ভ্রমণ

৫০০ টাকায় চাঁদপুর ভ্রমণ

ইসতিয়াক আহমেদ

Advertisement

সদরঘাট গিয়েই ১০ টাকার টিকিট কেটে ঢুকে পড়লাম লঞ্চ টার্মিনালে। বাস টার্মিনালে ফ্রিতে প্রবেশ করলেও লঞ্চ টার্মিনালের হিসেব আলাদা। ঢুকেই দেখবেন সারি সারি লঞ্চ। টার্মিনালে ঢুকে গন্তব্য অনুযায়ী লঞ্চ খুঁজে বের করাই প্রথম কাজ।

চাঁদপুরের লঞ্চগুলো মূলত লালকুঠি ঘাটের কাছ থেকে ছাড়ে। যা কি না সদরঘাটের টার্মিনালের পূর্বদিকে অবস্থিত। ৩০ মিনিট পরপর লঞ্চ। তবে এই লঞ্চ ছাড়া সময়ের বিষয়ে তারা কিন্তু বেশ কড়া। আর তাই টুপ করে উঠে পড়লাম আমরা। এবার পালা লঞ্চ ছাড়ার।

একদম ঘড়ির কাটা ধরেই লঞ্চ ছেড়ে দিলো। ইট পাথরের জাদুর শহর ঢাকাকে ফেলে রেখে এবার বুড়িগঙ্গার দূষিত বাতাস খেতে খেতে ছোটার পালা। ঢাকা থেকে চাঁদপুর মাত্র ৩ ঘণ্টার লঞ্চ জার্নি। পথ তুলনামূলক অল্প হলেও এই রুটের লঞ্চগুলো বেশ ভাল মানের ও বড় আকারের।

Advertisement

আমরা মূলত যাচ্ছি বোগদাদিয়া- ৭ লঞ্চে করে। লক্ষ্মিবাজার শিপিং কর্পোরেশনের এই লঞ্চ সকাল ৮টা ৩৫ মিনিটে ঢাকা থেকে চাঁদপুরের উদ্দেশ্যে যাত্রা করে। আর ফিরতি পথ ধরে বিকেল ৫টায়। ৮৫০ হর্স পাওয়ারের দু’টি শক্তিশালী উইচাই ইঞ্জিন এ লঞ্চের প্রাণ।

ঢাকা- চাঁদপুর- ঢাকা রুটে চলাচল কারী লঞ্চের ভাড়া

ডেক টিকেট- ১০০ টাকা, দ্বিতীয় শ্রেণি (নন এসি চেয়ার) লঞ্চভেদে ১৩০-১৫০ টাকা, প্রথম শ্রেণি (এসি ইকোনোমিক চেয়ার) লঞ্চভেদে ২২০-২৫০ টাকা, বিজনেস ক্লাস (এসি বিজনেস চেয়ার) লঞ্চভেদে ২৭০-৩০০ টাকা।

সিঙ্গেল কেবিন (নন এসি) ৪০০ টাকা, সিঙ্গেল কেবিন (এসি) ৪৫০-৫০০ টাকা, ডাবল কেবিন (নন এসি) ৮০০ টাকা, ডাবল কেবিন (এসি) ৯০০ টাকা, ভি আই পি কেবিন (সিঙ্গেল) ১০০০ টাকা, ভি আই পি কেবিন (ডাবল) ২০০০ টাকা।

Advertisement

লঞ্চেই আছে টুকটাক খাবারের ব্যবস্থা। আড্ডা দিতে দিতে কম সময়ের মধ্যেই চলে এলাম ইলিশের বাড়ি খ্যাত চাঁদপুরে। শীতলক্ষ্যা থেকে মেঘনা হয়ে, মুন্সিগঞ্জ, মোহনপুর পেছনে ফেলে একসময় চাঁদপুর পৌঁছানো।

পুরাতন ঘাটে লঞ্চ গেল না। পদ্মা, মেঘনা আর ডাকাতিয়া নদীর সঙ্গমস্থল থেকে একটু পেছনে, বামদিকে নতুন ঘাট। ভেঁপু বাজিয়ে চাঁদপুরের সেই ঘাটেই ভিড়ল লঞ্চ। ইলিশের স্বাদে বুঁদ হওয়ার জন্য ঢাকা থেকে ডে লং ট্যুর হিসাবে চাঁদপুর ভ্রমণ বেশ জনপ্রিয়। বেশিরভাগ পর্যটকরাই একদিনের ট্রিপে চাঁদপুর যান।

লঞ্চ থেকে নেমেই ৭-৮ মিনিটের পায়ে হাঁটা পথ। গন্তব্য এবার বড় স্টেশন। পুরাতন রেলওয়ে স্টেশনটিই বড় স্টেশন নামে খ্যাত। আস্তানা হিসেবেও এর সুখ্যাতি ছিল। কথিত আছে, একসময় এখানে ভান্ডারি গানের আসর বসত। সেই থেকে এর নাম হয়ে যায় আস্তানা।

এবার আমরা মোহনার দিকে এগিয়ে যাই। যে স্থান দেখার জন্য ভ্রমণপিপাসুরা চাঁদপুরে ঘুরতে যান। এখানে নদী বাঁধ দিয়ে আটকানো। প্রতিদিন বাঁধের উপর হাজার হাজার মানুষ বেড়াতে যায়। ভীড় করা মানুষ আড্ডা-গল্পে মশগুল হয়ে ওঠেন। এর ঠিক সামনেই পদ্মা মেঘনা ও ডাকাতিয়া তিন নদীর মোহনা।

