মতামত

‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’র যোগ-বিয়োগ

ইয়াহিয়া নয়ন

Advertisement

২০ বছরে আফগান যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের খরচ হয়েছে দুই লাখ কোটি ডলারের বেশি। এতো টাকা কোথায় খরচ হলো, কারা পেল, কীভাবে পেল? চলছে হিসাব-নিকাশ। বেরিয়ে আসছে নানা চমক লাগানো তথ্য। ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’ কেটেছে ২০ বছর। কোন পক্ষ বিজয়ী হলো? চলছে তারও হিসাব-নিকাশ। পাওয়া যাচ্ছে রাজনৈতিক লাভ-ক্ষতির নানা তথ্য।

আফগানিস্তানে আমেরিকান ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন ডলার খরচ প্রসঙ্গে স্বনামধন্য ব্রাউন ইউনিভার্সিটির এক রিপোর্টে দেখানো হয়েছে, কীভাবে আমেরিকা ২০ বছরের যুদ্ধে কমপক্ষে দুই লাখ কোটি ডলার খরচের খাত থেকে বেরিয়ে এসেছে সেনা প্রত্যাহারের মাধ্যমে। ব্রাউন ইউনিভার্সিটির ‘কস্টস অব ওয়ার’ প্রজেক্ট থেকে প্রকাশিত রিপোর্টে এসব তথ্য দেয়া হয়েছে। রিপোর্টে বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের এ অর্থ আফগানিস্তানে যুবক, অতি ধনী কিছু মানুষের ক্ষুদ্র একটি গোষ্ঠী সৃষ্টি করতে সহায়ক হয়েছে।

এসব আফগান আমেরিকান সেনাদের দোভাষী হিসেবে কাজ করেছেন। পথঘাট চিনিয়ে দিয়েছেন। গোপন তথ্য সরবরাহ করেছেন। নিরীহ মানুষ হত্যায় সহযোগিতা করেছেন। ক্যান্টনমেন্টে নারী সরবরাহ করেছেন। বিনিময়ে হয়ে গেছেন মিলেয়নিয়ার। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে আমরা যাদের বলতাম রাজাকার। এই রাজাকার দলে যারা যুক্ত হয়েছিলেন তাদের মধ্যে ব্যাপক হারে দুর্নীতি জেগে উঠেছিল। তারা কাউকে পরোয়া করতো না। সাধারণ আফগান নাগরিকরা তাদের ভয়ে তটস্থ থাকতো। তারা পুরো আফগানিস্তানকে গ্রাস-ত্রাস করে। ভেঙে পড়ে সেদেশের দুর্বল গণতন্ত্র।

Advertisement

ব্রাউন ইউনিভার্সিটির এই রিপোর্ট নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সংবাদ ভিত্তিক টেলিভিশন চ্যানেল সিএনবিসি তাদের এক প্রতিবেদনে জানায়, আফগানিস্তান পুনর্গঠনের উদ্দেশ্যে এসব প্রচেষ্টা চালানো হয়েছিল। এত বেশি অর্থ পুনর্গঠনের নামে খরচ করা হলেও শেষ পর্যন্ত প্রতিটি প্রাদেশিক রাজধানী তালেবানদের দখল করতে সময় লেগেছে মাত্র নয়দিন। তালেবানরা সেনাবাহিনীকে বিলুপ্ত করে দিয়েছে। উৎখাত করেছে যুক্তরাষ্ট্র সমর্থিত সরকারকে।

ফিরে যাবার সময় যুক্তরাষ্ট্রের সেনাবাহিনী এবং কর্তারা সেইসব আফগান রাজাকারদের সঙ্গে নিয়ে যায়নি। ৪৫ হাজার আফগান (রাজাকার) কে বাংলাদেশে সাময়িক আশ্রয়ের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে অনুরোধ করা হয়েছিল। বাংলাদেশ বিমানের সঙ্গেও কথা বলেছিল। শেখ হাসিনার সরকার তা পুরোপুরি প্রত্যাখ্যান করেছে। আফগান থেকে ফিরে যাবার সময় যুক্তরাষ্ট্র তার ‘নিজের লোকদের’ এভাবে ফেলে যাবে তা কেউ ভাবেনি। এনিয়ে চলছে নানা বিশ্লেষণ।

