হাতে হাত রেখে হাঁটবো আর দেখবো। রাতের আঁধারে কফি শপের আড্ডা আর ফ্যান্সি রেস্টুরেন্টে ফ্রান্সের নানা ধরনের খাবার, সব মিলিয়ে হারিয়ে যাবো আমি আর আমার সহধর্মিণী দিনে দুপুরে এবং রাতের আঁধারে। এমনটি অনুভূতির সৃষ্টি হয়েছিল সেদিন হৃদয়ে স্টকহোম থেকেই। কোনো পরিকল্পনা ছাড়াই কিনেছি টিকিট। কোথাই উঠবো, কোথায় ঘুরবো, কী করবো, কিছুই জানিনে। শুধু প্যারিসের অদূরে এক বন্ধুর বাড়িতে যাবো সেটা ছিল নিশ্চিত। সন্ধ্যা সাতটার দিকে পৌঁছে গেলাম Paris Charles de Gaulle এয়ারপোর্টে। এয়ারপোর্ট থেকে ট্রেনে করে চলে আসলাম প্যারিসে। সেন্ট্রাল প্যারিসেই সুন্দর একটি হোটেলে ঢুকে চেকিং পর্ব শেষ করে দু’জনে বেরিয়ে গেলাম প্যারিসের সামার ইন দি সিটিতে। যাই করি আর যাই দেখি, সবই এক্সপেরিয়েন্স। এর আগে তো কখনও প্যারিসে আসিনি তাই স্বাভাবিকভাবেই সবই নতুন। প্যারিসে গিয়ে আনন্দ ফুর্তির রাজ্যে হারিয়ে যাওয়া বিচিত্র কিছু নয়। কোথায় যাবো? কী দেখবো? কোথা থেকে শুরু করবো? আসতে লাগলো মনের মাঝে হাজারও প্রশ্ন।
Advertisement
দূর হতে শহরের নাম শুনেছি। বত্রিশটি সেতুর সমন্বয়ে গড়ে উঠেছে এই শহর। প্রিয় সহধর্মিণীর হাত ধরে একটির পর একটি করে সেতুর ওপর দিয়ে হাঁটাহাঁটির সঙ্গে মন বিনিময় করা ছিল সেদিনের প্যারিসের জার্নি যা আজ এত বছর পর মনে পড়ে গেল সেই প্রথম দেখার স্মৃতি। মনে পড়ে গেল সেই হৃদয় দেবার তিথী। দুজনার দুটি পথ মিশে গেলো, এক হয়ে নতুন প্যারিসের পথে।
শুরু করলাম “Eiffel Tower” লিফ্ট দিয়ে। রোমান্টিক শহরের দৃশ্য এক নজরে দেখতে পাওয়া ছিল সেদিন এক চোখের দেখা। পরের দেখা ছিল সেই “Louvre Museum”, ভেতরে ঢুকে মোনালিসাকে দেখা। মোনালিসাকে দেখছি আর মাঝে মধ্যে আমার নব বিবাহিত সহধর্মিণী মারিয়াকে দেখছি। হঠাৎ মারিয়া জিজ্ঞেস করলো ‘মোনাকে না দেখে আমাকে কেন বার বার দেখছো’? উত্তরে বলেছিলাম সেদিন ‘তুমি সুন্দর তাই চেয়ে দেখি প্রিয় সেকি মোর অপরাধ’! মোনাকে দেখে চলে গেলাম “Cathedral Notre-Dame de Paris”, কাটালাম কিছুক্ষণ সেখানে দু’জনে। শুনেছি এই Cathedral এর বিখ্যাত ঘণ্টাবাদক Quasimodoর বিশাল ভালোবাসার কাহিনি তার Gypsy Esmeraldaর সঙ্গে, তাই মনের অজান্তে কিছুক্ষণ হারিয়ে গিয়েছিলাম দু’জনে দু’জানার সাথে সেদিন। পথ চলতে চলতে আর কথা বলতে বলতে চলে এলাম Avenue des Champs এ, এই ১.৯ কিলোমিটার দীর্ঘ পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর এভিনিউ ‘‘Place de la Concorde and the Arc de Triomphe” যা না দেখলেই নয়। এক পলক ফেলে এলাম। দিনের শেষে সেই বিশ্ববরেণ্য চিত্রশিল্পীদের আড্ডাখানা, বিকেলের শেষে ঘুরে ঘুরে চিত্রশিল্পীদের রংয়ের ছোঁয়া ছুঁয়েছিল সেদিন আমাদের হৃদয়ও।
