আমার বিশ্ববিদ্যালয় সময়কালকে মোটা দাগে দুই ভাগে ভাগ করা যায়। প্রথম ভাগ পঁচাত্তর-পূর্ববর্তী। দ্বিতীয় ভাগ পঁচাত্তর-পরবর্তী। প্রথম ভাগে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শাসনকাল। দ্বিতীয় ভাগে খন্দকার মোশতাক এবং জিয়াউর রহমানের শাসনকাল। এই দুই সময়কালে বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাসে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটেছে। বলা যায়, ভবিষ্যতের জন্য ভালোর চেয়ে খারাপ ছাপ বেশি পড়েছে। যে আশা ও স্বপ্ন নিয়ে মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল, দেশ স্বাধীন হয়েছিল সে আশা ও স্বপ্ন ভঙ্গ হতে শুরু করেছিল সূচনালগ্ন থেকেই।
Advertisement
ছাত্র আন্দোলনের একজন সক্রিয় কর্মী হিসেবে প্রায় সবগুলো ঘটনাই কাছে থেকে দেখা, কোনোটা বা ঘটনার সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িতদের কাছে শোনা। আমার দেখা এবং শোনার সঙ্গে সবাই একমত হবেন, সেটা আশা করি না। আমার ভাবনাকেই আমি শতভাগ সঠিক বলেও মনে করি না। ভিন্নমতকে আমি ব্যক্তিগতভাবে সব সময় স্বাগত জানাই। তবে ঘটনা যখন ঘটে যায়, তখন তার ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ নানা রকম হতে পারে, হয়েও থাকে।
যেমন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব তার শাসনকালে যে সব সিদ্ধান্ত নিয়েছেন-কারো কাছে তার সবই সঠিক মনে হতে পারে। আবার আমার কাছে কিছু কিছু সিদ্ধান্ত যথার্থ মনে না-ও হতে পারে। রক্ষী বাহিনী গঠন ঠিক ছিল কিনা, সিরাজ সিকদারকে হত্যা করার প্রক্রিয়ার যথার্থতা নিয়েও বিতর্ক থাকাই স্বাভাবিক। একদিকে সদ্য স্বাধীন একটি যুদ্ধবিদ্ধস্ত দেশ পুনর্গঠনের জন্য বঙ্গবন্ধুকে সময় না দিয়ে কিছু রাজনৈতিক শক্তির চরম মুজিববিরোধিতা, স্বাধীনতাবিরোধী পরাজিত অপশক্তির গোপন-প্রকাশ্য ষড়যন্ত্র, আওয়ামী লীগের কিছু নেতাকর্মীর যুদ্ধশেষের পাওনা বুঝে নেওয়ার জন্য তাড়াহুড়া-লুটপাটে নেমে পড়া , অন্যদিকে দুর্নীতি দমনে কঠোর না হয়ে বকাঝকা করে সুপথে ফিরিয়ে আনার জন্য বঙ্গবন্ধুর মানবিক নমনীয়তা , খন্দকার মোশতাক গংদের অপতৎপরতা সম্পর্কে জেনেও তাদের সম্পর্কে ক্রমাগত উদারতা দেখানো, জিয়াউর রহমান সম্পর্কে নেতিবাচক রিপোর্ট থাকা সত্ত্বে তাকে সেনাবাহিনীর ডেপুটি প্রধান করা -ইত্যাদি স্পর্শকাতর বিষয়গুলো রাজনীতির গতিপথ নির্ধারণে নিয়ামক ভূমিকা পালন করেছে।
