জাতীয়

ভাইকে খুন করে নিজেই মামলার বাদী, হত্যার রহস্য উদঘাটন

পারিবারিক বিরোধের জেরে বড় ভাই স্বপন মিয়ার (৩৮) ওপর ক্ষুব্ধ ছিলেন রিপন মিয়া (৩৫)। এক পর্যায়ে বড় ভাইকে খুনের পরিকল্পনা করেন। চুক্তি হয় কয়েকজন খুনির সঙ্গে। নিজেও তাদের সঙ্গে যোগ দেন। সেই মোতাবেক সহযোগীদের নিয়ে নৃশংসভাবে খুন করেন বড় ভাইকে। দুদিন পর মরদেহ উদ্ধারের ঘটনায় ছোট ভাই রিপন নিজেই বাদী হয়ে মামলা করেন।

Advertisement

ঘটনাটি ঘটে কিশোরগঞ্জের ভৈরবে। চাঞ্চল্যকর এই হত্যার তদন্তে নেমে বাদী রিপন মিয়াকেই হত্যার মূল আসামি হিসেবে আবিষ্কার করে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। এ ঘটনায় রিপন মিয়া ছাড়াও আব্দুর রব, ইমান আলী ও সবুজকে গ্রেফতার করে পিবিআই।

রোববার (১৯ সেপ্টেম্বর) পিবিআইয়ের সদরদপ্তরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. আবু ইউছুফ এসব তথ্য জানান।

পিবিআই জানায়, এসিড মেরে, পানিতে ডুবিয়ে ঘাড় ভেঙে নৃশংসভাবে স্বপন মিয়াকে হত্যা করেন তার ছোট ভাই রিপন মিয়া। পরে তিনি নিজেই বাদী হয়ে ভৈরব থানায় একটি মামলা করেন। পারিবারিক বিরোধ, জমি-জমা নিয়ে বিরোধ এবং নেশা করতে বাধা দেওয়ায় এই হত্যাকাণ্ড ঘটে।

Advertisement

পিবিআইয়ের তদন্তে জানা যায়, স্বপন মিয়ারা চার ভাই ও এক বোন। বড় ভাই খোকন মিয়া সৌদি প্রবাসী। আর হত্যাকাণ্ডের শিকার স্বপন মিয়া চা বিক্রেতা ছিলেন। রিপন মিয়া ছিলেন মালয়েশিয়া প্রবাসী। ২-৩ বছর আগে তিনি মালয়েশিয়া থেকে দেশে ফেরেন। করোনার কারণে বিদেশে না যেতে পেরে বাড়ির পাশে মাছের খামারসহ কৃষি জমি আবাদ করেন। তাদের সবার ছোট ভাই সোহেল মিয়া একজন বুদ্ধি প্রতিবন্ধী। স্বপন মিয়াকে হত্যার তিনদিন পর তার ছেলের জন্ম হয়। তাই তার স্ত্রী হত্যা মামলার বাদী হতে পারেননি।

পিবিআইয়ের কিশোরগঞ্জ জেলার (ইউনিট ইনর্চাজ) পুলিশ সুপার মো. শাহাদাত হোসেনের তত্ত্বাবধানে মো. রিপন মিয়া, আব্দুর রব, ইমান আলী এবং সবুজকে গত শুক্রবার নিজ নিজ বাড়ি থেকে গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতারের পর প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে স্বপন মিয়াকে হত্যার কথা স্বীকার করেন রিপন। শনিবার কিশোরগঞ্জের সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মো. শহীদুল ইসলাম চৌধুরীর আদালতে আরও পাঁচজনের নাম উল্লেখ করে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেন তিনি।

গ্রেফতারদের বরাত দিয়ে পিবিআই জানায়, রিপন মিয়া নিয়মিতভাবে তার পরিচিত কয়েকজন বন্ধুর সঙ্গে ইয়াবা ও গাঁজা সেবন করতেন। নিহত স্বপন মিয়ার সঙ্গে রিপনের পারিবারিক বিভিন্ন কারণসহ পৈতৃক জমি বণ্টন নিয়ে বিরোধ ছিল। রিপনকে নেশা করতে বাধা দিতেন স্বপন। ওই নেশার বিষয়টি স্বপন তার মাকে নিয়মিত জানানোর কারণে ক্ষিপ্ত ছিলেন রিপন। এর মধ্যে বাড়ির জন্য নতুন রাস্তা নির্মাণের খরচ ১৫ হাজার টাকা রিপনকে দেওয়ার কথা থাকলেও স্বপন দেননি। এতে বড় ভাইয়ের ওপর আরও ক্ষিপ্ত হন এবং প্রতিশোধ নেওয়ার পথ খুঁজতে থাকেন।

