তালেবানের পুনরুত্থান ও পশ্চিমাদের নানা বিধিনিষেধের পরিপ্রেক্ষিতে আফগানিস্তানে সৃষ্টি হয়েছে চরম মানবিক সংকট। ভেঙে পড়তে বসেছে দেশটির অর্থনৈতিক ব্যবস্থা। এ অবস্থায় সংকটাপণ্ন আফগানদের সহায়তা দেওয়া হবে কি না তা নিয়ে এখনো দ্বিধান্বিত দীর্ঘ ২০ বছর আফগানিস্তানে কথিত শান্তিপ্রতিষ্ঠার যুদ্ধ করা যুক্তরাষ্ট্র ও এর মিত্ররা। আর এ সুযোগে আগেভাগেই সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে চীন ও পাকিস্তান। এরই মধ্যে তাদের ত্রাণবাহী একাধিক প্লেন পৌঁছেছে দক্ষিণ এশীয় দেশটিতে।
Advertisement
রোববার (১২ সেপ্টেম্বর) বার্তা সংস্থা রয়টার্সের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যুদ্ধবিধ্বস্ত আফগানিস্তান মহাবিপদে রয়েছে এবং সেখানে মানবিক সংকট ক্রমেই ঘনীভূত হচ্ছে বলে সতর্ক করেছেন বিশেষজ্ঞরা। এরপরও যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্যান্য পশ্চিমা দেশগুলো তালেবানের হাতে অর্থ যাওয়া আটকানোর নামে আফগানিস্তানে ত্রাণ সহায়তা পাঠাতে গড়িমসি করছে। তারা বলছে, তালেবান মানবাধিকার, বিশেষ করে নারীদের অধিকার রক্ষা করে কি না তার নিশ্চয়তা না পাওয়া পর্যন্ত অর্থসাহায্য পাঠানো উচিত নয়। এরই মধ্যে বিদেশে আফগান কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রায় হাজার কোটি ডলারের সম্পদ বাজেয়াপ্ত করেছে যুক্তরাষ্ট্র। তাদের চাপেই আফগানিস্তানে নতুন অর্থসহায়তা পাঠানোও স্থগিত করেছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)।
এ প্রসঙ্গে চলতি সপ্তাহে আফগানিস্তানের জন্য জাতিসংঘের মহাসচিবের বিশেষ প্রতিনিধি ডেবোরা লিওন্স জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে বলেছেন, এসব তহবিল তালেবান প্রশাসনের জন্যই আটকানো হয়েছে, তা বোধগম্য। তবে এর প্রভাবে অনিবার্যভাবে একটি মারাত্মক অর্থনৈতিক মন্দা সৃষ্টি হবে, যা আরও লাখ লাখ মানুষকে দারিদ্র্য ও ক্ষুধার মুখে ঠেলে দিতে পারে। এটি আফগানিস্তান থেকে শরণার্থীদের বিশাল ঢেউ সৃষ্টি করতে পারে। প্রকৃতপক্ষে এগুলো আফগানিস্তানকে কয়েক প্রজন্ম পিছিয়ে দিতে পারে।
এর আরেকটি পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া হতে পারে, আফগানিস্তানকে তার প্রতিবেশীদের আরও কাছাকাছি নিয়ে যাওয়া এবং চীন-পাকিস্তানের মতো মিত্রদের দিকে বেশি ঝুঁকে পড়া, যারা এরই মধ্যে আফগানদের জন্য প্লেনভর্তি ত্রাণ সহায়তা পাঠিয়েছে। দেশগুলো ইঙ্গিত দিয়েছে, তারা এ ধরনের সহায়তা আরও বাড়াতে আগ্রহী।
Advertisement
গত সপ্তাহে আফগানিস্তানে ৩ কোটি ১০ লাখ ডলারের খাবার ও স্বাস্থ্য সরঞ্জাম পাঠানোর ঘোষণা দিয়েছে চীন। একই সময় কাবুলের নতুন শাসকদের হাতে ভোজ্যতেল ও ওষুধের মতো জরুরি ত্রাণ সহায়তা তুলে দিয়েছে পাকিস্তান। এছাড়া, আফগানদের জন্য বিনাশর্তে ত্রাণ পাঠানো ও আফগানিস্তানের বাজেয়াপ্ত সম্পদ ছেড়ে দিতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন পাকিস্তানি পররাষ্ট্রমন্ত্রী।
চীন-পাকিস্তানের স্বার্থ কী?রয়টার্সের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, তালেবানের সঙ্গে পাকিস্তানের দীর্ঘদিনের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রয়েছে। গত দুই দশক পশ্চিমা বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়তে আফগান সশস্ত্র গোষ্ঠীটিকে ইসলামাবাদ নিয়মিত সহায়তা করেছে বলেও অভিযোগ রয়েছে। অবশ্য বরাবরই এ অভিযোগ অস্বীকার করেছে পাকিস্তান।
অন্যদিকে, পাকিস্তানের ঘনিষ্ঠ মিত্র চীনও সম্প্রতি তালেবানের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছে। বিশ্লেষকদের একাংশের মতে, দক্ষিণ এশীয় দেশটির খনিজ সম্পদ, বিশেষ করে বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম নির্মাণের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান লিথিয়ামের বিপুল মজুত চীনাদের উৎসাহিত করেছে।
বিভিন্ন সশস্ত্র গোষ্ঠী নিয়েও উদ্বেগ রয়েছে বেইজিংয়ের। এসব গোষ্ঠী আফগানিস্তানের সীমান্ত পেরিয়ে চীনেও ছড়িয়ে পড়তে পারে বলে মনে করছে তারা। তালেবান প্রশাসনের সহায়তায় এ ধরনের গোষ্ঠীগুলোকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে চায় চীন।
Advertisement
আবার কিছু বিশেষজ্ঞ বলছেন, চীনের বিশাল বেল্ট অ্যান্ড রোড (বিআরআই) প্রকল্প যুদ্ধবিধ্বস্ত আফগানিস্তানে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা আনতে পারে। সম্ভবনা রয়েছে, আফগানিস্তান চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডোরে (সিপিইসি) যোগ দিতে পারে। এ প্রকল্পের আওতায় অবকাঠামোগত উন্নয়নে পাকিস্তানকে ছয় হাজার কোটি ডলারের বেশি সহায়তা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে চীন, যার বেশিরভাগই ঋণ।
এ প্রসঙ্গে আফগানিস্তানে নিযুক্ত সাবেক পাকিস্তানি রাষ্ট্রদূত রুস্তম শাহ মোহমান্দ বলেছেন, তালেবান সিপিইসিতে যোগ দেওয়াকে স্বাগত জানাবে, চীনও খুব খুশি হবে।
আফগানিস্তানের বিআরআইতে যোগ দেওয়া প্রসঙ্গে এখনো কোনো মন্তব্য করেনি চীন। তবে চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই সম্প্রতি বলেছেন, চীন-আফগানিস্তানের মধ্যে মালবাহী ট্রেন চলাচল ফের চালুর বিষয়ে আলোচনা করতে এবং বহির্বিশ্বের সঙ্গে আফগানিস্তানের যোগাযোগ সহজতর করতে আলোচনার জন্য বেইজিং পুরোপুরি প্রস্তুত।
এ বিষয়ে পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও তালবান মুখপাত্রের মন্তব্য পাওয়া যায়নি।
কেএএ/এমএস