মতামত

করোনায় নিঃস্ব মানুষের বোবা কান্না কে শুনবে?

প্রফেসর ড. মো. ফখরুল ইসলাম

Advertisement

বেসরকারি স্কুলের একটি দরজা খোলা। কিছুক্ষণ পর পর সব বয়সী কিছু মানুষ ঢুকছে আর বের হচ্ছে হাতে কিছু নিয়ে। আসলে সেখানে এখন শিক্ষা দেয়া হয় না। করোনার জন্য প্রাইভেট পড়ানো বন্ধ রয়েছে। তবে নিরুপায় হয়ে কিছু নিত্যপণ্যসামগ্রী কিনে মুদি দোকান খুলে বসে আছেন একজন শিক্ষক। স্কুলের ঘর, বারান্দা, সাইনবোর্ড, মিনা-রাজু-মিঠুর-কার্টুনবোর্ড, স্কুলের ফোন নম্বর সবকিছুই জানান দিচ্ছে সেটা একটা শিক্ষালয়। লেখাপড়া করার জায়গা। বিদ্যাদান ও বিদ্যাগ্রহণ করাই সেই ঘর ও লোকগুলোর আসল কাজ। গত দু’বছরে বারান্দায় ঘাস গজিয়ে বড় হয়েছে। টিনের চালের ফাঁকে শালিক, চড়ুইরা বাসা বেঁধেছে। সাইনবোর্ডটিতে পাখির বিষ্ঠা ও মরিচা ধরেছে। অযত্নে-অবহেলায় শিক্ষায়তনটির একটি কক্ষে এখন দোকান ঘর। বাকি ঘরগুলোর বেড়া খসে পড়ে যাচ্ছে। গেল কালবৈশাখী ঝড়ে একটি বেড়া খুলে গেলেও কেই সেটা মেরামতে এগিয়ে আসেনি।

বিদ্যালয়টির একটি ভাল ইংরেজি নাম আছে। সেটা লিখলাম না, ওরা কষ্ট পাবে বলে। এর কয়েকজন মালিকও রয়েছেন। সবাই আশেপাশের পাড়া-মহল্লায় থাকেন। নামডাক থাকায় শিক্ষার্থী বেড়ে গিয়েছিল। তাই ভাল রেজাল্টধারী ইংরেজি-অংক জানা শিক্ষকদের নিয়োগ দেয়া হয়েছিল। তারা নিয়মিত বেতন পেতেন। কেউ কেউ স্কুলের আশেপাশেই বাসা বাড়া নিয়ে থাকতেন। করোনা শুরু হবার পর হঠাৎ করেই ইংরেজি মাধ্যমের স্কুলটি বন্ধ হয়ে গেল। শিক্ষার্থীরা আর আসে না। শিক্ষকগণ তারপরও কমিটির নিকট থেকে দু’মাস বেতন পেয়েছিলেন। এরপর নিরুপায় হলো সবকিছু। মালিকের একজন হাতজোড় করে বলে দিলেন, আর কোন উপায় নেই। বাঁচতে হলে মালামাল কিনে এক কোণায় দোকান দিয়ে বসেন। তাহলে নিজেরাও খেতে পারবেন। সেই যে শুরু হলো-আর শেষ নেই অপেক্ষার। একবারেই বেতন বন্ধ হয়ে গেল। ভাল শিক্ষকরা এলাকা ছেড়ে অন্যত্র চলে গেলেন। তাঁদেরকে আর আটকানো গেল না। ওনাদের এই প্রতিষ্ঠানের এমপিওভুক্তি হবার নিয়ম নেই। ওনারা সরকারি অর্থের অংশ বেতন-ভাতা কিছুই পান না। কলেজ- বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া অনেক ভাল ছাত্র এখানে পার্টটাইমার হিসেবে কাজ করতে আসে। তাদেরও আয় বন্ধ। এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তিরা আর অর্থ সাহায্য করেন না।

