সম্প্রতি চাকরি নিয়ে এক গবেষণায় চমকে দিয়েছে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস)। প্রতিষ্ঠানটির জরিপ অনুযায়ী, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করা শিক্ষার্থীদের ৬৬ শতাংশই বেকার। অথচ দুই বছর আগে বিশ্বব্যাংকের গবেষণায় জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করা শিক্ষার্থীদের মধ্যে বেকার ছিল ৪৬ শতাংশ। আর ৪৭ শতাংশ বেকার ছিল বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সবশেষ জরিপে।
Advertisement
এসব জরিপের সংখ্যাতাত্ত্বিক ফলাফল নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া বা পক্ষ-বিপক্ষ মত থাকলেও শিক্ষিত বেকার বাড়ছে, এমনটি যে কোনো বিশ্লেষকই মনে করছেন। দেশের অন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে বেরিয়েও চাকরির জন্য হাহাকার করছে তরুণরা। বছরের পর বছর অপেক্ষা করেও অধরা থেকে যাচ্ছে চাকরি নামের সোনার হরিণ।
কেন শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা বাড়ছে, এই সঙ্কট থেকে উত্তরণের উপায়ই বা কী- এমন প্রশ্নের উত্তর খুঁজতেই জাগো নিউজের পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা অর্থনীতিবিদ ড. এবিএম মির্জা আজিজুল ইসলাম, ব্র্যাকের চেয়ারম্যান ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক শিক্ষা উপদেষ্টা ড. হোসেন জিল্লুর রহমান এবং জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মসিউর রহমানের সঙ্গে।
ড. এবিএম মির্জা আজিজুল ইসলাম তার প্রতিক্রিয়ায় বলেন, উপযুক্ত চাকরির জন্য নিজেকে যোগ্য হিসেবে প্রমাণ করা সহজ বিষয় নয়। যোগ্যতার অভাব এক ধরনের বেকারত্ব তৈরি করছে। অন্যদিকে বিনিয়োগ নেই। বিনিয়োগ না থাকলে কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হয় না। কাজ না থাকলে চাকরি মিলবে কী করে? জিডিপির আনুপাতিক হারে বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ আরও কমেছে। গতবছর এই বিনিয়োগের হার আরও নিম্নমুখী।
Advertisement
‘বেকার না থেকে নিজে উদ্যোগ নেওয়া জরুরি। চাকরির পেছনে ছুটে সময় নষ্ট করার পক্ষে আমি না। বিকল্প উপায় নিজেকেই বের করতে হবে। যদিও তার জন্য সঠিক পরিবেশ দরকার হয়।’
একই সঙ্গে আমি মনে করি, মানসম্মত শিক্ষার বিস্তার ঘটাতে হবে। শিক্ষার মান না থাকলে বেকারের সংখ্যা আরও বাড়বে। মূলত যারা চাকরি দিচ্ছেন বা কাজের সুযোগ দিচ্ছেন, তারা কী ধরনের অভিজ্ঞতা বা যোগ্যতা চান, তার সঙ্গে সমন্বয় করতে হবে।’ বলেন এই বিশ্লেষক।
ড. হোসেন জিল্লুর তার মতামত জানিয়ে বলেন, এই জরিপের ফলাফল বড় ধরনের সঙ্কটবার্তা দিচ্ছে বলে মনে করি। এটি নিয়ে বিস্তর আলোচনা হওয়া উচিত। বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থায় সামগ্রিক সঙ্কট যে বিরাজমান তার প্রমাণ মিলছে এই পরিসংখ্যানে।
‘শিক্ষার মাধ্যমে কার্যকর যোগ্যতা তৈরি হচ্ছে কি না, তা উঠে এসেছে এসব গবেষণা জরিপে। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ৬৬ শতাংশ শিক্ষার্থী বেকার! আবার বাংলাদেশে এসে পাশের দেশের কয়েক লাখ লোক কাজ করছেন। ভালো ভালো চাকরির জায়গা দখল করে আছেন। এই তুলনামূলক পরিসংখ্যান মুখোমুখি অবস্থানে দাঁড় করিয়ে বিশ্লেষণ করা দরকার। আবার সরকার জিডিপি, উন্নয়নের পরিসংখ্যানও তুলে ধরছে। অন্যদিকে বেকারের সংখ্যাও বাড়ছে।’
Advertisement
তাহলে অসঙ্গতি ঠিক কোথায়? এই বিশ্লেষক মনে করেন, ‘যেভাবে শিক্ষাটাকে চালিয়ে নেওয়া হচ্ছে, তা দিয়ে আসল যোগ্যতাটা তৈরি করা যাচ্ছে না। এই সঙ্কটের মূল উত্তর মিলছে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের আজকের পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে।’
‘রাজনৈতিকভাবে এক ধরনের শিক্ষা দর্শনের মধ্যে বাংলাদেশকে প্রবেশ করানো হয়েছে বটে। কিন্ত শিক্ষামাত্রিক বিস্তার না ঘটে এখানে প্রতিষ্ঠানের বিস্তার ঘটেছে। সরকার পারলে গ্রামে গ্রামে বিশ্ববিদ্যালয় বানাতে চাইছে। ভবনের পর ভবন বানাচ্ছে। অথচ শিক্ষার মান নিয়ে কোনো উদ্যোগ নেই। ভবন নির্মাণ করলেই শিক্ষার মান বাড়ে না, ৬৬ শতাংশ বেকার তার প্রমাণ!
