টাঙ্গাইলের মির্জাপুর উপজেলার ছয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ১৪১ জন ছাত্রী বাল্যবিয়ের শিকার হয়েছে বলে জানা গেছে। তারা পড়াশোনা বন্ধ করে এখন করছে স্বামীর সংসার। করোনা পরিস্থিতিতে দীর্ঘ দেড় বছর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় দারিদ্রতা ও দুর্ঘটনা এড়াতে অভিভাবকরা কম বয়সে মেয়েদের বিয়ে দিয়েছেন বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্ট বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা। ১২ সেপ্টেম্বর থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার পর বিবাহিত কয়েকজন ছাত্রী বিদ্যালয়ে এসে ক্লাস করছেন বলেও জানান তারা।
Advertisement
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, মির্জাপুর সরকারি সদয় কৃষ্ণ মডেল উচ্চ বিদ্যালয়ে ষষ্ঠ শ্রেণি থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত মোট শিক্ষার্থী এক হাজার ৯৬২ জন। এর মধ্যে ষষ্ঠ শ্রেণির এক ছাত্রী প্রেমের সম্পর্ক করে সম্প্রতি বিয়ে করেছে। এছাড়া এসএসসি ২০২১ এর পরীক্ষার্থী একজন এসএসসি ২০২২ এর পরীক্ষার্থী পাঁচজনের বিয়ে হয়েছে।
সদরের মির্জাপুর পাইলট বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে ষষ্ঠ শ্রেণি থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত ১ হাজার ৪৬০ জন শিক্ষার্থী রয়েছে। এ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভোকেশনালসহ নবম শ্রেণিতে ২৯১ ছাত্রী রয়েছে। তাদের মধ্যে ছয়জন বিয়ে করেছে। এছাড়া এসএসসি ২০২১ এর পরীক্ষার্থী ৩৪ জন ও এসএসসি ২০২২ এর পরীক্ষার্থী ২০ জন বিয়ের পিঁড়িতে বসে।
দেওহাটা এ জে উচ্চ বিদ্যালয়ে ষষ্ঠ শ্রেণি থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত ১ হাজার ১১৯ জন শিক্ষার্থী আছে। এর মধ্যে অষ্টম শ্রেণির একজন, নবম শ্রেণির চারজন, এসএসসি ২০২১ এর পরীক্ষার্থী আট জন, এসএসসি ২০২২ এর পরীক্ষার্থী ১২ জন ছাত্রীর বিয়ে হয়ে গেছে বলে জানিয়েছেন বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. খোরশেদ আলম।
Advertisement
উপজেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে প্রতিষ্ঠিত গেড়ামাড়া গোহাইলবাড়ি সবুজ সেনা উচ্চ বিদ্যালয়। বিদ্যালয়টিতে গত দেড় বছরে এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ষষ্ঠ শ্রেণির চারজন, সপ্তম শ্রেণির ৯ জন, ২০২১ সালের এসএসসি পরীক্ষার্থী ১৯ জন ও ২০২২ সালের এসএসসি পরীক্ষার্থী ৯ জন ছাত্রী বাল্যবিয়ের শিকার হয়েছে বলে জানিয়েছেন বিদ্যালয়ের সহকারী প্রধান শিক্ষক ফিরোজ আল মামুন।
একই অবস্থা উপজেলার ৬৬ নম্বর বহুরিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের। এ বিদ্যালয়টিতে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পাঠদান চলে। এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গত দেড় বছরে অষ্টম শ্রেণির তিন শিক্ষার্থীর বিয়ে হয়েছে বলে জানিয়েছেন বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক শফিকুল ইসলাম।
এদিকে, মির্জাপুর উপজেলা সদরের আফাজ উদ্দিন দারুল উলুম দাখিল মাদরাসায় গত দেড় বছরে অষ্টম শ্রেণির একজন ও নবম শ্রেণির চারজন ছাত্রীর বিয়ে হয়ে গেছে।
সদরের আফাজ উদ্দিন দারুল উলুম দাখিল মাদরাসার সুপার মোহাম্মদ ফজলুল করিম বলেন, বাল্য বিয়ের অন্যতম কারণ দারিদ্রতা। করোনা মহামারিতে কর্মজীবী অনেক মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়ে। এতে দরিদ্র মানুষ বেশি বিপাকে পড়ে। একদিকে তাদের সংসার চালানো অপরদিকে ছেলেমেয়েদের পড়াশোনার খরচ মেটাতে হিমশিম খেতে হয়। তাই অল্প বয়ে মেয়েদের বিয়ে দিয়েছেন অনেকে।
Advertisement
গেড়ামাড়া গোহাইলবাড়ি সবুজ সেনা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধানশিক্ষক বলেন, বাল্যবিয়ে আগামী প্রজন্মের সুস্থভাবে বেড়ে ওঠা এবং সুনাগরিক হিসেবে গড়ে উঠতে বড় বাধা। শিক্ষার্থীদের অভিভাবকদের এ বিষয়ে বুঝালেও তারা বুঝার চেষ্টা করেন না। বিভিন্ন উপায়ে মেয়েদের বয়স বৃদ্ধি করে তাদের বিয়ে দেন অভিভাবকরা।
মির্জাপুর পাইলট বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. সুলতান উদ্দিন জানান, দীর্ঘ দেড় বছর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় অভিভাবকরা মেয়ের পড়াশোনা নিয়ে অনিশ্চয়তায় ভুগছিলেন। মেয়েরা বাড়িতে বসে অলস সময় পার করছিল। বাড়িতে অলস বসে থেকে দুর্ঘটনা ঘটাতে পারে এমন চিন্তা করে অনেক অভিভাবক ভালো ছেলে দেখে মেয়েদের বিয়ে দিয়েছেন। তবে তাদের অনেকেই ক্লাস করছে।
মির্জাপুর থানা মসজিদের ইমাম ও খতিব হাফেজ মাওলানা এবং নিকাহ রেজিস্ট্রার (ভাতগ্রাম ইউনিয়ন) মো. ফরিদ হোসাইন বলেন, অপ্রাপ্ত ছেলে-মেয়ের বয়স বৃদ্ধির মাধ্যমে বিয়ের বৈধতা নেই। আমি একটি বাল্য বিয়েরও নিকাহ রেজিস্ট্রার করিনি। তবে চিফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের অনুমতি সাপেক্ষে নিকাহ রেজিস্ট্রার করানো হয়।
মির্জাপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. হাফিজুর রহমান জানান, বাল্যবিয়ের খবর পেলে আমরা উপস্থিত হয়ে ওই বিয়ে বন্ধ করি। গত দেড় বছরে এ উপজেলায় কতজন শিক্ষার্থী বাল্যবিয়ের স্বীকার হয়েছে তার তালিকা করা হচ্ছে।
এস এম এরশাদ/এসজে/জিকেএস