অন্যদিকে এতিমখানা, হাফেজি মাদ্রাসা থেকে শিশুদেরকে সাহায্য লাভের আশায় বাড়ি বাড়ি পাঠানো হচ্ছে। ২০২০ সালে করোনা সংক্রমণের শুরুতে হঠাৎ এই প্রবণতা অনেক বেশি লক্ষ্যণীয় হয়ে ওঠে। শিশুরা বাড়ির মালিকদেরকে কনভিন্স করতে না পারায় যথেষ্ট পরিমাণ সাহায্য পেতে অপারগ হয়। এরপর ২০২১ সালে প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক ও কর্তাব্যক্তিরা নেমে পড়েন সাহায্য সংগ্রহের আশায়। তাঁরা প্রতিষ্ঠানের স্লিপ ছাপিয়ে দলে দলে বিভক্ত হয়ে এলাকায় ঘুরে সাহায্য সংগ্রহ করতে থাকেন। প্রথমদিকে তাঁদের আবদার ছিল- বেসরকারি এতিমখানার শিশুদের খাবার নেই। এক বস্তা চাল কেনার টাকা সাদকা দেন। আপনার মঙ্গল হবে। এখন দানশীল মানুষ সেটাও দিতে পারছেন না। একই অবস্থা বেসরকারি মক্তব, মাদ্রাসা ও হেফজখানাগুলোতেও। শিক্ষককদের বেতন বন্ধ, বাচ্চাদের খাবারের সংকট। তাই ওনারা পথে নেমেছেন বলে জানালেন একজন সম্মানিত হাফেজ শিক্ষক।

Advertisement

শহরের বাসাগুলোতে সদর দরজায় তালা ঝুলিয়ে দেয়া হয়েছে। সাহায্যপ্রার্থী ও ভিক্ষুকদের মাধ্যমে করোনা সংক্রমণ ছড়ানোর ভয়ে ফ্লাট বাড়িগুলোতে মেইন গেটে দারোয়ানকে তালা লাগিয়ে দিতে বলা হয়েছে। বিশেষ করে ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি-মার্চে ভারতে করোনার প্রবল আক্রমণ শুরু হওয়ার সাথে সাথে সে সকল প্রচারণা টিভিতে দেখামাত্র আমাদের দেশে মানুষ ব্যাপক সতর্কতা অবলম্বন করেছে। আমাদের দেশে করোনার প্রথম সতর্কতার আঘাত লেগেছে ভিক্ষুকদের মাথায় ও মনে। ভিক্ষা পেতে গিয়ে তারা মানুষের দরজা বন্ধ দেখতে পাচ্ছে। এবারের রমজান মাসেও বাড়ির দরজায় তালা লাগানো থাকায় দরিদ্র মানুষ যাকাতের অর্থ সংগ্রহ করার জন্য যাকাত দাতাদের সামনে আসতে পারেনি। অপরদিকে দানবীর অনেকেই করোনার ভয়ে মসজিদে নামাজ পড়তে যাওয়া বন্ধ করে দেয়ায় মসজিদে ফেতরা বা যাকাতের অর্থ দিতে পারেননি। সেখানেও দুস্থ-এতিমরা বঞ্চিত হয়েছে।

আমাদের নিজেদের কোরবানি ঈদের চামড়া এবারেও বিক্রি হয়নি। বিনে পয়সায় কসাইদেরকে দেয়া হয়েছে। তারাও নাকি বিক্রি করতে পারেনি। শুধু ঢাকার বড় আড়তে যারা স্বল্পদামে চামড়া কিনে লবণ লাগিয়ে সংরক্ষণ করেছিল তাদের নাকি পোয়াবারো হয়েছে। পরবর্তীতে চামড়ার দাম রাড়িয়ে বড় ব্যবসায়ীরাই লাভবান হয়েছেন। দরিদ্র, দুস্থ, এতিম মিসকিনরা এবারেও কোরবানীর চামড়ার অর্থ থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। ফলে ফেতরা, চামড়া বিক্রির টাকা, যাকাত ইত্যাদির উপর নির্ভরশীল দরিদ্র মানুষের শিক্ষা ব্যবস্থা ধুলায় মিশে গেছে এবছরও। তাদের উপর নির্ভরশীল পরিবারগুলো নিজেদের প্রয়োজনীয় শখের জিনিস বিক্রি করে অর্ধাহারে অনাহারে খেয়ে না খেয়ে কোন রকমে দিন পার করে চলেছেন। আমার পরিচিত একজন নিজের খুব দরকারি পুরনো মোটর সাইকেলটি বিক্রি করে সন্তানদের জন্য ভাতের চাল ও আলু কিনেছেন।