এই বিষয়গুলো আমাদের ছাত্রজীবনেই আলোচনায় ছিল। রাজনৈতিক মহলেও এগুলো নিয়ে আলোচনা ছিল। কোনো বিষয় নিয়ে আলোচনা হলে বা কোনো পক্ষ থেকে অভিযোগ উঠলে তা খাটো করে দেখার একটি প্রবণতা তখন নীতিনির্ধারকদের মধ্যে দেখে যেত। মুক্তিযুদ্ধের সময় দেশের মানুষের মধ্যে একটি ব্যাপক ঐক্য গড়ে উঠেছিল, এটা ঠিক। আবার এটাও অস্বীকার করা যাবে না যে, মুক্তিযুদ্ধবিরোধী একটি শক্তিও ছিল এবং তারা একেবারে দুর্বল ছিল না।
Advertisement
সশস্ত্র রাজাকার-আলবদর বাহিনীর প্রতি সমর্থক সংখ্যা মুষ্টিমেয় বলে আমরা একটু তৃপ্তি বোধ করলেও বাস্তবে পাকিস্তানপ্রেমী মানুষ খুব কম ছিল না। নানা বাস্তব কারণে কেউ কেউ প্রকাশ্যে মুখ না খুললেও অন্তরে ঠিকই বিদ্বেষ পুষে রেখে উপযুক্ত সময়ের অপেক্ষা করেছেন। দুঃখজনক হলেও এই বিষয়গুলো নিয়ে আমাদের দেশে গভীরে গিয়ে তেমন কোনো আলোচনা নেই। যারা চিন্তক, গবেষক তাদের বেশিরভাগ আলোচনাই নির্মোহ নয়।
দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে ভারত ভাগ হয়ে হিন্দু ও মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে যে দুটি রাষ্ট্রের জন্ম হয়, তার জন্য জমিন তৈরি একদিনে হয়নি। মানুষের মনোজগতে সাম্প্রদায়িক ভেদ-বুদ্ধি ততটুকু শিকড় গেড়েছিল সেসব বিষয় নিয়েও খুব ভাবনাচিন্তা হয়নি। জাতিগতভাবে আমরা বাঙালিরা কিছুটা আবেগপ্রবণ হওয়ায় বেশির ক্ষেত্রেই আমরা তাৎক্ষণিকতাতাড়িত হয়ে দ্রুত হাঁটতে গিয়ে ভুল পথেই হয়তো হাঁটি।
বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার আন্দোলন অবশ্যই একটি বড় এবং তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা। কিন্তু এই ঘটনার মধ্য দিয়ে বাঙালির মন থেকে সাম্প্রদায়িকতা দূর হয়ে গিয়েছিল বলে মনে করাটা কি কিছুটা সরলীকরণ দোষে দুষ্ট নয়? ভাষা সংগ্রামের পথ ধরেই আমরা স্বাধীনতার দিকে গিয়েছি এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে একটি জাতিরাষ্ট্রের জন্ম খুবই গৌরবের বিষয়। কিন্তু মানুষের মনমানসিকতা কি যুদ্ধজয়ের মধ্য দিয়ে পরিবর্তন হয়। শিক্ষা-সংস্কৃতি-সভ্যতার উৎকর্ষতার বিকাশ সাধন না ঘটিয়ে একটি ঘটনা দিয়ে মনোজগৎ পরিবর্তিত হওয়ার সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যে নির্ভুল ছিল না, তা কি এখনকার অবস্থা দেখে বোঝা যাচ্ছে না?
খন্দকার মোশতাকের মনে যে আগাগোড়াই দুরভিসন্ধি ছিল, তিনি যে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালেও ষড়যন্ত্রমূলক তৎপরতায় লিপ্ত ছিলেন -এটা কি আওয়ামী লীগের তরুণ এবং প্রবীণ নেতাদের অজানা ছিল? কিন্তু স্বাধীন দেশে বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানি কারাগার থেকে ফিরে আসার পর অবিশ্বস্ত মোশতাকের সঙ্গে দূরত্ব তৈরি না হয়ে অতিবিশ্বস্ত তাজউদ্দীনের সঙ্গে দূরত্ব তৈরিতে কারা ভূমিকা পালন করেছিলেন?