ঘোরার রইলো বাকি আর দেখার হলো না শেষ তবে সময় শেষ হতে চলেছে। হঠাৎ চারদিন পার হয়ে গেল প্যারিসে। সময় তাড়া করেছে যেতে হবে এক বন্ধুর বাড়িতে। বন্ধুর বাড়ি St Malo, প্যারিস থেকে ট্রেনে St Malo-র দুরত্ব তিন ঘণ্টা। বন্ধুর নাম সামপেয়ার্স। একসঙ্গে পড়েছি সুইডেনে। সামপেয়ার্স বিয়ে করেছে আমার আগে। সামপেয়ার্স আমার চেয়ে মস্তবড় পরিচালক। বিয়েও করেছে এক জমিদারের মেয়েকে।
Advertisement
মেয়ের বাবার বাড়ি Jersey তে। সকালে ঘুম থেকে উঠে এক্সপ্রেস ট্রেনে করে রওনা দিলাম St Malo-র উদ্দেশ্যে। তিন ঘণ্টার মতো এই ট্রেন জার্নি। পথে ফ্রান্সের গ্রামের সৌন্দর্য দেখতে দেখতে প্রায় চলে এসেছি, হঠাৎ টিকিট কাউন্টার আমাদের টিকিট দেখতে চাইলো, টিকিট বের করে দেখালাম। ফ্রান্স ভাষাতে কী সব বলতে শুরু করলো যার আগামাথা কিছুই বুঝলাম না তবে মারিয়া দিব্যি কথা বলে যাচ্ছে দেদারছে।
পরে জানতে পারলাম টিকিট শুধু কিনলেই হবে না ট্রেনে ঢোকার আগে একটি মেশিনের মধ্যে দিয়ে চেকিং করতে হয় যা আমরা করিনি, ভুলে গেছি বা খেয়াল করিনি। খেয়াল করবো কী করে নতুন প্রেমের জোয়ার বইছে মনে, সব কী আর ঠিক থাকে? যতটুকু মনে পড়ে এসব ভুলের জন্য জরিমানা দিতে হয় দ্বিগুণ এটাই নরমাল নিয়ম কিন্তু মারিয়ার ফ্রান্স ভাষা জানা এবং হ্যানিমুনের ভ্রমণের কথা শোনার পরে বেচারা দয়া করেছিল তাই এক হাজার ফ্রাংক বেঁচে গিয়েছিল সেদিন।
স্টেশনে হাজির হতেই বন্ধু সামপেয়ার্স এবং তার স্ত্রী মালিকা অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য একগোছা রজনীগন্ধা হাতে করে। ফ্রান্সের রোমান্টিক ওয়েতে শুভেচ্ছা বিনিময় শেষে নিয়ে গেল আমাদেরকে সেই “day trip to the beautiful Channel Islands of Jersey”. এই Jersey শহরে বাস করে মালিকার বাবা-মা। মালিকার বাবা তার নিজের Condor boat-এ বসে আছে আমাদের জন্য।
শুভেচ্ছা ও ভালোবাসা বিনিময় শেষে রওনা দিলাম Jerseyতে। জীবনে এই প্রথম বেল্ট বাঁধলাম মাজাতে। Condor চলতে শুরু করল হাওয়ার বেগে এবং এক ঘণ্টা কুড়ি মিনিট পরে হাজির হয়ে গেলাম Jerseys stylish beach cafeতে এবং লান্স এখানে সেরে গাড়ি করে পৌঁছে গেলাম মালিকার বাবা-মার প্রাসাদ বাড়িতে।