তাদের আয়ের আর কোন সংস্থান না থাকায় কেউ সবজি বিক্রি করছেন ভ্যানে করে, কেউ গালামালের দোকান খুলে বসেছেন স্কুলের কোণায়, কারো সন্তান রাস্তায় পানির বোতল বিক্রি করতে নেমে গেছে। বাসা-বাড়িতে কাজ করার প্রবেশাধিকার নেই। শ্রম বিক্রি করতে না পেরে অনেক মধ্যবিত্ত ঘরের লোকজন লজ্জায় কাউকে কিছু না বলে ঘরে বসে শুয়ে শুয়ে কাঁদছেন। সেদিন এক কিন্ডাগার্টেনের কোণায় নিজের দোকানে বসে কেমন আছেন এই প্রশ্ন জিজ্ঞেস করতেই হাউমাউ করে কেঁদে দিলেন সে প্রতিষ্ঠানের একজন শিক্ষক।

তাঁর কান্না শুনে প্রশ্নকর্তা চরম বিব্রত হয়েছেন। লকডাউনের মধ্যেও সরকারি প্রতিষ্ঠানের সবাই বাড়িতে বসে বসে বেতন পাচ্ছেন। যাদের স্থায়ী আয় নেই বা ভাসমান জীবন, তাদের মরণ দশা। রিমোট এলাকায় এসব ঘটনার কেন্দ্রবিন্দু হওয়ায় দেশের গণমাধ্যমে সেচিত্র ঠিকভাবে আসে না। বেশিরভাগ গণমাধ্যমের ক্যামেরা দৌড়ায় রাজনৈতিক নেতাদের পিছনে। সমাজের এসব মানুষ নিজেদের দারিদ্র্যকে লজ্জা ভেবে অনেকে সেটা কারো কাছে প্রকাশ করতে চান না। নিম্নমধ্যবিত্ত ও কর্মহারা শক্তিশালী চেহারার মানুষগুলোর এই বিড়ম্বনা আমাদের সমাজে করোনাকালের চরম নির্মম পরিহাস!

Advertisement

এরা রাস্তার ভিক্ষুক নন। এরা ভদ্র শিক্ষক, মর্যাদাবান মানুষ। অতিমারির মরণ কামড় এদেরকে বানিয়েছে ‘করোনা রিফুজি’। এরা কারো কাছে কোন দান নিতে চান না, সাহায্য নেবার জন্য হাত বাড়াতে লজ্জা পান। এরা কোন রিলিফ কেন্দ্রে গিয়ে লাইনে দাঁড়িয়ে সাহায্য পেতে অনীহা। এসকল লজ্জাবণত ও মরণাপন্ন মানুষের বাড়ি বাড়ি যাবে কে? এসময় এমন নাজুক অবস্থায় স্থানীয় দানশীল ব্যক্তি, এনজিও ও স্থানীয় নেতৃত্বের দায়িত্বটাই এদেরকে বাঁচানোর জন্য বড় বেশি প্রয়োজন।

একদিকে ডেঙ্গুর সংক্রমণ এখন রাজধানী পেরিয়ে গণপরিবহন চলাচলের সুবাদে সারা দেশে ভয়ংকর থাবা মেলে ধরছে। এডিসের ডেনভি-৩ এর দাপটে দেশের মানুষ আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে দিনাতিপাত করছে। সামনের দিনগুলোতে ডেঙ্গুর আতঙ্কে শিশুরা হয়তো স্কুলে আসা বন্ধ করে দিতে পারে। অন্যদিকে, বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন, করোনা এক-দু বছর নয়- এক-দু’যুগ স্থায়ী হতে পারে।

যেসব টিকা দেয়া হচ্ছে সেসব টিকার কার্যকারিতার মেয়াদ বা অ্যান্টিবডি মানব শরীরে কতদিন থাকবে সেটাও আমরা জানি না। তাই করোনার নিত্যনতুন ভেরিয়েন্ট মোকাবেলার জন্য সামনের দিনেগুলোতে আরো দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা নেয়া প্রয়োজন। কারণ, করোনার বজ্রকঠিন প্রভাব সামলাতে পৃথিবীর তাবৎ মানুষকে এখনও অনেক বড় ত্যাগ স্বীকার করতে হবে।

লেখক : রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডীন, সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সাবেক চেয়ারম্যান। fakrul@ru.ac.bd

এইচআর/এমএস