রক্তধারা’ নামে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিস্তম্ভ এখানে জ্বলজ্বল করছে। চারপাশ দেয়াল দিয়ে ঘিরে ফেলা হয়েছে, ভেতরে আগে রিকশা বা অটো প্রবেশ করে বিশৃংখল অবস্থা তৈরি করতো বলেই এই ব্যবস্থা। রক্তধারা’ স্মৃতিস্তম্ভটি খুব সুন্দর। গায়ে লেখা ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’।

ঘুরে ঘুরে ঘুরাঘুরি করতে করতে তো মাঝে মধ্যে পেট পূজোও করা দরকার। যেহেতু ইলিশের বাড়িতে চলে এসেছি তাই ইলিশ ছাড়া দুপুরের খাবার ঠিক জমে না। চলে এলাম নতুন স্টেশনের কাছে। আর ঠিক স্টেশনের সঙ্গেই লাগোনা এক পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন হোটেল।

ক্যাফে আল মদিনাতেই বসে পড়লাম খেতে। গরম ভাত, ইলিশ ভাজা, বেগুন ভাজা দিয়ে তৃপ্তি সহকারে দুপুরের খাবার সারলাম। এরপর উঠে পড়লাম চাঁদপুরের আরেক বিখ্যাত খাবার খাওয়ার বাসনায়।

ইলিশের বাড়ি চাঁদপুরেই তৈরি হয় বিখ্যাত এ আইসক্রিম। এর নাম ‘ওয়ান মিনিট আইসক্রিম’। মাত্র এক মিনিটেই তৈরি হয় বলে এ নামেই নামকরণ করা হয়। শুধু আইসক্রিম নয়, এখানকার মিষ্টিও চমৎকার এবং সুস্বাদু।

চাঁদপুর শহরের প্রাণকেন্দ্র কালীবাড়ি এলাকা সংলগ্ন প্রেসক্লাব সড়কে ‘ওয়ান মিনিট’ নামের মিষ্টান্ন ভান্ডারের অবস্থান। ১৯৬৩ সালের দিকে পূর্বপুরুষের হাত ধরে শুরু হওয়া প্রতিষ্ঠানটি স্বগৌরবে চালিয়ে যাচ্ছেন বর্তমান কর্ণধাররা।

তাৎক্ষণিকভাবেই তৈরি হয় এই আইসক্রিম। বিদ্যুতের সাহায্যে মাত্র এক মিনিট সময় ব্যয় হয়। এজন্য আছে স্বয়ংক্রিয় মেশিন। যা ভারত থেকে আনা হয়েছে। আইসক্রিমটি নরম ও ভিন্ন স্বাদের। প্রতি কাপ আইসক্রিমের দাম ৪০ টাকা।

আইসক্রিম খেয়েই আবারও ধরলাম উল্টো পথ। আবার পুরোনো বড় স্টেশন হয়ে নদী পেরিয়ে মিনি কক্সবাজার যাওয়ার পালা। আপনার হাতে সময় থাকলে ঘুরতে পারেন চাঁদপুরের মিনি কক্সবাজার খ্যাত হাইমচর থেকে।

শুকনো মৌসুমে পানি কমে গেলে হাইমচরের বিশাল এলাকা জেগে ওঠে। বড় স্টেশনের কাছ থেকে ট্রলারে জনপ্রতি ৮০-১০০ টাকা ভাড়ায় ঘুরে আসতে পারবেন এই চর থেকে। তবে যদি বড় গ্রুপ হন তবে মাত্র ৬০০ টাকাতেও ৯-১০ জন ঘুরে আসতে পাবেন রিজার্ভ নিয়ে।

চরে নেমে সময় কাটাতে পারেন। খুবই অল্প গভীর পানির এই স্থানে। চাঁদপুর জেলায় রাজরাজেশ্বর ইউনিয়নে পদ্মা, মেঘনা ও ডাকাতিয়া নদীর মিলনস্থলে অবস্থিত একটি। চাঁদপুর ত্রিনদী মোহনা বড়স্টেশন মোলহেড থেকে দেড় কিলোমিটার দূরে পদ্মা ও মেঘনার মিলনস্থলের দক্ষিণ পূর্ব অংশে বালুময় ভূমি এটি।

নদীপৃষ্ঠ থেকে কিছুটা উঁচু হওয়ায় শুষ্ক ও বর্ষা মৌসুমের ভরা জোয়ারেও এটির পুরো অংশ পানিতে ভেসে যায় না। বছরজুড়ে পর্যটকদের আনাগোনা থাকে তাই এখানে। মূলত ২০১৮ সালের শুরুর দিকে এটি পরিচিতি লাভ করে মিনি কক্সবাজার হিসেবে।

এরপর থেকে ধীরে ধীরে দেশব্যাপী মানুষের কাছে পর্যটনকেন্দ্র হিসেবে পরিচিতি লাভ করতে শুরু স্থানটি। নদীর ভাঙা-গড়ার মধ্যেই প্রাকৃতিকভাবে স্থানটির উৎপত্তি। প্রতিদিন হাজারও মানুষ ছুটে আসেন এখানে। অসাধারণ এক জায়গা এমিনি কক্সবাজার খ্যাত চাঁদপুরের হাইমচর।

দিনের আলো নিভে আসছে এবার ফেরার পথ ধরার পালা। মিনি কক্সবাজার থেকে ফিরেই হাঁটা ধরলাম লঞ্চ টার্মিনালের পথে। ৫টার লঞ্চ ধরে এবার ঘরে ফেরার পালা। দিনের আলো নিভে আসছে, নদীর ঠান্ডা বাতাসে জুরিয়ে যাচ্ছে মন। মাত্র ৫০০ টাকায় একদিনেই চাঁদপুর ভ্রমণ করতে পারবেন।

জেএমএস/জিকেএস