ই-ভ্যালি, ই-অরেঞ্জের মতো প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি চটকদার বিজ্ঞাপন ও বিশাল ছাড়ের অফারের ফাঁদে ফেলে হাজার হাজার গ্রাহকের সঙ্গে প্রতারণা করার অভিযোগ উঠেছে সিরাজগঞ্জের ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান সিরাজগঞ্জশপ.কম ও আলাদীনের প্রদীপ’র বিরুদ্ধে।
Advertisement
এ দুই প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগ ও পণ্যের অর্ডার করে অগ্রিম টাকা দিয়ে এখন বিপাকে পড়েছেন হাজারো গ্রাহক। অভিযোগ আছে, গ্রাহকদের টাকা নিয়ে লাপাত্তা হয়েছেন প্রতিষ্ঠান দুটির কর্ণধারেরা, তালাবদ্ধ করে রাখা হয়েছে দুই প্রতিষ্ঠানের অফিসও। অনলাইন ব্যাংকিং নগদ’র মাধ্যমে টাকা ফেরত দেওয়ার কথা থাকলেও অ্যাকাউন্ট বন্ধ থাকায় হতাশায় ভুগছেন বিনিয়োগকারীরা।
সরেজমিনে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সিরাজগঞ্জ সদর উপজেলার বহুলি ইউনিয়নের বেড়াবাড়ি গ্রামের স্বল্পশিক্ষিত তরুণ জুয়েল রানা জেলা প্রশাসনের লার্নিং অ্যান্ড আর্নিং প্রজেক্টের প্রশিক্ষণ নিয়ে গড়ে তোলেন ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান সিরাজগঞ্জশপ.কম। শহরের এম এ মতিন সড়ক ও কাঠেরপুল এলাকায় জাঁকজমকপূর্ণ দুটি অফিস নিয়ে জনবল নিয়োগ দিয়ে চটকদার বিজ্ঞাপন ও বিশাল ছাড়ের অফারের মাধ্যমে শুরু করেন বিনিয়োগ ও অর্ডারের অগ্রিম অর্থ আদায়। নিজে প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা হন ও স্থানীয় গণমাধ্যমকর্মী মাসুদ পারভেজকে করেন ব্যবস্থাপনা পরিচালক। প্রতিষ্ঠান চালুর পর অল্প সময়ে কোটিপতি বনে যান জুয়েল ও মাসুদ, শুরু হয় তাদের বিলাসী জীবনযাপন।
জেলার তাড়াশ উপজেলার নিভৃতপল্লীর সন্তান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মেহেদী হাসান মুন ও মাহমুদ হাসানও ঠিক একইভাবে গড়ে তোলেন ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান আলাদীনের প্রদীপ। দেশের অন্যান্য ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি সিরাজগঞ্জশপ.কম ও আলাদীনের প্রদীপ প্রায় সোয়া চার লক্ষ অর্ডারের বিপরীতে সংগ্রহ করে অগ্রিম ২০৫ কোটি টাকা।
Advertisement
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কালো তালিকাভুক্ত দেশের ১৫টি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের মধ্যে থাকা এ প্রতিষ্ঠান দুটির কর্মকর্তাদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, পণ্য দেওয়া ও টাকা রিফান্ড করার পরেও এখনো গ্রাহকদের কাছে প্রায় ২২ কোটি টাকা বকেয়া রয়েছে।
এদিকে বিপুল পরিমাণ অর্থ বকেয়া রেখে প্রতিষ্ঠান দুটির কর্ণধারেরা আত্মগোপনে যাওয়া ও নগদ অ্যাকাউন্ট বন্ধ থাকায় বিভ্রান্তি ও হতাশায় ভুগছেন বিনিয়োগকারীরা। আত্মগোপনে যাওয়া দুই প্রতিষ্ঠানের উল্লিখিত চার যুবক গ্রাহকদের নানা আশ্বাস দিয়েছিলেন। প্রতিষ্ঠান দেউলিয়া হওয়ার সম্ভাবনা নেই, তারা এমনও বলেছিলেন গ্রাহকদের।
এরইমধ্যে সিরাজগঞ্জ শহরের বাহিরগোলা ও এমএ মতিন সড়কে সিরাজগঞ্জশপ.কমের প্রধান ও আঞ্চলিক অফিস দুটি গত প্রায় দুই সপ্তাহ ধরে তালাবদ্ধ অবস্থায় রয়েছে। প্রয়োজনীয় ডকুমেন্টসহ আসবাবপত্র সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। রহস্যজনকভাবে উধাও হয়ে গেছে কোম্পানির পণ্য ডেলিভারির গাড়িগুলোও।
আলাদীনের প্রদীপ.কম-এর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মেহেদী হাসান মুন সাংবাদিকদের বলেন, অনলাইন ব্যাংকিং নগদের ঝামেলার কারণে ঢাকায় আছি।
Advertisement
প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাহমুদ হাসান বলেন, এক লাখ ২০ হাজার গ্রাহকের ৮৫ কোটি টাকার অর্ডারের বিপরীতে মাত্র ৫ কোটি টাকা বকেয়া আছে। নগদের ঝামেলা না থাকলে এসব বকেয়াও থাকতো না।
তবে সিরাজগঞ্জশপ.কমের পরিচালক মাসুদ পারভেজ ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা জুয়েল রানাকে তাদের প্রতিষ্ঠানের কার্যালয়ে গিয়ে পাওয়া যায়নি।
জুয়েল রানার বড় ভাই আনোয়ার হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, জুয়েল এরইমধ্যে গ্রাহকের ১২৫ কোটি টাকা ফেরত দিয়েছে শুনেছি। ‘নগদ’ অ্যাকাউন্ট ফ্রিজ না করলে বাকি ৮-১০ কোটি টাকাও হয়তো ফেরত দিতো। ই-কমার্স নীতিমালা ও নগদ এর অ্যাকাউন্ট বন্ধ করে দেওয়ার কারণেই গ্রাহকদের সাময়িক ভোগান্তি হচ্ছে।
এদিকে ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলোকে নীতিমালার আওতায় আনা ও নজরদারির পাশাপাশি ভুক্তভোগী গ্রাহকদের অর্থ ফিরিয়ে দিতে সরকার কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করবে বলে প্রত্যাশা ভুক্তভোগী গ্রাহকদের।
দেশের ই-কমার্স ব্যবসা তদারকি করতে একটি ‘ই-কমার্স রেগুলেটরি অথরিটি’ করার নির্দেশনা চেয়ে গতকাল সোমবার (২০ সেপ্টেম্বর) হাইকোর্টে রিট আবেদন করেছেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মো. আনোয়ারুল ইসলাম বাঁধন। রিটে ই-কমার্স রেগুলেটরি অথরিটি করতে বিবাদীদের নিষ্ক্রিয়তা কেন অবৈধ হবে না- মর্মে রুল জারির আর্জি জানানো হয়। একইসঙ্গে রিটে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব, অর্থ মন্ত্রণালয়ের সচিব, বিটিআরসির চেয়ারম্যান, ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ও ই-ক্যাবকে বিবাদী করা হয়েছে।
সম্প্রতি দেশের শীর্ষসারির ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান ইভ্যালির চেয়ারম্যান ও এমডিকে গ্রাহকদের বিপুল পরিমাণ অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে গ্রেফতার করার পর এ নিয়ে সারাদেশে ব্যাপক তোলপাড় চলছে। এরপরই নড়েচড়ে বসতে শুরু করেছে অন্য ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলো।
ইউসুফ দেওয়ান রাজু/এমকেআর/জিকেএস