ফারাজী আজমল হোসেন
Advertisement
পাকিস্তান সামরিক বাহিনী চীনে তৈরি মনুষ্যবিহীন কয়েকটি ড্রোন চালু করার কয়েকদিনের মধ্যে একাধিক মারাত্মক ত্রুটিজনিত কারণে সেগুলো মাটিতে মুখ থুবড়ে পড়েছে। এতে দেশটির সামরিক শক্তি যথেষ্ট খর্ব হয়েছে। চীনের চেংদু এয়ারক্রাফ্ট গ্রুপের তৈরি এবং চায়না ন্যশানাল এ্যরো-টেকনোলজি ইমপোর্ট এন্ড এক্সপোর্ট কোম্পানি (সিএটিআইসি)’র সরবরাহ করা সামরিক অস্ত্রে সুসজ্জিত তিনটি ড্রোন ২০২১ সালের জানুয়ারিতে পাকিস্তান বিমান বাহিনীতে অভিষিক্ত হয়। পাকিস্তান ও চীনের মধ্যে একটি বৃহৎ চুক্তির আওতায় মনুষ্যবিহীন এসব যুদ্ধ বিমান (ড্রোন) তৈরি করা হয় এবং এ ধরণের ৫০টি ড্রোন পাকিস্তানে যৌথভাবে তৈরি করার কথা রয়েছে।
পাকিস্তান এবং চীন উভয় দেশের সামরিক কর্মকর্তারা এতদিন এই ভেবে উল্লসিত ছিলেন যে এসব সশস্ত্র ড্রোন লেজার-নির্দেশিত বোমা বর্ষণ এবং ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করে ভূমি বা আকাশে যে কোন লক্ষবস্তু ধ্বংস করতে সক্ষম। তাদের মূল লক্ষ্য হচ্ছে অতি উঁচু স্থানের ভারতীয় সামরিক স্থাপনাগুলো গুঁড়িয়ে দেয়া। কিন্তু বিধি বাম, দেশের কোটি কোটি মানুষকে অভুক্ত রেখে শত শত কোটি ডলার ব্যয় করে তারা যে সামরিক সজ্জা করেছিল তা এখন দুঃস্বপ্নে পরিণত হয়েছে। মারাত্মক ত্রুটিজনিত কারণে মুখ থুবড়ে পড়া এসব ড্রোনের কারণে পাকিস্তানের বিমান বাহিনীর কর্মকর্তাদের আজ বিড়ম্বনার শেষ নেই।
সামরিক শক্তি বৃদ্ধির বদলে চীনা প্রতিষ্ঠানের বিবর্ণ পরিষেবা এবং ভঙ্গুর রক্ষণাবেক্ষণ ব্যবস্থা পাকিস্তানের বিমান বাহিনীর দুর্দশা কয়েকগুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। অপরদিকে অকেজো ড্রোনগুলো মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য পাকিস্তানের বিমান বাহিনীর উপর্যুপরি আকুতির প্রতি সিএটিআইসি’র কোন ভ্রুক্ষেপ নেই। এছাড়া বিক্রেতা প্রতিষ্ঠানের পাঠানো খুচরা যন্ত্রাংশ খুবই নিন্মমানের এবং অধিকাংশ ব্যবহার অনুপযোগী।
Advertisement
কে শোনে কার কথা, চীনা জিনিস বলে কথা। একবার উড়লেই তাদের দায়িত্ব শেষ। দ্বিতীয়বার না উড়লে তার দায়িত্ব তাদের নয়। পাকিস্তান বিমান বাহিনীর আহাজারি শোনার সময় তাদের নেই। বিড়ম্বনার এখনেই শেষ নয়, উদ্বোধনের পর পরই অচল হয়ে পড়া এসব ড্রোন দ্রুত মেরামতের জন্য যেসব প্রকৌশলীকে চীন থেকে পাঠানো হয়েছিল তারা অপটু ও নবিশ সাব্যস্ত হয়েছে। এরপর থেকে পাকিস্তানী সামরিক কর্মকর্তারা এই মহা-সংকট কাটিয়ে উঠতে অধিকতর অভিজ্ঞ পেশাজীবী ও পারদর্শীদের পাঠানোর জন্য চীনা প্রতিষ্ঠানের কাছে বার বার মিনতি জানাচ্ছে।
ড্রোনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ হচ্ছে- জিপিএস। পাকিস্তানে বিক্রি করা চীনা ড্রোনগুলোর এই জিপিএস ব্যবস্থায়ই ত্রুটিপূর্ণ। জিপিএস ড্রোনের এমন একটি অঙ্গ যাকে মানুষের হৃদপিণ্ডের সঙ্গে তুলনা করা হয়।
