মতামত

বিনোদনের প্রলেপের নিচে কঠিন বাস্তবতা

দারুণ উচ্ছ্বাস আর উৎসবের মধ্য দিয়ে শেষ হল বিপিএল তৃতীয় আসর। বেশিরভাগ ম্যাচই ছিল তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা আর উত্তেজনায় ঠাসা। ফাইনালসহ বেশ কয়েকটি ম্যাচ শেষ হয়েছে শেষ ওভারের শেষ বলে। এমন স্নায়ুক্ষয়ী সব ম্যাচ উপভোগ করতে টিভি পর্দা থেকে চোখ সরাতে পারেনি ক্রকেটপ্রেমীরা। ক্রিকেটের গৌরবময় অনিশ্চয়তার টাটকা স্বাদ নিতে দর্শকরাও ছুটেছেন মাঠে। সব মিলিয়ে এবারের বিপিএল উত্তাপ ঠাসা নিখাদ বিনোদন। এই পর্যন্ত সব ঠিক আছে। কিন্তু যদি প্রশ্নটা এভাবে করা হয়, এবারের আসর কি আদৌ মূল লক্ষ্য অর্জন করতে পেরেছে? টি২০ ক্রিকেটে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ দল হয়ে ওঠা। আগামী মার্চ মাসে  ভারতে টি২০ বিশ্বকাপ। বিপিএলের মধ্য দিয়ে আসছে বিশ্বকাপের প্রস্তুতি সর্বোপরি ওয়ানডের মতই টি২০তেও টাইগাররা দল হয়ে উঠবে, আসরের আগে বারবার এমন আশা ব্যক্ত করেছিলেন বিসিবি প্রধান নাজমুল হাসান পাপনসহ অধিনায়ক মাশরাফি মর্তুজা। এই আকাঙ্খার জায়গাটি নিশ্চিত করতে পারেনি এবারের বিপিএল। টি২০ ক্রিকেটে দল হয়ে ওঠার যে চ্যালেঞ্জ এবারের জমজমাট বিপিএল উৎসবের পরও সেই একই চ্যালেঞ্জ বাংলাদেশের সামনে।এবারের বিপিএল যে শুধু নিখাদ বিনোদন ছিল না, সেটা অনুধাবনের জন্য বিশেষজ্ঞ হওয়ার প্রযোজন পড়ে না। বাংলাদেশের সাম্প্রতিক টি২০ গ্রাফের দিকে তাকালেই বিষয়টা হয়ে ওঠে সুস্পষ্ট। এবারের বিপিএলের আগেই জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ওয়ানডে ও টি২০ সিরিজ খেলেছে বাংলাদেশ। তিন ম্যাচের ওয়ানডে সিরিজে জিম্বাবুয়েকে হোয়াইটওয়াশ করেছে টাইগাররা। বিপরীতে দুই ম্যাচের টি২০ সিরিজে ১-১  সমতায় থেকে মাঠ ছেড়েছে বাংলাদেশ।  এর আগে সফরকারী দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষেও সিরিজে দেখা গেছে একই চিত্র। তিন ম্যাচের ওয়ানডে সিরিজে প্রোটিয়াদের ২-১ ব্যবধানে হারিয়েছে বাংলাদেশ আর টি২০ সিরিজে হেরেছে ০-২ ব্যবধানে।গত বছর ঘরের মাঠে সর্বশেষ টি২০ বিশ্বকাপে টাইগারদের লজ্জা এখনও পোড়ায় এদেশের ক্রিকটেপ্রেমীদের। বাছাইপর্বে ক্রিকেটের নাম-গোত্রহীন হংকংয়ের কাছে ২ উইকেটের ব্যবধানে হারের লজ্জায ডোবে স্বাগতিক বাংলাদেশ।