Advertisement
১৯৭৫ সালের হত্যাকাণ্ড, বঙ্গবন্ধুর লাশ ৩ নম্বরের সিঁড়িতে ফেলা রেখে আওয়ামী লীগের প্রায় সবাই মোশতাকের আনুগত্য মেনে নিলেন কেন, তা নিয়ে নতুন করে প্রশ্ন উঠেছে। এত বড় এবং এত জনপ্রিয় নেতাকে হত্যার পর তৃণমূল পর্যন্ত বিস্তৃত এত বড় দল কেন এমন নতজানু হয়ে পড়লো তা নিয়েও কেন সেভাবে মূল্যায়ন-বিশ্লেষণ হলো না। হঠাৎ করে ১৫ আগস্ট ঘটেছে মনে করার কারণ নেই। ১৫ আগস্টের ক্ষেত্র প্রস্তুত হওয়ার কথা কি সত্যি কারো জানা ছিল না?
জিয়াউর রহমান পাকিস্তানি অনুচর হিসেবে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছেন বলে এখন আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়। প্রশ্ন হলো, এই অভিযোগ এতদিন পরে কেন? জিয়াকে বীর উত্তম উপাধি তো বঙ্গবন্ধুই দিয়েছেন। সেনাবাহিনীর উপপ্রধান পদও বঙ্গবন্ধুই তৈরি করেছিলেন। কেন কাদের পরামর্শ, তদবির ছিল এর পেছনে? আওয়ামী লীগ চতুর্থ দফায় সরকারে আছে। জিয়ার ভূমিকা নিয়ে একটি বিশ্বাসযোগ্য তথ্যানুসন্ধানের কাজটি কেন করা হয়নি। এ নিয়ে গবেষণা করা, প্রয়োজনীয় তথ্য-প্রমাণ সংগ্রহ করা কি খুব কঠিন কাজ? এর জন্য যে অর্থের দরকার তা জোগাড় করাও কি অসম্ভব ব্যাপার?
বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী এবং স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে কতশত প্রকাশনা হচ্ছে। অথচ জিয়াকে নিয়ে, তাঁর চালাকি এবং রাজনীতিকে কলুষিত করতে তাঁর স্বেচ্ছাচারিতা নিয়ে একটি তথ্যভিত্তিক গ্রন্থ রচনায় কারো আগ্রহ দেখা যায় না কেন? জিয়া বহুদলীয় গণতন্ত্র ফিরিয়ে দেওয়ার নামে, নিজের ক্ষমতা কুক্ষিগত করার জন্য কত অনাচার করেছেন, মুক্তিযুদ্ধের ধারা থেকে দেশকে কীভাবে সরিয়ে নিয়েছেন, কারা জিয়ার প্রশংসায় পঞ্চমুখ- এসব বিষয়গুলো নিয়ে নির্মোহ আলোচনা কেন হয় না?
বাংলাদেশের রাজনীতির বর্তমান হাল নিয়ে যারা হাহুতাশ করেন, গণতন্ত্রহীনতা নিয়ে যাদের উদ্বেগের শেষ নেই, তারা সর্বনাশের শেকড় খোঁজার চেষ্টা করেন বলে মনে হয় না। আমাদের অনেকের অস্থিমজ্জায় স্ববিরোধিতা চরমে। যারা ছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশ নির্মাণের কারিগর, যারা ইতিহাসের জীবন্ত সাক্ষী তারা একে একে চলে যাচ্ছেন। অথচ আমরা সত্য জানার চেষ্টা না করে যার যার মনের মমাধুরী মিশিয়ে ইতিহাস লেখার চেষ্টা করি। মানুষকে তার প্রাপ্য সম্মান বা মর্যাদা দেওয়ার ক্ষেত্রে আমাদের হয় পক্ষপাত থাকে অথবা ভেতরে ভেতরে এক ধরনের বিদ্বেষ কাজ করে।
ইতিহাস যে কাউকে মার্জনা করে না, সেটা আমরা মনে রাখার গরজ বোধ করি না। অহেতুক বিতর্ক করে বিভ্রান্তি না বাড়িয়ে আমরা কবে সত্যসন্ধানী হবো?
লেখক : জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক। সহকারী সম্পাদক,আজকের পত্রিকা।
এইচআর/এএসএম