।
দলীয় অফিসে তালা দেওয়ার ব্যাপারটা হয়, যেন কোনো এজেন্ট বা এজেন্সির লোকজন ভেতরে ঢুকে স্যাবোটাজ (পরিস্থিতির রাজনৈতিক সুবিধা নেওয়া) করতে না পারে।
জাগো নিউজ: ২০১৪ সালের দশম নির্বাচন বয়কট করেছে বিএনপি। ২০১৮ সালের একাদশ নির্বাচনে অংশ নিয়েও ভরাডুবি হয়েছে। আগামী দ্বাদশ নির্বাচনের জন্য বিএনপি কতটুকু প্রস্তুত?
এজমল হোসেন পাইলট: ২০১৪ সালের নির্বাচনে বিএনপি অংশ নেয়নি বলেই দেশের ভোটারও ভোট দিতে যায়নি। ৫ শতাংশ ভোটের নির্বাচন ছিল সেটা। ২০১৮ সালের নির্বাচন বিএনপি অংশ নিয়েছিল বলেই দিনের ভোট রাতে নিতে হয়েছে। এটা বিএনপির ভরাডুবি নয়, এগুলো দেশের সামগ্রিক নির্বাচন ব্যবস্থার ভরাডুবি। গণতন্ত্র আজ নির্বাসনে। গণতন্ত্র এখন কাজীর গরুর মতো, কিতাবে আছে বাস্তবে নেই, বক্তব্যে ভাষণে আছে বাস্তবে নেই।
বহু দলীয় গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠিত দল বিএনপি আগামী নির্বাচনের জন্য সবসময় প্রস্তুত। দেশের সার্বিক রাজনৈতিক সংকট উত্তরণ ঘটানোর প্রশ্নে নির্মোহ, নিরপেক্ষ, দলদাস নয় এমন নির্বাচন কমিশন গঠন করে, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অবাধ সুষ্ঠু নিরপেক্ষ নির্বাচনে অংশ নিতে বিএনপির কোনো প্রস্তুতি লাগে না। দেশের ৮০ শতাংশ ভোটার বিএনপির পক্ষে। ধানের শীষের পক্ষে। মাননীয় ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বলেছেন, আগামীতে বিএনপি সরকার গঠন করবে এতে কোনো সন্দেহ নেই। দেশের আপামর জনসাধারণও এই কথা বিশ্বাস করে। আমরা দলের নেতাকর্মীরাও সেই আঙ্গিকে কাজ করে যাচ্ছি। বেটার ডেইজ উয়িল কাম সুন।
জাগো নিউজ: আপনার দৃষ্টিতে নেত্রকোনা-১ আসনের সমস্যা ও সম্ভাবনা কী?
এজমল হোসেন পাইলট: আসনটি সীমান্তবর্তী এলাকায়। এখনো রাস্তাঘাট ৭০-৮০ শতাংশ ব্যবহারের উপযোগী নয়। বর্ষাকালে মানুষের চলাচলে খুবই অসুবিধা হয়। তারপর রয়েছে মাদক ও চোরা কারবার, এগুলো সামাজিক জীবনকে বিনষ্ট করে দিচ্ছে। কঠোর হাতে এগুলো দমন করতে হবে।
এলাকার রয়েছে ব্যাপক পর্যটনের সম্ভাবনা। দেশের সব এলাকা থেকে যেন সহজে পর্যটকেরা এখানে আসতে পারেন, নিরাপদে থাকতে পারেন, বেড়াতে পারেন এর সুব্যবস্থা করা যায়। রয়েছে প্রাকৃতিক সম্পদ বালি-পাথর, মধ্যস্বত্ত্বভোগীদের হাত থেকে নিস্তার পেয়ে এলাকার প্রকৃত ব্যবসায়ীরা যেন নিজেরা ব্যবসা করতে পারেন তা নিশ্চিত করতে হবে।
জাগো নিউজ: নেত্রকোনা-১ আসন নিয়ে আপনার পরিকল্পনা কী?
এজমল হোসেন পাইলট: আমি গ্রামে বেড়ে উঠেছি। গ্রামের স্কুলে পড়াশোনা করেছি। সেই ছায়া সুনিবিড় মেঠোপথ থেকে আজকের এই রাজধানীর পিচঢালা পথে। গ্রামের মানুষের সুখ-শোক এগুলো খুব কাছ থেকে দেখে দেখে উপলব্ধি করে এগুলোর সঙ্গে সংগ্রাম করে বড় হতে হয়েছে আমাদের। চিকিৎসা, শিক্ষা এবং সুষম খাদ্য—চলমান সময়ে এই তিনটে ফেনোমেনন গ্রামের মানুষের জন্য সবচেয়ে জরুরি।
মেঠোপথ এখন পাকা হয়েছে। কিন্তু অসুস্থ হলে অ্যাম্বুলেন্স নেই, ডাক্তার নেই। গুণগত মানের কোনো স্কুল নেই। গ্রামের শিশুরা এখনো পুষ্টিহীনতায় ভোগে। সুষম খাদ্যের ব্যবস্থা নেই। এগুলো নিয়ে কাজ করার ইচ্ছে রয়েছে।
স্বপ্ন বলতে যা, একটি সন্ত্রাস, চাঁদাবাজ, দুর্নীতিমুক্ত এলাকা। নাগরিকদের প্রকৃত অধিকারের জায়গাটা পূরণ করা। দিন বদলের এই হাওয়ায় একটি বিশ্বমানের সুবিধাসম্পন্ন এলাকা তৈরি করে যাওয়া।
কেএইচ/এইচএ/এমএস