সালতামামি

আলোচনায় মাতৃগর্ভে গুলিবিদ্ধ ও কুকুরের কামড়ে ক্ষতবিক্ষত শিশু

মাতৃগর্ভে গুলিবিদ্ধ ও কুকুরের কামড়ে ক্ষতবিক্ষত দুই নবজাতক শিশুর অলৌকিকভাবে বেঁচে যাওয়া ছিলো চলতি বছরের অন্যতম আলোচিত ঘটনার একটি । মুমূর্ষু অবস্থায় এ দুই নবজাতককে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তির সময় খোদ চিকিৎসকরাও তাদের সুস্থ হয়ে ওঠার ব্যাপারে সন্দিহান ছিলেন।তবে চিকিৎসা কার্যক্রমের সাথে জড়িত চিকিৎসক, নার্স, ওয়ার্ডবয় সকলেই ছিলেন আন্তরিক। তাদের নিরলস প্রচেষ্টায় দু’টি শিশুই মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরে আসে। ঢামেক হাসপাতালের চিকিৎসকরা সর্বমহলে প্রশংসিত হন। বর্তমানে গুলিবিদ্ধ শিশু সুরাইয়া তার বাবা-মায়ের সাথে মাগুরায় ও কুকুরের কামড়ে আহত শিশুটি সমাজসেবা অধিদফতরাধীন আজিমপুরের শিশু মনি নিবাসে রয়েছে। দু’জনেই সুস্থ আছে বলে জানিয়েছেন ঢামেক হাসপাতালের একাধিক চিকিৎসক। ফিরে দেখা ২৩ আগস্টগত ২৩ জুলাই মাগুরায় সন্ত্রাসীদের গুলিতে মাতৃগর্ভে গুলিবিদ্ধ হয় নবজাতক শিশু সুরাইয়া। জরুরি ভিত্তিতে মাগুরা জেলা সদর হাসপাতালে সিজারিয়ান অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে তার জন্ম হয়। ২৬ জুলাই ভোরবেলায় মুমূর্ষু অবস্থায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের শিশু সার্জারি বিভাগে ভর্তি করা হয় তাকে। জাগো নিউজের এ প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপকালে নবজাতক বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. আবিদ হোসেন মোল্লা ও শিশু সার্জারি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. কানিজ হাসিনা শিউলি জানিয়েছিলেন জন্মের পরও সুরাইয়া কাঁদেনি, শ্বাস-প্রশ্বাসও প্রায় ছিলনা। চিকিৎসকরা কৃত্রিম উপায়ে শ্বাস-প্রশ্বাস স্বাভাবিক করেন। জন্মগতভাবে তার হৃদপিণ্ডে ছিদ্র ছিল। স্বাভাবিক নবজাতকের চেয়ে তার জন্ম অনেক আগে হয়। ওজনও ছিল অনেক কম। ঢামেক হাসপাতালে ভর্তির পর তার দেহে অস্ত্রোপচার করা হয়। শিশুটির শরীরে ২৩টি সেলাই পড়ে। প্রথমে ওয়ার্ডে ও পরে তাকে নিওনেটাল কেয়ার ইউনিটে রেখে চিকিৎসা দেয়া হয়। ২০ আগস্ট সুরাইয়াকে সুস্থ অবস্থায় বাবা-মায়ের কাছে ফিরিয়ে দেন চিকিৎসকরা। তার বিদায় উপলক্ষে আয়োজিত ঢামেক হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে চিকিৎসকরা জানান, শিশু সুরাইয়া এখন সুস্থ আছে। ধীরে ধীরে তার ওজন বাড়ছে। বিদায়ের সময় তার ওজন ২১শ’ ৪০ গ্রাম। হাসপাতাল থেকে ছাড়ার আগে গত  দু’দিনে সুরাইয়ার রক্তসহ অন্যান্য প্রয়োজনীয় শারীরিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়েছে। কোন ধরনের শারীরিক জটিলতা পাওয়া যায়নি।তারা জানান, শিশুটির হার্টে যে অস্বাভাবিক ধরনের শব্দ হতো সেটাও এখন আর নেই। চোখের সমস্যা থাকলেও চক্ষু বিশেষজ্ঞরা কিছুদিন পর এসে অস্ত্রোপচার করার পরামর্শ দেন। অপেক্ষাকৃত কম ওজন হওয়ায় মায়ের বুকের দুধের পাশাপাশি ভিটামিন, ফলিক অ্যাসিড ও আয়রন খাওয়ানোর ব্যাপারে পরামর্শ দেয়া হবে।