যেভাবে হত্যা করা হয় স্বপনকে

Advertisement

পিবিআই জানায়, গত ২৫ জুলাই রাত ১০টা থেকে সাড়ে ১০টার মধ্যে রিপন মিয়াসহ তার পূর্ব পরিচিত আব্দুর রব, ইমান আলী, সবুজ ও বুলবুল প্রতিবেশী আলম (আলকাছ) মিয়ার পুকুর পাড়ে বসে স্বপনকে হত্যার পরিকল্পনা করেন। এদের মধ্যে বুলবুল চুরি-ডাকাতি ও খুনের সঙ্গে জড়িত। পরিকল্পনা অনুযায়ী ২৬ জুলাই রিপন মিয়ার দেওয়া ২০০ টাকায় ইমান ও বুলবুল ভৈরব বাজার বাইন্নাপট্রি থেকে এসিড কিনে আনেন। আর রিপন মিয়া সেই এসিডের বোতল তার বাড়ির পাশে পুকুর পাড়ে নিয়ে রাখেন।

২৬ জুলাই রাত ১২টা থেকে সাড়ে ১২টার মধ্যে এসিডের বোতলসহ রিপন মিয়া, ইমান আলী, সবুজ, বুলবুল, আব্দুর রব ও গাড়িচালককে নিয়ে লতিফ মার্কেটের ভেতরে অবস্থান করেন। স্বপন মোবাইল কথা বলতে বলতে লতিফ মার্কেটের সামনে এলে ওই আসামিরা সবাই স্বপনকে ঘিরে ধরেন এবং বুলবুল ও সবুজ স্বপনের পেছন থেকে গামছা দিয়ে নাক-মুখে পেঁচিয়ে ধরেন। ইমান আলী ও আব্দুর রব স্বপনকে জোর করে গাড়িতে উঠিয়ে নেন। গাড়িতে ওঠার পর ছোট রাজাকাটা কবর স্থানের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় বাঁচার জন্য চলন্ত গাড়ি থেকে লাফ দিয়ে দৌড় দেন স্বপন মিয়া। তখন ইমান আলী তার হাতে থাকা এসিডের বোতল স্বপন মিয়ার মুখে ছুড়ে মারেন। ওই এসিড স্বপন মিয়ার চোখ-মুখ ও নাকে লেগে ঝলসে যায়।

এক পর্যায়ে স্বপন মিয়া চিৎকার দিতে দিতে দৌড়ে পাশের বিলের পানিতে লাফ দেন। সঙ্গে সঙ্গে ওই পাঁচজনও বিলের পানিতে লাফ দিয়ে তাকে ধরে পানির নিচে চাপ দিয়ে রাখেন। ওই সময় রিপন, ইমান আলী এবং আব্দুর রব স্বপনের হাত-পা জোর করে ধরে রাখেন। পরে বুলবুল ও সবুজ মিয়া স্বপনের ঘাড় ভেঙে ফেলেন। এতে তাৎক্ষণিক তার মৃত্যু হয়।

পরবর্তী সময়ে ওই আসামিরা গাড়িচালকের সহযোগিতায় স্বপনের মরদেহ বিল থেকে উঠিয়ে গাড়িতে তোলেন। মরদেহটি ৫০-৬০ গজ দূরে নিয়ে একটি কালভার্টের নিচে রেখে আসেন। পরে পালিয়ে যান তারা।

পিবিআই জানায়, রিপন মিয়া তার বড় ভাইকে হত্যার পরিকল্পনা করার সময় সবুজকে পাঁচ হাজার টাকা দেন। অপারেশন সফল হলে প্রত্যেক আসামিকে খুশি করে দেওয়ার কথা বলেন। ২৮ জুলাই স্বপনের মরদেহ কালভার্টের কাছে পাওয়া যায়।

এরপর এ ঘটনায় ভৈরব থানায় রিপন বাদী হয়ে তিনজনের নাম উল্লেখ করে একটি মামলা করেন। পিবিআইয়ের কিশোরগঞ্জ জেলার ক্রাইমসিন ইউনিট ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে। এছাড়া তারা ছায়া তদন্ত অব্যাহত রাখে।

তদন্ত চলাকালে বাদী রিপন মিয়ার আচরণে সন্দেহ হয় পিবিআইয়ের কিশোরগঞ্জ জেলার ইউনিট প্রধানের। পরে মামলাটি পিবিআই শিডিউলভুক্ত হওয়ায় গত ১ সেপ্টেম্বর পুলিশ পরিদর্শক মোহাম্মদ সাখরুল হক খানের ওপর তদন্তভার দেওয়া হয়। সেই তদন্ত করতে গিয়ে হত্যাকাণ্ডে রিপনের সম্পৃক্ততা পায় পিবিআই।

তদন্তের ১৫ দিনের মাথায় হত্যার রহস্য উদঘাটন করে তারা। গত শুক্রবার (১৭ সেপ্টেম্বর) রিপন মিয়া, আব্দুর রব, ইমান আলী ও সবুজকে গ্রেফতার করে পিবিআই টিম। তবে গাড়িচালক এখনও পলাতক।

টিটি/জেডএইচ/