বাছাইপর্বে নেপাল আর বাংলাদেশের পয়েন্ট ছিল সমান (৪ পয়েন্ট)। নেট রানরেটে সামান্য এগিয়ে থেকে মূলপর্বের (সুপার টেন)  ছাড়পত্র পায় টাইগাররা। মূলপর্বেও স্বাগতিক বাংলাদেশের দৈন্যদশা ওঠে চরমে। চার ম্যাচের প্রতিটিতেই অসহায়ভাবে আত্মসমর্পণ করে টাইগাররা। বলা-বাহুল্য মূলপর্বে বাংলাদেশ একমাত্র দল যারা কি-না জিততে পারেনি একটি ম্যাচও। এমনকি সুপার টেন-এ ইংল্যান্ডকে হারিয়ে একটি জয় নিয়ে দেশ ছাড়ে আইসিসি সহযোগী দেশ নেদারল্যান্ডসও।অনেকটা একই আদলের খেলা ওয়ানডে আর টি২০। অথচ ওয়ানডে ক্রিকেটে বাংলাদেশ যতটাই উজ্জ্বল টি২০ ক্রিকেটে ঠিক ততটটায় অনুজ্জ্বল বাংলাদেশ। এবারের বিপিএল আসরের ঠিক আগে আগে এক সংবাদ সম্মেলনে মাশরাফি পুরো বিষয়টি স্বীকার করে নিয়ে বলেন ’ টি২০তে আমরা ভাল করি না। এই ফরম্যাটে আমরা কম কম খেলি। সাকিব ছাড়া বিশ্বের সব বড় বড় টি২০ আসরে আমাদের আর প্রায় কারোরই খেলার অভিজ্ঞতা নাই। আশা করছি এবারের বিপিএলে আমরা দল হিসাবে গুছিয়ে উঠব। সামনের বিশ্বকাপে নিজেদের তৈরি করে নেয়ার জন্য এবারের বিপিএল আমাদের জন্য খুবই গুরুত্বপুর্ণ।’ এবারের তৃতীয় বিপিএলের আগে, বিশ্বকাপ প্রস্তুতির প্রসঙ্গটি বারবার সামনে টেনে এনেছেন বিসিবি কর্মকর্তা তথা বিপিএল আয়োজক সংশ্লিষ্টরা। কিন্তু এবারের আসরে সেই তৈরি হওয়ার জায়গাটিতে কতটুকু সাফল্য পাওয়া গেছে প্রশ্নটা সেখানেই।টি২০ ক্রিকেট মানেই রানের পাগলা ঘোড়া ছোটা। চার-ছয়ের বাহারী স্ট্রোক প্রদর্শনী। কিন্তু দু-একটি ব্যতিক্রম বাদ দিলে এবারের আসরে প্রায় একতরফা দাপট দেখিয়েছে বোলাররা। বেশিরভাগ ম্যাচগুলোতেই চার-ছয় নয় উইকেট আগলে রাখতেই হিমশিম খেতে হয়েছে ব্যাটসম্যানদের। আগে ব্যাট করতে নেমে দশটি ম্যাচে ১২০ রানের নিচে অলআউট হয়েছে দলগুলো। ৫৬ ও ৫৯ রানে অলআউট হওয়ার ঘটনা ঘটেছে এবার। ব্যাট হাতে লংকান কুমার সাঙ্গাকারাই যা একটু ধারাবাহিক ছিলেন। এবারের বিপিএল টুর্নামেন্টে ব্যাটসম্যানরা নয় আলোচনায় ছিল উইকেট। ব্যাটসম্যানেরা নয় খেলছে উইকেট,  এমন সংবাদ শিরোনাম করে রিপোর্টও হয়েছে পত্রিকায়। প্রায় প্রতিটি ম্যাচ শেষেই এমন ’উইকেটে ব্যাট করা কঠিন’ বলেছেন তামিম ইকবাল, মুশফিকুর রহিম, মাশরাফিরা। বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানদের মধ্যে কিছু রান পেয়েছেন ওপেনার তামিম ইকবাল ও ইমরুল কায়েস। তামিম তো প্রথম থেকেই উইকেট নিয়ে শুনিয়েছেন তার আক্ষেপের কথা। এক ম্যাচ শেষে ইমরুল কায়েস বলেছেন-‘উইকেট এত নরম যে দেড় আঙ্গুল দেবে যাচ্ছে। এমন মন্থর উইকেটে ব্যাট করাটা কঠিন’- একাধিকবার বলেছেন মাশরাফি।