Advertisement
বিশাল জায়গা নিয়ে Jerseryতে রয়েছে আঙ্গুর ফলের বাগান সাথে ন্যাচারাল পদ্ধতিতে ওয়াইন তৈরির কারখানা। Let me just say, what a beautiful place this is! মালিকার সাথে সামপেয়ার্সের প্রেমের কাহিনি শুনেছি আগে, এখন শেয়ার করবো এক মজার গল্প। সামপেয়ার্স লেখাপড়ায় ভালো তবে মালিকার মতো বড়লোক নয়। তাদের প্রেম এবং পরে বিয়ে বলতে গেলে মালিকার বাবা-মার কিছুটা মতের বিরুদ্ধে।
তবে তারা একে অপরকে ভালোবাসে বিধায় বিয়ে সম্পন্ন হয়েছে। সামপেয়ার্সের ধারণা ছিল একমাত্র মেয়ে, কী-না কী হবে বা পাবে বিয়ের পরে। দুঃখের বিষয় সাধারণভাবে বিয়ে হয়েছে এবং সামপেয়ার্স গিফট হিসেবে ৫০টি ওয়াইনের বোতল পেয়েছে। সামপেয়ার্সের মনটা বেশ খারাপ ছিল অনেকদিন ধরে। মালিকা এবং সামপেয়ার্স যেহেতু নিজেদের বাড়ি St Malo-তে থাকে তাই কোনো এক অকেশনে তাদের দু’জনার সেলেব্রেশন পালন করবে।
ঘরে ড্রিংক করার মতো তেমন কিছু নেই, শেষে সামপেয়ার্স মনে করলো বাড়িতে ৫০টি ওয়াইনের বোতল রয়েছে চলো তার একটি ড্রিংক করি? বোতলের কর্ক খুলতেই দেখতে পেল বোতলে ওয়াইন ভরা হয়েছিল ১৮৫০ সালে যা কর্কে সিল মারা রয়েছে।
মালিকা তার বাবাকে ফোন করে বিষয়টি বলতে বলেছিলেন ‘ঐ ওয়াইনগুলো আমার নানা পেয়েছিলেন তার শ্বশুরের থেকে, পরে আমি পেয়েছিলাম তোমার নানার থেকে এখন তোমরা পেয়েছো আমার থেকে।’ সেদিন সামপেয়ার্স জানতে পেরেছিল পঞ্চাশ হাজার ফ্রাংক প্রতিটি ওয়াইনের বোতলের মার্কেট ভ্যালু যা সে গিফট পেয়েছিল, ১৯৯৪ সালের কথা।
মনের আনন্দে ঘুরছি আর প্রতিটি মুহূর্ত এনজয় করছি Jerseyতে। তিনদিন কখন কীভাবে পার হয়ে গেল জানিনে। হঠাৎ মারিয়ার শরীরটা বেশ খারাপ মনে হচ্ছে এবং সে বলে সুইডেনে ফিরতে হবে। কী আর করা! তাড়াহুড়ো করে ফ্লাই ব্যাক করলাম বাড়িতে। বাড়িতে ফিরে এসে মারিয়া ডাক্তারের কাছে গিয়েছে। আমি বাসাতে রান্নাবান্নার ব্যবস্থা করছি।
মারিয়া বাসাতে এসে বাথরুমের বাথটবে পানি ভরে তার মধ্যে গোসল করছে, কিছুক্ষণ পর আমাকে বললো “Rahman I love you. I will be the mother of your child.” রহমান আমি তোমাকে ভালোবাসি, এ কথা শুনেছি হাজারও বার তবে আমি তোমার সন্তানের মা হতে চলেছি, এ কথা শুনেছিলাম সেদিন প্রথমবার।
লেখক: রহমান মৃধা, সাবেক পরিচালক (প্রোডাকশন অ্যান্ড সাপ্লাই চেইন ম্যানেজমেন্ট), ফাইজার, সুইডেন থেকে, rahman.mridha@gmail.com
এমআরএম/জিকেএস