তিনটি ড্রোনের দুটিরই জিপিএস পরীক্ষামূলক উড্ডয়নের সময় বারবার বন্ধ হয়ে যায় এবং ভূমিতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়। জিপিএস এমন একটি যন্ত্র যা বন্ধ হলে গোটা ড্রোনই অকার্যকর হয়ে পড়ে। এখন পাকিস্তানী সামরিক কর্মকর্তারা জানতে চান কোনো ধরনের স্থানীয় হস্তক্ষেপের কারণে জিপিএস বন্ধ হচ্ছে কি-না। সে ক্ষেত্রে ড্রোনের জ্যামিং বিরোধী ক্ষমতা লোপ পাবে এবং অভিযানকালে এসব ড্রোন শত্রুপক্ষের সহজ লক্ষবস্তুতে পরিণত হবে।
অনুরূপ ত্রুটি ধরা পড়েছে ড্রোনে স্থাপিত ইও/আইআর ক্যামেরায়। এখান থেকে নাইট্রোজেন নিঃসৃত হচ্ছে। এর ফলে ড্রোনের ইলেক্ট্রো-অপটিক্যাল/ইনফ্রা-রেড (ইও/আইআর) সিস্টেম পুরোপুরি ব্যবহার অনপোযোগী হয়ে পড়েছে। চিত্রধারণের এই ব্যবস্থা দিন ও রাতে এবং কম আলোয় পরিস্থিতিগত সচেতনতা সৃষ্টিতে কার্যকর ভূমিকা রাখে। এই পরিস্থিতিতে পাকিস্তান বিমান বাহিনী জরুরিভিত্তিতে এসব খুচরা যন্ত্র প্রতিস্থাপনে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। কিন্তু চীনের বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান এ ব্যাপারেও কোন সাড়া-শব্দ দিচ্ছে না।
Advertisement
ড্রোন চালু করার কয়েক ঘন্টার মধ্যে উচ্চ মাত্রার সংবেদনশীল ‘সিনথেটিক অ্যাপারেচার র্যাডারে’ও মারাত্মক ত্রুটি ধরা পড়েছে। এসব র্যাডার ড্রোনে স্থাপিত বৈদ্যুতিন যুদ্ধাস্ত্রকে প্রয়োজনীয় সহায়তাদানের পাশাপাশি আবহাওয়াজনিত সকল অবস্থায় অত্যাধুনিক ভূ -স্থানিক বুদ্ধিমত্তা প্রদান করে থাকে। ত্রুটিপূর্ণ র্যাডার মনুষ্যবিহীন এসব ড্রোনকে অন্ধ, দিশেহারা এবং কার্যক্ষমের অনুপযুক্ত যুদ্ধাস্ত্রে পরিণত করেছে। এসব ড্রোনের আরও একটি ত্রুটি ধরা পড়েছে উৎক্ষেপণ ও উড্ডয়নের সময় মহাকাশে যোগাযোগ (স্যাটকম) ব্যবস্থায়। ভূমিতে থাকা অবস্থায় স্থান নির্ধারণ পরীক্ষার (স্যাট) সময় ‘স্যাটকম’ এন্টিনা অকার্যকর প্রমাণিত হয়েছে।
অপর ত্রুটিগুলোর মধ্যে রয়েছে ড্রোনের জ্বালানি পাম্পের অকার্যকারিতা। মজার ব্যাপার হচ্ছে চীনের বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান ড্রোনের সঙ্গে যেসব খুচরা যন্ত্রাংশ পাঠিয়েছে সেগুলোও অসামঞ্জশ্যপূর্ণ। অনুরূপভাবে ড্রোনের সঙ্গে পাঠানো জ্বালানি নিঃসরণের সরঞ্জামগুলোও যথাযথভাবে তৈরি না করায় ব্যবহার অনুপযোগী বলে বিবেচিত হয়েছে। পাকিস্তানের বিমান বাহিনী এসব সরঞ্জামও প্রতিস্থাপনের অপেক্ষায় রয়েছে।
চীনের সামরিক অস্ত্রের অবিশ্বস্ততা এবং ঠুনকো ও নিন্মমানের পরিষেবা ও রক্ষাণাবেক্ষণ ব্যবস্থা সম্পর্কে এটাই পকিস্তান সামরিক বাহিনীর প্রথম অভিজ্ঞতা নয়। প্রধান দুটি সমরাস্ত্র- যুদ্ধ বিমান ও সশস্ত্র ড্রোনসহ চীন থেকে নিন্মমানের যুদ্ধাস্ত্র আমদানি করে তা চলনসই করতে পাকিস্তান বিমান বাহিনী প্রতিনিয়ত হিমশিম খাচ্ছে।
লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক ও কলামিস্ট।
এইচআর/এএসএম