যারা নীতিনির্ধারক, তাদের কাছে গুরুত্বই পাচ্ছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বিস্তার। শিক্ষার মানের বিষয়ে আসলে আগ্রহী ব্যক্তির উপস্থিতি নেই।’
উত্তরণের উপায় কী? জবাবে হোসেন জিল্লুর বলেন, শিক্ষাব্যবস্থায় সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে না পারলে কোনো কিছুই সম্ভব না। শিক্ষার তো পরিবেশ দরকার। শিক্ষার পরিবেশ প্রায় উবে গেছে। যারা দায়িত্বে আছেন, তারা একের পর এক প্রকল্প নিয়ে আলোচনা করছেন। তারা গবেষণা, মানসম্মত শিক্ষা নিয়ে আলোচনা করেন না। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর প্রধান হন ভারপ্রাপ্ত না হয় রাজনৈতিকভাবে দায়িত্বপ্রাপ্ত। এখানেই তো সুশাসনের ঘাটতি তৈরি হচ্ছে। সব কিছুর উপর রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে বলেই সার্বিকভাবে দ্বিমুখী বাস্তবতা তৈরি হয়েছে। মানে শিক্ষা বাড়ছে কিন্তু তা সবখানেই নিম্নমানের।
‘চাকরির বাজারে দুই ধরনের সঙ্কট দেখা যাচ্ছে। উচ্চশিক্ষিত হাজার হাজার তরুণ চাকরি পাচ্ছে না। অন্যদিকে যারা চাকরি দেবেন, তারা যোগ্যদের খুঁজে পাচ্ছেন না। একদিকে যোগ্য লোকের দুর্ভিক্ষ, অন্যদিকে শিক্ষিত তরুণদের এই তরুণরা দেশের বাইরে গিয়ে অবশ্যই ভালো করছে। তার মানে আমাদের এখানে পরিবেশগত প্রণোদনার অভাব। এই বাস্তবতা না বুঝলে উত্তরণ সম্ভব না।’
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মসিউর রহমান অবশ্য বিআইডিএস-এর গবেষণা জরিপের ফলাফল নিয়ে দ্বিমত পোষণ করেন। তিনি বলেন, প্রথমত, বিআইডিএস যে পদ্ধতিতে গবেষণা করেছে তা নিয়ে যথেষ্ট ত্রুটি আছে। কারণ টেলিফোনে সাধারণত এমন গবেষণা গ্রহণযোগ্যতা পায় না। দ্বিতীয়ত, তারা জরিপে অংশগ্রহণকারীর দেওয়া তথ্য ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে থাকা তথ্যের সঙ্গে ক্রসচেকিং করেনি বলে আমার বিশ্বাস।
‘তবে আমি দাবি করছি না যে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় বা এর পরিবারের সদস্যরা কাঙ্ক্ষিত জায়গায় পৌঁছাতে পেরেছে। এখানকার শিক্ষার্থীরা যে ধরনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে অথবা রাষ্ট্র, সমাজ, পরিবার যে ধরনের বিনিয়োগ করে সেটাকেও আমলে আনতে হবে। এখানে পড়তেই আসেন সাধারণ নিম্ন-নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তানেরা। পাবলিক বা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা রাষ্ট্র বা পরিবারের পক্ষ থেকে যে সুবিধা পায়, তা এখানকার শিক্ষার্থীরা পায় না।’
রাষ্ট্র এখানে বিমাতাসুলভ আচরণ করছে কি না? এর জবাবে উপাচার্য বলেন, আমি ঠিক তা বলছি না। বাস্তবতা হচ্ছে অপেক্ষাকৃত ভালো পরিবারের সন্তানরা এখানে আসছেন না। একেবারেই জীবনের কষাঘাতে থাকা পরিবারের সদস্যরা এখানে পড়তে আসেন।
‘তবে আমি মনে করি, চাকরি বা অর্থনৈতিকভাবে সচ্ছল না হলেও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা নৈতিকভাবে অন্য প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের চেয়ে এগিয়ে। আপনি যদি দুর্নীতি, লুটপাট নিয়ে গবেষণা করেন, দেখবেন সেখানে কারা এগিয়ে। তার মানে পাবলিক বা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নৈতিকতার সঠিক শিক্ষা আমরা দিতে পারছি না।’
তিনি বলেন, উচ্চশিক্ষার একমাত্র লক্ষ্য চাকরি না। নৈতিক বা মানবিক শিক্ষার উন্নয়ন ছাড়া আসলে উচ্চশিক্ষার কোনো লক্ষ্য থাকতে পারে না। বিবিএ, এমবিএ করলেই চাকরি মিলছে। তাহলে দর্শন, কলা, সাহিত্য পড়ানোর দরকার কী? বিশ্ববিদ্যালয় মানেই তো বাণিজ্য বিভাগ না। বরং বিশ্ববিদ্যালয়ের যে ধারণা তার সঙ্গে অনেকটাই দ্বিধা তৈরি করে বাণিজ্য বিভাগ। নৈতিক শিক্ষা না থাকলে তালেবান যেমন আফিমে ভর করে রাজনীতি করে, তেমনি যুক্তরাষ্ট্র অস্ত্রের ব্যবসায় ভর করে। পুঁজি দ্বারা সব নিয়ন্ত্রিত হলে শিক্ষার ফলাফল এমনই হয়। গবেষণা করতে গেলে সব কিছুই আমলে নিতে হবে।’ যোগ করেন মসিউর রহমান।
এএসএস/এএ/জিকেএস