ডা. শিউলী যিনি শুরু থেকেই সুরাইয়ার চিকিৎসার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলেন তার কাছে প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে বলেন, তারা সকলেই (ডাক্তার, নার্স, কর্মকর্তা-কর্মচারী) সুরাইয়াকে সুস্থ অবস্থায় মায়ের বুকে ফিরিয়ে দিতে চেয়েছিলেন, এ কাজটি করতে পেরে তারা আনন্দিত ও গর্বিত।ফিরে দেখা ১৫ সেপ্টেম্বরদুপুর আনুমানিক আড়াইটা। রাজধানীর উত্তর কাফরুলের ডোরিন গার্মেন্টেসের দক্ষিণ পাশে পুরাতন বিমানবন্দর এলাকার রানওয়ের পাশে কয়েকজন শিশু খেলাধুলা করছিল। হঠাৎ করেই তাদের চোখে পড়ে অদূরে ঝোঁপের ভেতর একটি কুকুর মুখ দিয়ে কি যেন কামড়ে ধরার চেষ্টা করছে। কৌতুহলবশত সামনে এগিয়ে যেতেই রক্তমাখা এক নবজাতককে দেখে ভয়ে আঁতকে উঠে চিৎকার চেঁচামেচি শুরু করে। পরবর্তীতে জাহানারা নামে এক নারী শিশুটিকে উদ্ধার করে প্রথমে শিশু হাসপাতাল ও পরে ঢামেক হাসপাতালে ভর্তি করেন।গত ১১ অক্টোবর বিশ্ব শিশু দিবসে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা শেষে শিশুটিকে সুস্থ করে তুলে সমাজসেবা অধিদফতরের আজিমপুর শিশু নিবাসের উপ-তত্ত্বাবধায়ক সেলিনা আক্তারের কাছে হস্তান্তর করা হয়। হস্তান্তর অনুষ্ঠানে শিশু সার্জারি বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. আশরাফুল হক কাজল বলেন, শিশুটিকে যখন উদ্ধার করে হাসপাতালে আনা হয় তখন তার চেহারা ছিল বীভৎস। সারামুখ ছিল রক্তমাখা। ঠোঁটের ওপরিভাগের এক তৃতীয়াংশ ও নাকের কিছু অংশ কুকুর কামড়ে ছিঁড়ে নিয়েছিল। তখন ক্ষতস্থান থেকে অবিরত রক্ত ঝরছিল।তিনি জানান, সাধারণত শিশুদের ক্ষেত্রে ক্ষতস্থানে অস্ত্রোপচার কিংবা ডায়াথার্মি মেশিনে হিট দিয়ে রক্তপাত বন্ধ করা হয়। কিন্তু সদ্য জন্ম নেয়া নবজাতকের রক্তপাত বন্ধে দুটো উপায়ের কোনটিই করা সম্ভব ছিল না। কিন্তু শিশুটির রক্তপাত অনেকটা নিজে নিজেই বন্ধ হয়ে যায়।শিশু বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. এখলাসুর রহমান বলেন, শিশুটিকে কুকুরে কামড়ানোর ফলে জলাতঙ্ক হতে পারতো। ধনুষ্টংকার কিংবা বড় ধরনের ইনফেকশন হতে পারতো কিন্তু চিকিৎসক নার্সসহ সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় ও সঠিক ওষুধপত্র দিয়ে চিকিৎসা প্রদানের ফলে নবজাতক বেঁচে যায়।হাসপাতালের পরিচালক বিগ্রেডিয়ার জেনারেল মিজানুর রহমান খান জানিয়েছিলেন, কামড়ে ক্ষতবিক্ষত সেই হতভাগিনী নবজাতক শিশুটির সকল প্রকার দায়দায়িত্ব নিয়েছে সরকার। প্রাপ্তবয়স্ক না হওয়া পর্যন্ত ভরণ-পোষণের সব দায়িত্ব বহন করবে সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়। ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তাকে সম্পূর্ণ বিনামূল্যে চিকিৎসা প্রদান করবে।এমইউ/এসএইচএস

Advertisement