বৈশ্বিক করোনা মহামারির প্রভাব কাটতে না কাটতেই চলতি বন্যায় পানিতে নিমজ্জিত হয়ে পড়েছে তাঁতকুঞ্জ হিসেবে পরিচিত সিরাজগঞ্জের হাজারো তাঁত কারখানা। করোনার ক্ষতি কাটিয়ে নতুন করে ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য যখন চেষ্টা শুরু করেছেন তাঁত মালিকরা ঠিক সেই সময়ে বন্যার পানিতে জেলা সদর, বেলকুচি, এনায়েতপুর ও শাহজাদপুর উপজেলার তাঁতশিল্প পড়েছে নতুন সংকটে।
Advertisement
ছোট-বড় মিলিয়ে অন্তত আট শতাধিক কারখানায় পানি প্রবেশ করেছে। কারখানাগুলোতে এখনো ডুবে আছে অর্ধলাখের মতো তাঁত মেশিন। এই তাঁতশিল্পের সঙ্গে জড়িত লক্ষাধিক শ্রমিক এখন বেকার। চরম কষ্টে কাটছে তাদের দিনরাত। পরিবার-পরিজন নিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন তারা। করোনা আর বন্যায় চরম ক্ষতির মুখে পড়েছেন তাঁত মালিকরাও। বন্যা শেষে নতুন করে এই শিল্পটিকে দাঁড় করাতে সরকারি প্রণোদনা ও স্বল্প-সুদে ঋণের দাবি তাঁত মালিক ও ব্যবসায়ী নেতাদের।
সরেজমিনে জানা গেছে, তাঁতকুঞ্জ হিসেবে পরিচিত সিরাজগঞ্জ জেলার ৫ লাখ পাওয়ারলুম ও হ্যান্ডলুম মেশিনে তাঁত-পণ্য তৈরি হয়। সুতা প্রক্রিয়াজাতকরণ, নকশা তৈরিসহ তাঁত মেশিনে শাড়ি, লুঙ্গি, গামছা তৈরিতে প্রতিদিন কাজ করেন অন্তত ১০ লাখ শ্রমিক। শ্রমিকদের কর্মতৎপরতায় মুখরিত থাকে তাঁতশিল্প এলাকা।
কিন্তু চলতি বন্যায় জেলার তাঁতশিল্প সমৃদ্ধ সদর, বেলকুচি, চৌহালী ও শাহজাদপুরের আট শতাধিক তাঁত পানিতে নিমজ্জিত হয়ে পড়েছে। পানি উঠে পড়ায় বন্ধ হয়ে গেছে বন্যাকবলিত এলাকার অধিকাংশ কারখানা। পানিতে নিমজ্জিত থাকায় তাঁত কারখানার সুতা প্রস্তুত করার ভিম, লোহার ল্যাংগোজ, মেশিনের পায়া ও ইলেকট্রনিক মোটরে মরিচা ধরছে, পচন ধরায় নষ্ট হয়ে গেছে সুতাও।
Advertisement
ফলে বড় ধরনের লোকসানের মুখে পড়েছেন তাঁত ব্যবসায়ীরা। ফলে কর্মহীন হয়ে পড়েছেন এসব শ্রমিকেরা। প্রায় ১ মাস যাবত বেকার থাকা নিম্ন আয়ের শ্রমিকেরা বিপাকে পড়েছেন। পরিবার-পরিজন নিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। কারখানা মালিকেরা লোকসানে থাকায় আর্থিক সহযোগিতা করছে না। মিলছে না সরকারি-বেসরকারি ত্রাণ সহায়তা। এতে ক্ষোভ প্রকাশ করছেন বন্যাকবলিত তাঁত শ্রমিকেরা।
বন্যা শেষে তাঁত কারখানা চালু করতে আবারও নতুন করে সুতা ক্রয় ও ভিম তৈরি করতে হবে তাঁত মালিকদের। সংস্কার ও পরিবর্তন করতে হবে পাওয়াররুম-হ্যান্ডলুমের মূল্যবান যন্ত্রপাতি। পুনরায় কারখানা চালু করতে প্রয়োজনীয় পুঁজির জোগান নিয়ে দুশ্চিন্তায় রয়েছেন তাঁত মালিকেরা।
তাঁত শ্রমিক হায়দার আলী, জাহাঙ্গীর হোসেন ও রফিকুল ইসলাম বলেন, গত ২০ দিন যাবত কাজ নেই। কারখানা পানিতে তলিয়ে রয়েছে। ফলে আমরাও বেকার হয়ে পড়েছি। পরিবার-পরিজন নিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছি। এখনো কোনো ত্রাণ বা সহযোগিতা পাইনি।
