মতামত

ডেঙ্গু করোনা বন্যা নদীভাঙন কি থামবে না?

প্রফেসর ড. মো. ফখরুল ইসলাম

Advertisement

একত্রে এতগুলো বিপর্যয় পৃথিবীর মানুষ আগে কখনো দেখেনি। করোনা চলছেই, থামছে না সংক্রমণ, প্রতিদিনই ঘটছে মৃত্যুর ঘটনা। আজ দুটো মৃত্যু কমে তো কাল আবার দশটি বেড়ে যায়। শুধু আমাদের দেশ বলে কথা নয়- সারা পৃথিবীর সর্বত্র বিপর্যয়ের একই রূপ, একই দশা মানুষের। একটু ভাল পরিস্থিতি হতে না হতেই মার্কিন ও ভারত মুল্লুকে পুনরায় সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ায় নতুন শঙ্কা শুরু হযেছে। ভারতে গত ২ সেপ্টেম্বর ৪৬ হাজার মানুষ নতুন করে করোনাক্রান্ত হয়েছেন। আমাদের দেশে শহুরে হাসপাতাল কেন্দ্রিক করোনা সংক্রমণ সরকারি হিসাবে কমলেও গ্রামীণ সংক্রমণ ও মৃত্যুর পরিসংখ্যান স্পষ্ট নয়। সাথে ডেঙ্গুর ভয়াবহ প্রকোপ এবং বন্যা ও নদীভাঙনে নাকাল হয়ে পড়েছে প্রায় গোটা দেশের মানুষ। রাজধানীতে ডেঙ্গুর বিস্তার যেন নতুন ত্রাস হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে।

বাংলাদেশের চিকিৎসকগণ আগে কখনো ডেঙ্গুর এমন ভয়াবহ চরিত্র দেখেননি। ২০১৯ সালে ডেঙ্গু শনাক্ত হলে ৫-৬দিন পর রোগীর অবস্থা খারাপ হতো। ২০২১ সালে ২-৩ দিনের মধ্যে রোগীর অবস্থা খুব খারাপ হবার নজির তৈরি হচ্ছে। ডি-এন ৩ টাইপের ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগীরা দ্রুত শক সিনড্রোমে চলে যাচ্ছে। বাচ্চাদের অবস্থা বেশি সঙ্গীন। এবছর মশক নিধন কার্যক্রম বেশি জোরদার করা হয়েছে। তবুও লার্ভার পরিমাণ কমছে না। ঢাকার ১২টি এলাকাকে ভয়াবহ ডেঙ্গু জোন হিসেবে শনাক্ত করা হয়েছে। এসব এলাকায মশার ঘনত্ব ৭৩ শতাংশেরও বেশি বলে সংবাদে জানা গেছে। দিনে রাতে মশারি নিচে লুকিয়ে জীবন-যাপন করার ধমক খেতে হচ্ছে শিশু-বুড়ো সবাইকে। সারক্ষণ দুশ্চিন্তা ও স্বাস্থ্যভীতি এখন এলাকাবাসীর মানসিক ভাবনা। ডেঙ্গু আতঙ্কে বাচ্চাদেরকে দরজা জানালা বন্ধ ঘরে রেখে মশারির ভেতর বাস করতে বাধ্য করা হচ্ছে।

করোনার টিকা দিয়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে দেবার ঘোষণা দেয়া হলেও টিকা না দিয়েই ১২সেপ্টেম্বর থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেয়া হয়েছে। তবে অক্টোবরে বিশ্ববিদ্যালয় খুলতে সমস্যা অনেক। সময় কম তাই টিকা প্রদানে খুব তোড়জোর চলছে। সব শিক্ষার্থীকে এই সংক্ষিপ্ত সময়ের মধ্যে টিকার আওতায় আনা সম্ভব কি-না তা বলা বেশ কঠিন।

Advertisement

টিকার ২য় ডোজ দেয়া সম্ভবপর হলেও কোম্পানি ভেদে সেসব টিকার কার্যকারিতা মানবদেহে কতদিন? এ নিয়ে আমাদের দেশে তেমন কোন গবেষণা হয়নি। ইসরাইলের এক গবেষণায় বলা হয়েছে, এসকল প্রচলিত টিকার কার্যকারিতা মানবদেহে মাত্র ছয়মাস। তাই সেখানকার স্কুলগামী ১২ বছরের সবাইকে বুস্টার ডোজ প্রদান করা হবে। অর্থাৎ ৩য় ডোজ টিকা প্রদানের ঘোষণা দেয়া হয়েছে। জার্মানিতে বয়স্কদের জন্যও একই চিন্তা করা হচ্ছে।