তালেবান শাসিত কাবুল থেকে আমেরিকানদের প্রত্যাহারের আগ পর্যন্ত সেখানে বিপুল অংকের টাকা খরচের প্রসঙ্গে প্রচুর আলোচনা হলেও সে টাকা আসলে কোথায় গেল, সে সম্পর্কে কথাবার্তা হয়েছে কমই। একটি অনুসন্ধানী টিভি চ্যানেলের 'ফলো দ্য মানি' প্রতিবেদনে এমনই চাঞ্চল্যকর তথ্য প্রকাশ পেয়েছে। খুঁজে বের করার চেষ্টা হয়েছে, এই বিপুল অর্থের লেনদেনের ক্ষেত্রে 'কে কালপ্রিট'।

বিশ্বের অপরাধ জগতের অনেক অজানা খবর প্রকাশ করে এই মিডিয়া। এই মিডিয়া রাজনৈতিক স্ক্যান্ডাল, স্টক মার্কেট কেলেংকারি, যুদ্ধের খরচ ইত্যাদি ক্ষেত্রে আর্থিক দুর্নীতি উন্মোচন করে থাকে তাদের 'ফলো দ্য মানি' প্রতিবেদনে। আফগানিস্তান স্পটে যুদ্ধ বাবদ যে বিপুল খরচের বহর আমেরিকান প্রশাসন দিয়েছেন, তার ময়নাতদন্ত করেও এই সংবাদমাধ্যম পেয়েছে আশ্চর্যজনক তথ্য। যা আমাদের জানা দরকার।

Advertisement

আফগানিস্তানে সর্বমোট ২.২৬ ট্রিলিয়ন ডলার খরচের ভিত্তিতে আমেরিকানরা প্রতিদিন সেখানে ব্যয় করেছে ৩০০ মিলিয়ন ডলার। যে টাকা এসেছে আমেরিকান করদাতাদের কাছ থেকে। বৈশ্বিক মহামারি করোনার ভয়াবহ ছোবলে বিশ্বের শীর্ষ আক্রান্ত দেশ আমেরিকা নিজের দেশের সব নাগরিককে ভ্যাকসিন দিতে না পারলেও আফগানিস্তানে যুদ্ধের জন্য কাড়ি কাড়ি টাকা খরচ করেছে অকাতরে। এতো টাকা খরচের পরও আমেরিকা লজ্জাজনক ফলাফল নিয়ে ফিরে আসে আফগানিস্তান থেকে। তাহলে এতো টাকা কোথায় গেলো? কে নিলো? কার লাভ হয়েছে এতে?

নিশ্চিতভাবে একথা বলা যায়, আফগানিস্তানের জনগণ সে টাকার ভাগ পাননি। কারণ, দেশটির শতকরা ৯০ ভাগ মানুষ এখনও দিনে ২ ডলারের কম অর্থ দিয়ে জীবন-যাপন করেন। প্রকৃত ঘটনা হলো, বিরাট খরচের 'মোস্ট অব মানি' আমেরিকানদের হাতেই ফিরে এসেছে। কিভাবে? ডিফেন্স কোম্পানি ও কন্ট্রাক্টরদের মাধ্যমে। কারণ, আফগানিস্তানের যুদ্ধ ও পরিকাঠামোর সবকিছুই আমেরিকানরা করেছে 'আউট সোর্সিং'-এর মাধ্যমে, তাতে আমেরিকান কোম্পানিগুলোই ছিল সর্বেসর্বা। তারাই অস্ত্র, সরবরাহ করেছে, যানবাহন দিয়েছে, গোলাবারুদ সরবরাহ করেছে, বিমান দিয়েছে, আফগান সৈন্যদের প্রশিক্ষণ করিয়েছে। আর এসব মোটেও বিনামূল্যে করেনি।

