ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে বছরের পর বছর প্লাবিত হয়ে আসছে বরগুনার উপকূলীয় জনপদ। সাগরের লবণ পানিতে তলিয়ে যায় এসব এলাকা। ফলে এখানকার মাটিতে দিন দিন বেড়েই চলছে লবণাক্ততা। কমে আসছে মাটির উর্বরতা।
Advertisement
কৃষকরা বলছেন, দুর্বল বেড়িবাঁধের কারণে প্রতিবছর উপকূলে লবণ পানি প্রবেশ করে। আর এ লবণাক্ততার কারণে যতো দিন যাচ্ছে, জমিতে ততোই ফসলের পরিমাণ কমছে। কৃষকদের এমন মন্তব্যে একমত কৃষিবিদরাও। তারা বলছেন, জলোচ্ছ্বাসে এসব পানির লবণাক্ততার কারণে জমির উর্বরতা কমে যাচ্ছে। যার প্রভাব পড়ছে দীর্ঘমেয়াদী।
বরগুনা সচেতন মহলের নাগরিক অ্যাডভোকেট মজিবুল হক কিসলু জাগো নিউজকে বলেন, ভাঙা ও জোড়াতালি দেওয়া বেড়িবাঁধ উপকূলবাসীর গলার কাটা হয়ে আছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড এসব বাধ স্থায়ীভাবে মেরামত করে না। যখন ঘূর্ণিঝড় হয় তখনই এসব বাঁধের জোড়াতালি ভেঙে প্লাবিত হয় জেলার উপকূলীয় অঞ্চল। তখন তড়িঘড়ি করে পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) জরুরি মেরামত করে। যা আবার জোয়ারের চাপে ছুটে যায়। তবে স্থায়ীভাবে বাঁধ নির্মাণ করলে এমন সমস্যা হতো না।
মে ২০২০ থেকে মে ২০২১ পর্যন্ত পানিতে লবণের মাত্রা নিয়ে গবেষণা শেষে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউট। তাদের গবেষণায় দেখা গেছে, বরগুনা উপকূলের বলেশ্বর নদীতে লবণের মাত্রা ১৪.৮ ডিএস, পায়রা নদীর তালতলী অংশে লবণের মাত্রা ৬.৬১ ডিএস, আমতলী অংশে ৩.১৬ ডিএস। যা মারাত্মক ক্ষতিকর।
Advertisement
অন্যদিকে, বিশখালীর পাথরঘাটা অংশে ৩.২৬ ডিএস, বিশখালীর বড়ইতলা অংশে ২.৫০ ডিএস, বিশখালীর বামনা অংশে ১.০৮ ডিএস, বিশখালীর বেতাগী অংশে ০.৮৬ ডিএস লবণের মাত্রা পাওয়া গেছে। যা বিগত বছরের থেকে কয়েকগুণ বেশি।
বরগুনা ও পটুয়াখালীর মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউটের ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা এ এফ এম মামুন জাগো নিউজকে বলেন, এবার রেকর্ড পরিমাণ লবণের মাত্রা পাওয়া গেছে উপকূলীয় এলাকায়। এসব লবণাক্ততা কাটাতে প্রচুর বৃষ্টি দরকার।
এ বিষয়ে বরগুনা কৃষি অফিসের অতিরিক্ত উপ-পরিচালক কৃষিবিদ এস এম বদরুল আলম জাগো নিউজকে বলেন, জেলায় মোট ১ লাখ ৪ হাজার হেক্টর কৃষি জমি। এর মধ্যে তিন ফসলি জমি ৫১ হাজার ৩৮০ হেক্টর। তবে প্রতি বছর এসব এলাকা প্লাবিত হয়। সমস্যাটা শুধু প্লাবিত হওয়া নিয়ে নয়। একবার একটি উর্বর জমি লবণ পানিতে তলিয়ে গেলে টানা দুই বছরের বৃষ্টিতে সেই মাটির লবণাক্ততা কাটে। কিন্তু প্রতিবছরই এসব অঞ্চল প্লাবিত হয়। যার কারণে একবার লবণাক্ততা কাটার আগেই আবারও লবণ পানিতে তলিয়ে থাকে ফসলি জমি। ফলে এখন এই অঞ্চলে ফসল কম হয়।
তিনি আরও বলেন, সাধারণত ১/২ ডিএস পর্যন্ত মাটিতে লবণাক্ততা থাকলেও কৃষির ফলন পাওয়া যায়। তবে এবার ডিএসের মাত্রা তিনগুণ বেশি। এসব একদিনে অথবা এক বছরে হয়নি। বছরের পর বছর লবণ পানিতে উর্বর জমিতে তলিয়ে থেকেছে। এসব নিয়ে সরকারের এখনই ভাবা দরকার। নয়তো চরম মূল্য দিতে হবে। এক সঙ্গে না পারলেও ধীরে ধীরে যতোটা সম্ভব স্থায়ীভাবে বাঁধ নির্মাণ করতে হবে।
Advertisement
বরগুনা জেলা মৎস্য কর্মকর্তা বিশ্বজিৎ কুমার জাগো নিউজকে বলেন, পানিতে ঘের, পুকুর ও জলাশয়ের মাছ ভেসে গেলে প্রাথমিক একটা লোকসান হয় মৎস্যচাষির। কিন্তু এসব ঘের, পুকুর বা জলাশয়ে লবণ থেকে যাওয়া চাষিদের মারাত্মক ক্ষতি হয়। মাটি যখন পানি থেকে লবণ গ্রহণ করে, তখন পানি মিষ্টি হতে প্রচুর সময় লাগে। এ সময়ে প্লাবিত হওয়া ঘের-পুকুর-জলাশয়ে মাছ চাষ করলে, তাতে শতভাগ লোকসান হয়।
তিনি আরও বলেন, মাছ প্রচুর খাবার খায় ঠিকই কিন্তু লবণাক্ততার কারণে বড় হয় না। ব্যবসায়ীদের মারাত্মক লোকসান হয়। যার প্রভাবে বাজারে দাম বৃদ্ধি থাকে মাছের। শুধু সাগরের মাছ দিয়ে চাহিদা পূরণ সম্ভব নয়। তাই যে কোনো মূল্যে স্থায়ী বাঁধ নির্মাণের উদ্যোগ নিতেই হবে।
এসব বিষয়ে বরগুনা পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী কাইছার আলম বলেন, এক কিলোমিটার স্থায়ী বেড়িবাঁধ নির্মাণ করলে খরচ হয় ২৫ কোটি টাকা। এসব বাঁধ নির্মাণে বড় প্রকল্প নেওয়া ছাড়া সম্ভব না। তাই স্থায়ী বাঁধ নির্মাণ সম্ভব হচ্ছে না। ছোট ছোট যা বরাদ্দ আসে তা দিয়েই বেড়িবাঁধ মেরামত করে উপকূলবাসীকে জলোচ্ছ্বাসের হাত থেকে রক্ষা করতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করা হচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, গত দুবছরে একাধিকবার স্থায়ী বাঁধ নির্মাণের জন্য মৌখিক ও লিখিতভাবে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের জানানো হয়েছে। তবে এখনও বড় প্রকল্প গ্রহণ করা হয়নি।
এসজে/এএসএম