সব দেশের সকল ব্রান্ডের টিকা মানছে না করোনার বাঁধভাঙা গতি, করোনা এখনো মানতে চাচ্ছেনা টিকা নামক প্রতিষেধকের কোন বাধা। মানুষও মানতে চাচ্ছে না কোন বিধিনিষেধ। চারদিকে মানুষের অনিয়ন্ত্রিত ছোটাছুটি, পথে-প্রান্তরে বাঁধভাঙা জোয়ার, নিয়মভাঙার উল্লাস ও অসহিষ্ণুতা চলছেই। বিশেষজ্ঞরা এ নিয়ে আগামী অক্টোবরে তৃতীয় ঢেউয়ের সংক্রমণের আশঙ্কা করে বিবৃতি দিচ্ছেন। কিন্তু কর্তৃপক্ষ বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা মোটেও গা করছেন না। সেটাই এখন বড় ভয়।

এরই মাঝে শুরু হয়েছে অসময়ে প্রবল বন্যা। উজানের ভারী বৃষ্টিপাত ও পাহাড়ি ঢল মিলে আমাদের সব নদী পানিতে টইটুম্বুর। বিপৎসীমার উপর দিয়ে ছুটে চলেছে নদী নামক ভরা যৌবনা গতির পানিপূর্ণ জলবাহনের তীব্র প্রবাহ। গত ৩ সেপ্টেম্বর দেশের ২০-২৫টি জেলা বন্যার পানির নিচে ছিল। তীব্র পানির তোড়ে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ ভেঙে গেছে অনেক জেলায়।

একটি পত্রিকায় লিখেছে- “স্পার বাঁধে আশ্রয় নেওয়া শামসুল ইসলাম (৫০) বলেন, তিস্তা নদী আমার সব শেষ করছে। প্রায় তিন বছর ধরে এই বাঁধে ঘর তুলে কোনোরকমে দিন কাটাচ্ছিলাম। এই বাঁধও ভেঙে গেল। এখন আমরা যাব কোথায়?” ঝুনাগাছ চাঁপানী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আমিনুর রহমান বলেন, গতকাল দিবাগত মধ্যরাতে স্পার বাঁধটি ভেঙে নদীর গতিপথ পরিবর্তিত হয়েছে। পত্রিকাটি আরো লিখেছে- “তিস্তা ব্যারাজের ভাটিতে ২ নম্বর স্পার বাঁধের প্রায় ২০০ ফুট ভেঙে গেছে। বালুর বস্তা ফেলে বাঁধটি রক্ষার চেষ্টা করা হয়েছিল। কিন্তু নদীর পানি ওঠানামা করার কারণে ভাঙন বাড়ছে। পাউবো ডালিয়া ডিভিশনের বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র সূত্রে জানা গেছে, ওই পয়েন্টে তিস্তা নদীর বিপৎসীমা ৫২ দশমিক ৬০ সেন্টিমিটার।”

Advertisement

তিস্তা ছাড়াও যমুনায় অস্বাভাবিক পানি বৃদ্ধির ফলে শুক্রবার সকালে কাজিপুর উপজেলার বাঁধে আকস্মিকভাবে ধস নেমেছে। আরেকটি পত্রিকা লিখেছে, “মাত্র কয়েক মিনিটের মধ্যে বাঁধভাঙা পানির জোয়ারে ডুবে গেছে কাজিপুর উপজেলার ৩টি গ্রাম। ঘটনার আকস্মিকতায় ৩শ পরিবারের দেড় হাজার মানুষ তাদের পরনের কাপড় ছাড়া আর কিছুই সরিয়ে নেবার সুযোগ পায়নি। বর্তমানে এই সব গ্রামের ৩শ পরিবার আশ্রয় নিয়েছে আশেপাশের উঁচু স্থানে। অনেকেই আবার রয়েছে ঘরের চালে। এ ছাড়া বাঁধ ভাঙার কারণে যমুনার পানিতে কাজিপুর- সোনামুখী আঞ্চলিক সড়কটিও তলিয়ে গেছে। পানি বাড়ার কারণে জেলার নতুন নতুন এলাকায় পানি ঢুকতে শুরু করেছে। নদীতে প্রবল স্রোতে ব্রহ্মপুত্র বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধে প্রচণ্ড- চাপ পড়ছে।”