তাঁত মালিক আলমগীর হোসেন ও শামসুল ইসলাম বলেন, করোনা ও বন্যা আমাদের স্বপ্নগুলো ধ্বংস করে দিয়েছে। এবার বন্যার পানিতে নিমজ্জিত থাকায় তাঁত কারখানার সুতা প্রস্তুত করার ভিম, লোহার ল্যাংগোজ, মেশিনের পায়া ও ইলেকট্রনিক মটরে মরিচা ধরছে। পচন ধরায় নষ্ট হয়ে গেছে সুতাও। বন্যা শেষে তাঁত কারখানা চালু করতে আবারও নতুন করে সুতা কিনে ভিম তৈরি করতে হবে। এখন কিভাবে কারখানা চালু করব তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছি।
Advertisement
সিরাজগঞ্জ জেলার পাওয়ালুম মালিক সমিতির সভাপতি হাজি বদিউজ্জামান বলেন, চলতি বন্যার পানিতে নিমজ্জিত হয়ে পড়েছে তাঁতকুঞ্জ হিসেবে পরিচিত সিরাজগঞ্জের আট শতাধিক তাঁত কারখানা। পানিতে ডুবে যাওয়ায় নষ্ট হচ্ছে সুতা ও তাঁত মেশিনের যন্ত্রপাতি। ফলে বড় ধরনের লোকসানের মুখে পড়তে হচ্ছে আমাদের মতো তাঁত মালিকদের।
এক কথায় আমাদের স্বপ্ন এখন পানিতে নিমজ্জিত। একই সঙ্গে কারখানায় পানি উঠে পড়ায় কাজ না পেয়ে বেকার হয়ে রয়েছেন অনেক তাঁতশ্রমিকসহ এই শিল্পসংশ্লিষ্ট লক্ষাধিক মানুষ। বন্যা শেষে নতুন করে এই শিল্পটিকে আবারো দাঁড় করাতে সরকারি প্রণোদনা ও স্বল্প সুদে ঋণের দাবি জানিয়েছেন এই তাঁত মালিক।
সিরাজগঞ্জ জেলা তাঁত মালিক সমিতির সভাপতি হাজি এম এ বাকী বলেন, সিরাজগঞ্জ জেলার ৫ লক্ষাধিক পাওয়ারলুম ও হ্যান্ডলুম মেশিনে তাঁতপণ্য তৈরি হয়। চলতি বন্যায় জেলার তাঁতশিল্পসমৃদ্ধ সদর, বেলকুচি, চৌহালী ও শাহজাদপুরের হাজার হাজার তাঁত পানিতে নিমজ্জিত হয়ে পড়েছে। পানিতে নিমজ্জিত থাকায় তাঁত কারখানার সুতা প্রস্তুত করার ভিম, লোহার ল্যাংগোজ, মেশিনের পায়া ও ইলেকট্রনিক মোটরে মরিচা ধরছে, পচন ধরায় নষ্ট হয়ে গেছে সুতা।
ফলে বড় ধরনের লোকসানের মুখে পড়েছেন তাঁত ব্যবসায়ীরা। বন্যা শেষে তাঁত কারখানা চালু করতে আবারো নতুন করে সুতা ক্রয় ও ভিম তৈরি করতে হবে, সংস্কার ও পরিবর্তন করতে হবে পাওয়ারলুম-হ্যান্ডলুমের মুল্যবান যন্ত্রপাতি। পুনরায় কারখানা চালু করতে প্রয়োজনীয় মূলধনের জোগান নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছেন তাঁত মালিকেরা।
এ বিষয়ে বেলকুচি পৌরসভার মেয়র সাজ্জাদুল হক রেজা বলেন, তাঁত শ্রমিকদের মাঝে পৌরসভা থেকে খাদ্য সহায়তা দেওয়া হলেও মালিকদের সহায়তার জন্য তাঁত বোর্ডকে লিখিতভাবে জানানো হয়েছে। তাঁত বোর্ড তালিকা তৈরি করে আগের মতো সহায়তা করবে বলে জানিয়েছেন।
এ ব্যাপারে বেলকুচি উপজেলা নির্বাহী অফিসার আনিসুর রহমান বলেন, তাঁতশিল্পকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা তৈরি করে তাঁতবোর্ড ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করা হবে। আপাতত শ্রমিকদের মাঝে আমরা সরকারিভাবে বরাদ্দকৃত ত্রাণের চাল ও নগদ অর্থ বিতরণ করছি।
সিরাজগঞ্জ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা আবু ইউসুফ সূর্য্য জানান, বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত শ্রমিক ও মালিকদের আর্থিক প্রণোদনার জন্য জেলা প্রশাসন ও তাঁত বোর্ডের মাধ্যমে বন্যাকবলিত তাঁত কারখানার তালিকা করা হচ্ছে। একই সঙ্গে বন্যা শেষে পুনরায় কারখানা চালু করতে স্বল্প-সুদে ঋণ পাওয়ার জন্য মালিকদের পাশে থাকবে চেম্বার অব কমার্স।
এমআরএম/জিকেএস