মতামত

পরীক্ষার বোঝা কমিয়ে শিক্ষাক্রমে রকমফের

করোনার জেরে ৫৪৪ দিনের বন্ধের পর স্কুল-কলেজ খুলতেই কারিকুলামে নতুন বার্তা পেল বাংলাদেশের শিক্ষা সেক্টর। ভালো-মন্দ আরো পরের বিষয়। এ নিয়ে কথা হবে। হতেই থাকবে। সরকারের দিক থেকে উদ্দেশ্য হিসেবে বলা হয়েছে, শিক্ষাকে আনন্দময় করে তোলা এবং ক্লাসেই পাঠদান শেষ করা। সেই লক্ষ্যেই শিক্ষাক্রমে পরিমার্জন।

Advertisement

পরিমার্জিত প্রস্তাবিত কারিকুলামের সারসংক্ষেপ হচ্ছে- প্রাথমিকে তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পরীক্ষা থাকছে না। পঞ্চম শ্রেণির সমাপনী-পিইসি এবং অষ্টম শ্রেণির জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট-জেএসসি এবং জুনিয়র দাখিল সার্টিফিকেট-জেডিসি পরীক্ষা আর কেন্দ্রীয়ভাবে হবে না। তা হবে নিজ নিজ প্রতিষ্ঠানে। আবশ্যিক বিষয় ছাড়া অন্য বিষয়গুলোর পরীক্ষাও বাদ দেওয়া হয়েছে। নবম ও দশম শ্রেণির বই আলাদা করা হয়েছে। দশম শ্রেণির পাঠ্যবই পড়িয়েই এসএসসি ও সমমানের পাবলিক পরীক্ষা নেওয়া হবে। মোটকথা এসএসসির ও সমমান পরীক্ষার আগে আর কোনও পাবলিক পরীক্ষা থাকছে না। উচ্চ মাধ্যমিকের একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণির বই আলাদা করা হয়েছে, পরীক্ষাও অনুষ্ঠিত হবে আলাদা। রেজাল্ট দেয়া হবে দুই পরীক্ষা ও মূল্যায়ন সমন্বয় করে।

শিক্ষার্থীদের ওপর থেকে বই এবং পরীক্ষার বোঝা কমাতে পরিমার্জন আনার তাগিদ অনেক দিনের। প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদন হয়ে আসা খসড়াটি কতোটা কাঙ্ক্ষিত, সময়োপযোগী, কতোটা অবাস্তব– এনিয়ে আলোচনা-পর্যলোচনার সুযোগ রয়েছে। এখনই ভালো-মন্দ নির্ণয় করা কঠিন। নিশ্চয়ই আরো সংশোধন-সংযোজনের পর্ব থাকবে। অনুমোদিত প্রস্তাবনা ঠিকঠাক মতো এগুলে ২০২২ সালে চলবে শিক্ষাক্রম পাইলটিং। ২০২৩ সাল থেকে বাস্তবায়ন। ২০২৩ সালে প্রাথমিকে দ্বিতীয় শ্রেণিতে এবং মাধ্যমিকের ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণিতে এটি চালু হবে। ২০২৪ সালে প্রাথমিকের তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণি এবং অষ্টম ও নবম শ্রেণি। ২০২৫ সালে পঞ্চম শ্রেণি ও মাধ্যমিকের দশম শ্রেণিতে বাস্তবায়ন হবে।

পরীক্ষা উঠে যাচ্ছে এই কথা ঠিক নয়, পরীক্ষাই থাকছে সে কথাও ঠিক নয়। কারিকুলামটি একটি রূপরেখা। একে টেক্সটবুকে রূপান্তর করতে হবে। কোর্স কন্টেন্ট বা বিষয়ের ওপর রূপান্তর করতে হবে। বিষয়ে রূপান্তরিত করার পর সব বিষয়ে পরীক্ষার একটি বিষয় থেকেই যায়। কেবল পরীক্ষাতেই তা মূল্যায়ন করা যাবে না। কাজেই বিষয়টি সূক্ষ্ণ। কোন বিষয় কিভাবে মূল্যায়ন তবে, তা নির্ধারণের বিষয় রয়েছে। গণিত, ইংরেজি, ধর্ম, শরীরচর্চা, চারুকলা সব বিষয়ের ধাঁচ এক নয়।

Advertisement

একটা বিষয় মোটামুটি পরিষ্কার পরিমার্জিত নতুন কারিকুলামে পরীক্ষা পদ্ধতির চেয়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীর শিখনকালীন মূল্যায়নকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। তা বাস্তবায়ন করতে গিয়ে আগামী বছর প্রাথমিকে প্রথম শ্রেণি এবং মাধ্যমিকে ষষ্ঠ শ্রেণির পাইলটিং করা হবে। প্রাথমিক ও মাধ্যমিকের ১০০টি করে প্রতিষ্ঠানে পাইলটিং করা হবে। মাধ্যমিকের মধ্যে মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে। ছয় মাস পাইলটিংয়ের পর অগ্রগতি-অবনতি বিশ্লেষণ করা যাবে।

পুরো শিক্ষাক্রম শিক্ষার্থী কেন্দ্রিক ও আনন্দময় হলে, পরীক্ষা ও পাঠ্যপুস্তকের বোঝা কমলে সুফল মিলবে –সেই আশা করাই যায়। মুখস্থ নির্ভরতার বিষয়টি যেন না থাকে, এর বদলে অভিজ্ঞতা ও কার্যক্রমভিত্তিক শিক্ষার সাফল্য কামনা করতেই হয়। করোনাকালসহ বাস্তবতা মাথায় নিতে হবে। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের দৈহিক ও মানসিক বিকাশকে গুরুত্ব বেশি দিতে হবে। শিক্ষার্থীরা শ্রেণিকক্ষেই অধিকাংশ পাঠ-পঠন শেষ করতে পারবে-শুনতে ভালো অবশ্যই। তা বাস্তকে যেন অগ্রাহ্য না করে। শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের জ্ঞান, দক্ষতা, মূল্যবোধ ও দৃষ্টিভঙ্গির সমন্বয়ে সম্পৃক্ত রাখতে হবে অভিভাবকদেরও।

শিক্ষাক্রমের রকমফেরটি গণমাধ্যমে বেশি গুরুত্ব পেয়েছে পরীক্ষা থাকা, না থাকা নিয়ে। এর আড়ালে কিন্তু একটি জিনিস চাপা পড়ে গেছে। সেটি হলো, প্রাথমিক পর্যায়ে প্রাক-বৃত্তিমূলক কোর্স ও বৃত্তিমূলক কিছু সাবজেক্ট ষষ্ঠ থেকে সপ্তম শ্রেণিতে অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে। নবম-দশম শ্রেণিতে বৃত্তিমূলক অকুপেশনাল কোর্সেস- সেগুলোর একটি অন্তত শিক্ষার্থীদের জন্য বাধ্যতামূলক হবে। যা হাতেকলমে শ্রেণিকক্ষ ভিত্তিক মূল্যায়নের মাধ্যমে প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। এ দিকটি কিছুটা উহ্য থেকে যাচ্ছে। সামনে অবশ্যই এগুলোর বিস্তারিত বর্ণনা আসবে।

লেখক: সাংবাদিক-কলামিস্ট; বার্তা সম্পাদক, বাংলাভিশন।

Advertisement

এইচআর/এমএস