সব বিপর্যয় যদি একত্রে আমাদের প্রতি রুষ্ট হয়ে গ্রাস করতে চায় তবে আমাদের মরণ দশা ছাড়া আর কি বা করার আছে? খাদ্য নেই, ওষুধ নেই, আগুন জ্বালাবার চুলা নেই, শুকনো জায়গা নেই, শোবার জায়গা নেই। গবাদি পশুর খাদ্য নেই, দাঁড়ানোর জায়গাও নেই। ডাঙায় জায়গা না থাকায় মানুষের মলমূত্র ত্যাগের স্থান নেই। সে এক অমানবিক ব্যাপার ঘটে চলেছে বন্যা কবলিত এলাকাগুলোতে। মানুষ সরকারি রাস্তায় আশ্রয় নিয়েছে। মাথা গোঁজার ঠাঁই নেই। বৃষ্টি-কাদায় নাকাল অসহায় মানব জীবন। তার ওপর করোনার ভয়, ডেঙ্গুর ভয়। নদীর পানি যেভাবে বেড়ে চলেছে তাতে রাস্তায় রাতে ঘুমাবার উপায় নেই। আছে সাপের ভয়। পানিতে ভেসে যাবার ভয়। এমন মানবেতর জীবন সম্পর্কে শহরের বড় বড় দালানের মানুষেরা কি কোন কিছু অনুভব করতে পারবে?

বীজতলা শেষ, রোপা আমন শেষ, শাক-সবজি ক্ষেতের গাছপালা পচে গলে গেছে। “এবারে কীভাবে যে জীবন বাঁচবে তা নিয়ে অন্ধকারে গালে হাত দিয়ে বিলাপ করছিলেন একজন ষাটোর্ধ্ব মানুষ। এমন গজব আইলো, কেউ কাউকে সহ্য করে না। সবাই সবাইকে ভয় করে, ডর করে সামনে আসতে চায় না। ভাল করে দুটা কথাও কইতে চায় না। এর চেয়ে কষ্ট আর কি আছে?” ২-৩ দিন পরে এই পানি নামতে থাকলে নদীভাঙন আরো জোরদার হতে থাকবে। বানের পর নিজের ভিটেমাটি বলে আর কিছু খুঁজে পাব না বলে আক্ষেপ করতে থাকলেন তিনি।

এত মানুষ একসঙ্গে দেখলে সাহায্য দাতার নৌকা এদিকে ভিড়তে চায় না। কারণ অভাবী মানুষের সংখ্যা বেশি, হাত বেশি, কিন্তু ভাত কম। তারা সামান্য সাহায্য নিয়ে এত মানুষের মধ্যে এসে বিপদে পড়তে চায় না। আমাদের কপাল খারাপ। এ বছর সারা গ্রাম, উপজেলা একসঙ্গে পানির নিচে চলে গেছে। তাই কেউ কারো দিকে তাকায় না। করোনার ভয়ে কেউ সহানুভূতি প্রকাশেও এগিয়ে আসে না। বিপদের মধ্যে এমন মানসিক জ্বালা-যন্ত্রণা জীবনে কখনও মনে হয়নি।

দিন যত সামনে গড়াচ্ছে ততই ডেঙ্গু, বন্যা, করোনার সম্মিলিত বাঁধভাঙা স্রোত দেশবাসীকে নাকাল করে ফেলেছে। এটা কষ্টকর, বড় বিপদ শুধু নয়। এখন হাজার হাজার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পানির নিচে অবস্থান করছে। পানি সরে যাবার আগে সেগুলো খুলে দিলে শিক্ষার্থীরা সেখানে যাবে কীভাবে, বসবে কোথায়?

ডেঙ্গু, করোনা ও বন্যার পানির নিচে শিক্ষালয়গুলো কতদিন থাকবে সেটাও অজানা। দুর্যোগ কতদিন থাকবে? কত তাণ্ডব চালাবে? থামবে না নাকি এই কঠিন সুনামি? ষাটোর্ধ্ব প্রবীণ মানুষটির মতো এই প্রশ্নের উত্তর আমাদের কারো জানা নেই।

লেখক : রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডিন, সমাজকর্ম বিভাগের প্রফেসর ও সাবেক চেয়ারম্যান। fakrul@ru.ac.bd

এইচআর/জেআইএম