বিশ্বের মিডিয়াগুলো আফগানিস্তানে আমেরিকার বিপুল খরচকে তুলনা করছে 'রিভলভিং ডোর'-এর সঙ্গে। একহাতে আমেরিকার সরকার ডলার দিয়েছে আর তা ফিরে গেছে আমেরিকার কয়েকটি কোম্পানির কাছে। তারাই সব খরচ করছে আমেরিকার নামে। তবে অবশ্যই বাণিজ্যিক মনোভাবে ও মুনাফার লক্ষ্যে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এমন পাঁচটি আমেরিকান কোম্পানি হলো লকহিড মার্টিন, বোয়িং, নর্থরোপ গ্রুম্ম্যান, রেথিওন ও জেনারেল ডায়নামিকস, যারা ২০০১ থেকে ২০২১ সময়কালে ২.০২ ট্রিলিয়ন ডলার নিয়েছে আফগানিস্তান, ইরাক, সিরিয়ায় পরিচালিত আমেরিকার হয়ে যুদ্ধের জন্য। সেসব যুদ্ধে প্রচুর আমেরিকান সৈন্য মারা গেছেন এবং আমেরিকান দৃশ্যমান জয়লাভ না করে বরং এক ধরনের পরাজয় বরণ করেছে। কিন্তু এতো রক্তের বিনিময়ে আমেরিকান কোম্পানিগুলো ঠিকই লাভবান হয়েছে।

২০০১ সালের সেপ্টেম্বরের পর 'সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ' পরিচালনার সময়ই প্রেসিডেন্ট বুশ বিভিন্ন কোম্পানির মাধ্যমে সামরিক তৎপরতা পরিচালনার আইনগত কাঠামো তৈরি করেন। আর তখনই বিভিন্ন কোম্পানি রাতারাতি প্রতিষ্ঠিত হয়, যারা হোয়াইট হাউস এবং পেন্টাগনের সঙ্গে মিলে যাবতীয় কার্যক্রম চালায় এবং বিপুল আর্থিক লেনদেন করে কোনও প্রশ্ন এবং পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়াই। ফলে এতো বিপুল বাজেটের আমেরিকান 'প্রজেক্ট আফগানিস্তান' ব্যর্থ হলেও এবং আফগান জনতা অনাহার, দারিদ্র্যের মধ্যে রক্তাক্ত ও উদ্বাস্তু হলেও যুদ্ধের ময়দান থেকে আমেরিকান কোম্পানিগুলো লালে লাল হয়েছে।

বৈশ্বিক অস্ত্রের বাজারে আমেরিকার কোম্পানিগুলোর একচ্ছত্র আধিপত্য চলছে এবং বিশ্বের শীর্ষ পাঁচ অস্ত্র কোম্পানিই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের। কোম্পানিগুলো হচ্ছে লকহিড মার্টিন, বোয়িং, নর্থরোপ গ্রুম্ম্যান, রেথিওন ও জেনারেল ডায়নামিকস। এই পাঁচ কোম্পানি গত বছর (২০২০) অস্ত্র ও সামরিক সরঞ্জাম বিক্রি করেছে ১৬৬ বিলিয়ন বা ১৬ হাজার ৬০০ ডলার, যা মোট অস্ত্র বিক্রির প্রায় ৪৬ শতাংশ। গত কুড়ি বছরে আফগানিস্তানে ২.২৬ ট্রিলিয়ন খরচের ক্ষেত্রেও সামনের কাতারে রয়েছে এসব আমেরিকান অস্ত্র বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান।

আমেরিকার অস্ত্র ব্যবসায়ী ও যুদ্ধ সংক্রান্ত প্রতিষ্ঠানগুলো মুনাফা লক্ষ্য করলেও তাদের বেশুমার লাভের বিষয়ে আঁচ করা যায়। দেখা যায়,, বিশ্বের বৃহত্তম ২৫টি কোম্পানি ৩৬১ বিলিয়ন বা ৩৬ হাজার ১০০ কোটি মার্কিন ডলারের অস্ত্র ও সামরিক সেবা বিক্রি করেছে, যার অধিকাংশই আমেরিকান, যা বাংলাদেশের ৩০ লাখ ৬৮ হাজার ৫০০ কোটি টাকার সমান। আমরা দেখছি, প্রতিবছরই বিশ্বে কমপক্ষে ৮ দশমিক ৫ শতাংশ হারে অস্ত্র বিক্রি বৃদ্ধি পেয়ে চলেছে। সুইডেনের স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউট (সিপ্রি) নিয়মিতভাবে এ সংক্রান্ত আপডেট প্রকাশ করে থাকে। যা কারো অজানা নয়।

‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’ কেটেছে ২০ বছর। যার কোনো রাজনৈতিক লক্ষ্য ছিল না। বিশ বছরে বিশ্ব মিডিয়াতে এ প্রশ্ন বার বার এসেছে। রাজনৈতির লক্ষ্য ছাড়া এই যুদ্ধের পরিণতি বা ফলাফল নিয়ে বিশেষঞ্জরা যেসব মন্তব্য করে এসেছেন শেষ পর্যন্ত তাই সত্য হয়েছে। ২০০১ সালের ৭ অক্টোবর আফগানিস্তানে যুদ্ধ শুরু করে যুক্তরাষ্ট্র। এর ঠিক দুই দশক পর যুদ্ধের ইতি টানলো তারা ২১ সালের সেপ্টেম্বরে। ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’ স্লোগান নিয়ে তৎকালীন রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ যে যুদ্ধ শুরু করেছিলেন, তার অবসান ঘটেছে ডেমোক্রেট প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের হাত দিয়ে। তবে দীর্ঘস্থায়ী এ যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর শুরু হয়েছে হিসাব কষার পালা। রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক হিসাব তো বটেই, যুক্ত হয়েছে এ যুদ্ধে কত প্রাণহানি ঘটেছে, যুক্তরাষ্ট্রকে কত খরচ করতে হয়েছে তার চুলচেরা বিশ্লেষণ।

হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটির কেনেডি স্কুলের লিন্ডা বিমস এবং ব্রাউন ইউনিভার্সিটির এক গবেষণা জানাচ্ছে, দুই দশকের যুদ্ধে প্রায় ৪৭ হাজার ২৪৫ জন বেসামরিক আফগান নিহত হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র হারিয়েছে ২ হাজার ৪৬১ জন সৈন্য। সেনাবাহিনী সংশ্লিষ্ট যুক্তরাষ্ট্রের বেসামরিক মানুষ নিহত হয়েছে ৩ হাজার ৮৪৬ জন।

অন্যদিকে ন্যাটোসহ আইএসএএফভুক্ত অন্যান্য দেশের সৈন্য নিহত হয়েছে ১ হাজার ১৪৪ জন। আফগানিস্তানের সৈন্য ও পুলিশ মিলিয়ে নিহত হয়েছে ৬৬ হাজার জন। তালেবানসহ আফগান বিভিন্ন সশস্ত্র দলের যোদ্ধা নিহত হয়েছে ৫১ হাজার ১৯১ জন। দাতব্য সংস্থার কর্মী নিহত হয়েছে ৪৪৪ জন এবং সাংবাদিক নিহত হয়েছে ৭২ জন।

২০ বছরে যুক্তরাষ্ট্রের ৮ লাখ সৈন্য আফগানিস্তানে যুদ্ধ করতে গিয়েছিল। তাদের মধ্যে ৬ হাজার সৈন্য আহত হয়েছে বলে দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে। অন্যদিকে যুদ্ধ ও সংঘাতের কারণে আফগানিস্তানে ঘর হারিয়েছে ৬০ লাখের মতো মানুষ। তবে ব্রাউন ইউনিভার্সিটির ‘কস্ট অব ওয়ার প্রজেক্ট’র তথ্যে বলা হয়, দুই দশকের এ যুদ্ধে ২ দশমিক ৩১ ট্রিলিয়ন ডলার খরচ হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের।

তবে যুদ্ধে যেসব সৈন্য আহত হয়েছে, তাদের চিকিৎসা ও সহায়তার জন্য আগামীতে যে ব্যয় যুক্তরাষ্ট্রকে করতে হবে, তা যোগ করলে এই সংখ্যা আরও বাড়বে। এছাড়াও যুদ্ধ চালাতে গিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের যে দেনা হয়েছে, তার সুদ ২০৫০ সাল অবধি টানতে হবে বলে গবেষণায় বলা হয়েছে। এতে যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধ ব্যয় ৮ ট্রিলিয়ন ডলারে গিয়ে ঠেকতে পারে।

লেখক : সাংবাদিক।

এইচআর/এমএস