ফুল ছাড়া বিয়ে-অনুষ্ঠান, সভা-সমাবেশের মঞ্চ-টেবিল থাকে শূন্য-রিক্ত বা কল্পনাতীত। তাই সৌন্দর্য বর্ধনে গোলাপ, গাঁদা, রজনীগন্ধাসহ নামি-দাবি সব ফুলে সাজানো থাকে অতিথিদের আসন। আর এসব ফুলের চাহিদা মেটাতেন ফুল চাষিরা। দুই বছর আগেও মাঠের পর মাঠ ভরা ছিল ফুল ক্ষেতে। তাকালেই চোখ জুড়িয়ে যেত। কিন্তু এসব ফুলের ক্ষেতে এখন চাষ হচ্ছে মরিচ, লাউ, পটলসহ অন্যান্য সবজী।
Advertisement
মহামারি করোনায় ঘন ঘন লকডাউন, সামাজিক, রাজনৈতিক অনুষ্ঠান বন্ধ থাকায় বিক্রি করতে না পারায় ক্ষেতেই নষ্ট হয় ফুল। এতে চরম লোকসানে পড়েন চাষিরা। এই করুণ দৃশ্য দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম ফুল উৎপাদনকারী এলাকা ঝিনাইদহের।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর থেকে জানা গেছে, করোনা পরিস্থিতি সৃষ্টির আগে ঝিনাইদহ জেলায় ফুলের আবাদ ছিল ২৪৫ হেক্টর জমিতে। গেল দুই বছরে ধাপে ধাপে আবাদ কমে দাঁড়িয়েছে ৮০ হেক্টরে। আর বর্তমানে প্রতি ঝোপ গাঁদা ফুল ৮০ থেকে ১৩০ টাকা, গোলাপ প্রতি পিচ ৩ টাকা, জারবেরা ৮ টাকা এবং রজনীগন্ধা প্রতি পিচ ৯ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে।
ফুল চাষিরা জানান, করোনার কারণে অনেক ফুলক্ষেত নষ্ট করে দিয়েছি। করোনার প্রভাব কেটে গেলে নতুন করে ফুল চাষ শুরু করব। তবে যাদের কিছুটা ফুলক্ষেত টিকে আছে তারাও ক্ষতি পুষিয়ে নিতে পরিচর্যায় ব্যস্ত রয়েছেন।
Advertisement
কোটচাঁদপুর ইকড়া গ্রামের আব্দুল হান্নান তিনি জানান, ফুল বিক্রি কমে যাওয়ায় গ্রামের অনেক কৃষক তাদের জমিতে ফুলের বদলে ধান, পাটসহ অন্যান্য ফসল আবাদ করছেন। আগে ফুল চাষ করে মাসে কয়েক লাখ টাকা আয় করতেন। এখন আয় একেবারেই শূন্য।
তিনি আক্ষেপ করে বলেন, চার বিঘা জমিতে তার গাঁদাফুল ছিল। বিঘাপ্রতি প্রায় তিন লাখ টাকার ফুল বিক্রি হওয়ার কথা। কিন্তু করোনার কারণে বিক্রি না হওয়ায় খেতে ফুল নষ্ট হচ্ছিল। কোনো উপায় বের করতে না পেরে এখন জমিতে সবজির আবাদ শুরু করেছি।
ঝিনাইদহ সদর উপজেলার গান্না গ্রামের গোলাপ ফুলচাষি আদম আলী জানান, দুই বিঘা জমিতে চায়না গোলাপের চাষ ছিল আমার। করোনার আগে মাসে এক লাখ থেকে শুরু করে দুই লাখ টাকা পর্যন্ত ফুল বিক্রি করতাম। করোনার কারণে এক টাকার ফুলও বিক্রি করতে পারিনি।
তিনি আরও জানান, আত্মীয়-স্বজনের কাছ থেকে টাকা ধার করে চলছি। কখনো কারও কাছে টাকার জন্য হাত পাতিনি। এবার তা-ই করতে হয়েছে আমার। যার কারণে বাগান কেটে অন্য আবাদ শুরু করেছি এ বছর।
Advertisement
ফুলচাষি ও ব্যবসায়ী কামাল উদ্দীন এবার ফুলের বদলে তার এক বিঘা জমিতে ধান চাষ করেছেন। এ বিষয়ে তিনি বলেন, করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে অনেকেই ফুলের ব্যবসা ছেড়ে দিয়েছে। বাইরের ব্যাপারীরাও এখন তেমন আসে না, চাহিদার তুলনায় ফুলের সরবরাহ একেবারেই কম।
তিনি আরও বলেন, আমার এক বিঘা জমিতে গাঁদা ফুলের চাষ ছিল। এখান সেই জমিতে ধান লাগিয়েছি। সব জিনিসের দাম বেশি। সংসারে খরচ বেড়েছে। সব মিলিয়ে খুবই করুণ অবস্থা।
গাঁদা ফুলের মালা তৈরি করতেন মাজেদা খাতুন। কেমন আছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, একদম ভালো নেই। খুব দুশ্চিন্তা হয়। রাতে ভালো ঘুম হয় না। আগে ক্ষেত থেকে ফুল তুলে বাড়িতে আনা হতো। আমরা বাড়ির সবাই মিলে ফুল বাছাই করতাম। এরপর মালা তৈরি করে ঝুড়িতে সাজিয়ে দিতাম। এখন খেতে ফুল নেই। বাড়িতেও আর ফুল আসে না। আমাদের আর বাড়তি আয়ও হয় না এখন।
ঝিনাইদহ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক, আজগর আলী জানান, ঝিনাইদহ জেলায় ফুলের চাষ কমলেও সামনের মৌসুমে যাতে আবাদটি আবার আগের মতো হয় সেজন্য চাষিদের নানা পরামর্শসহ অন্যান্য সহযোগিতা করা হচ্ছে।
তবে শঙ্কা প্রকাশ করে তিনি জানান, আবার যদি দেশে করোনা মহামারি প্রকট আকার ধারণ করে তাহলে একেবারেই ফুলের আবাদ কমে যাবে।
এমআরএম/এএসএম