সব কথার এক কথা টি২০এর মোটেও মানানসই উইকেট ছিল না এবার। ওয়ানডে ক্রিকেটে এখন স্বর্ণ সময় চলছে বাংলাদেশের। যাদেরকে ঘিরে ওয়ানডের এই রাজসিক পথচলা তাদের প্রায় সবাই এবারের বিপিএল আসরে সুপার ফ্লপ। সৌম্য সরকার রান পাননি, নাসির হোসেনকে  চিনতে কষ্ট হয়েছে, হার্ডহিটার হিসাবে বিশেষভাবে খ্যাত লিটন কুমার দাস শুধু অংশ নিয়েছেন উইকেটে যাওয়া-আসার মিছিলে। পুরো টুর্নামেন্টের একেবারে শেষ দিকে কোয়ালিফায়ার ম্যাচে নিজের মাইনর একটা ইনিংস খেলেছেন সাব্বির রহমান। ঘরোয়া আসরে রানের বানে মাঠ ভাসানো রনি তালুকদার, শুভাগত হোম, মোহাম্মদ মিথুন, কিংবা ফেরার লড়াইয়ে থাকা এনামুল হক বিজয়রা শুধু পূরণ করে গেছেন সেরা একাদশের সংখ্যাই। বোলারদের দাপটের মাঝেও তাসকিন আহমেদ, রুবেল হোসেনরা ছিলেন চূড়ান্তভাবে অকার্যকর। সেমিফাইনাল (কোয়ালিফায়ার) পর্বেও আগেই প্রতিটি দল খেলেছে দশটি করে ম্যাচ।এক /দুই ম্যাচে হঠাৎ একজনের একটা ভাল ইনিংস আর যাই হোক বিশ্বকাপের আগে প্রস্ততিতে কোনো মানদণ্ড হতে পারে না। রান পাননি কিংবা ফর্মে ফিরতে পারননি এর জন্য ব্যাটসম্যানদের যতটা দায় তার চেয়েও অনেক বেশি দায় উইকেটের। ধরেই নেয়া যায় টি২০ বিশ্বকাপে আর যাই হোক এমন উইকেট হবে না। ব্যাটসম্যানেরা যাতে রান পায় উইকেট তৈরি করা হবে সেভাবেই। উইকেট পুরোপুরি ব্যাটিং বান্ধব যদি নাও হয় তারপরও স্পোর্টিং উইকেট হবে, এটা বলেই দেয়া যায়। এবারের আসরে ফেরার লড়াইয়ে নিজেকে নতুন করে চিনিয়েছেন আমাদের পেসার আল-আমিন হোসেন। এই বিপিএলের বড় আবিষ্কার টিনএজ পেসার আবু হায়দার রনি। কিন্তু সহায়ক উইকেটে এরা যতটা জ্বলে উঠেছেন বিরুদ্ধ কন্ডিশনে তারা কতটা কার্যকর হয়ে উঠবেন সেটাও থেকে যাচ্ছে অপ্রমাণিতই। যার অর্থ দল গোছানোর জায়গাটিতে বিপিএলের আগে যে কঠিন বাস্তবতার মধ্যে ছিল এখনও সেই জায়গাটিতেই দাঁড়িয়ে বাংলাদেশ।এবারের বিপিএল বিনোদনের ঢেউয়ে ভাসিয়েছে ক্রিকেটপ্রেমীদের। এটা যেমন সত্যি তার চেয়েও বড় সত্যি, বিনোদনের প্রলেপের নিচেই টি২০ ক্রিকেটে দল গোছানোর যে কঠিন বাস্তবতা  সেই বৃত্তবন্দী দশার মধ্যেই আটকে আছে বাংলাদেশ ক্রিকেট।এইচআর/পিআর

Advertisement